পত্র কাব্য

প্রিয় মধুবাবু,
কত কথা জমিয়ে রেখেছি তোমাকে বলব বলে। তোমার চোখে, মুখে, ঠোঁটে লেগে থাকা না বলা কথাগুলো পড়েছি আগেই। তুমিও তাই। লিখে লিখে সব বলার আর কিবা আছে। মনে আছে তোমার মধুবাবু, সেই যে, জল জোছনার গল্পটা? যেখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। জল জোছনার সেই গল্পটুকু না হয় আজ থাক। সত্যিই মিথ্যে বলেনি তোমার কবি বন্ধু। তুমি একটা হিরের টুকরো বটে, তোমার ভেতরে যে আলো আছে তা অনেক আগেই ছড়িয়ে দেওয়া উচিত ছিল মধু বাবু। তুমি এক সময় খুব ভালো লিখতে। তারপর মাঝের দিনগুলোতে সেসব কী কারণে বাক্সবন্দী করে রেখেছিলে।
মনে আছে? আমি তোমাকে বলেছিলাম, তোমার মতো মেধাবী কবি না লিখলে অনেক কষ্ট পাব। তুমি কথা দিলে। তাই আবারও লিখতে শুরু করলে। কথায়, লেখায়, কবিতায় তোমার একটা নিজস্বতা আছে, যা সবার নেই। তোমার ভেতর, বাহির সব মিলিয়ে যেন এক নান্দনিক বাগান। যখন তোমার আবৃত্তি শুনি সেখানেও জাদুমাখা থাকে। তোমার সঙ্গে যখন কথা বলি, মনে হয় ঝরনার গান শুনছি।
‘তুমি যখন কথা বলো আমি ঝরনার গান শুনি। তারপর আরও একটি দিন গুনি। তুমি যখন কবিতা শোনাও, আমি পাখিদের গান শুনি। তারপর স্বপ্নের দিন গুনি। তাইতো তোমার জন্য কবিতার নানা পঙ্‌ক্তিমালা নীল সাগরের ঊর্মিমালা হয়ে বারবার আছড়ে পড়ে বুকের এই কিনারে, যেখানে তুমি শুধু তুমি। তুমি ছাড়া এ হৃদয় যেন শুধুই মরুভূমি।
মধুবাবু, তোমাকে বলেছি অনেকবার, ইচ্ছে করে ঘাসফুল হই তোর ওই বুকের জমিনটাতে। ইচ্ছে করে বেলির বাগান হয়ে ছুঁয়ে থাকি তোর হাতটাতে। বেলি আমার প্রিয়, আরও প্রিয় হয়ে উঠেছে তুমি যেদিন তোমার প্রিয় ফুলের কথা জানালে। আমি আজও বেলি ফুলের মালা গেঁথে খোঁপায় জড়িয়ে রাখি আর ভাবি, বেলির চেয়ে মিষ্টি তোমার গন্ধ। প্রথম যেদিন আমার খোঁপায় বেলির মালা জড়িয়ে দিয়েছিলে আমার মনে হয়েছিল, বেলি ফুলের গন্ধ ম্লান করে দিয়েছিল তোমার ভালোবাসার গন্ধ। আমি মুগ্ধ ছিলাম তোমাতেই। আজও তোমার ছোঁয়া, তোমার মিষ্টি গন্ধে আমি প্রতিদিনই তোমাকে পাই নতুন করে।
গাছে গাছে যে সবুজ পাতা, ওগুলোই আমার না বলা কথা। ফুলেরা সেখানে আনন্দে রঙিন, সেটাই তোমার জন্য ভালোবাসা অমলিন। একদিন তুমি ছিলে আমার একজন ভালো বন্ধু। আজও আছ। তবুও সেই জায়গাটাকে সযতনে বুকের ভেতর তুলে রেখে কবিতা পাঠালে—
‘নীলমণীষা! ভাবতে থাকো।
ভাবতে ভাবতে ছবি আঁকো
মনের নদীর জলতরঙ্গে
ভাব-কুসুমে স্বপ্ন মাখো
হোক না সৃজন হৃদয়-সাঁকো
দূরত্বহীন তোমার সঙ্গে।
স্বপন ঘেরা ঘর বেঁধেছ হৃদয়কুলে
রোদবৃষ্টি জোছনাবেলায়
আনন্দ রং প্রজাপতি ডানা খোলে
একটি প্রজাপতি
মরূমনে পাঠিয়ে দিলে
কী আর এমন ক্ষতি!
স্বপন ঘেরা ঘর বেঁধেছ হৃদয়কুলে
রোদবৃষ্টি জোছনাবেলায়
আনন্দ রং প্রজাপতি ডানা খোলে
একটি প্রজাপতি
মরূমনে পাঠিয়ে দিলে
কী আর এমন ক্ষতি!
ওর আঁচলে সুখের নিদ
স্বপ্নে গাইব দ্বৈত গীত’।
তোমার মরূমনে আমিতো হয়েছিলাম একটি প্রজাপতি। আজও সেই প্রজাপতি যখন-তখন আনন্দের রং ছড়ায় তোমার হৃদয়ের বাগানে, তুমি অনুভবে পাও তাকে।
মধুবাবু, তোমাকে বলেছি বারবার। তবুও বলতে চাই, তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা প্রকাশ করার মতো ভাষা নেই আমার। লিখতে গেলে পারি না, শব্দেরা আমার সঙ্গে দুষ্টুমি করে আকাশে সাদা মেঘ হয়ে উড়ে বেড়ায়।
তোমার কথা বলা, তোমার ব্যক্তিত্ব, তোমার কবিতা, তোমার ভেতর-বাহির সব মিলিয়ে তুমি সবার থেকে আলাদা। তোমার অন্তরের সৌন্দর্য প্রতি মুহূর্তে মুগ্ধ করে আমায়। সব ভালো লাগা মিলিয়ে আমি অবলীলায় চলে যাই একটা রাজ্যে, যেখানে আমি রানি হয়ে যাই। তুমি আমার রাজা। হয়তো কোনো রাজপ্রাসাদ নেই সেখানে, কিন্তু যা আছে তা শুধু ভালোবাসা। ভালোবাসার সেই রাজ্যে শুধু আমরা দুজনে। একটি ঘর যার বেড়া ভালোবাসায় ঘেরা। ছাদ নেই। জোছনা রাতে টুপটাপ করে ঝরে পড়ে তারার ফুলেরা। তুমি আমার জন্য সেগুলো কুড়িয়ে আমার শাড়ির আঁচলে তুলে দাও ভালোবেসে।
আমি মালা গাঁথি, তুমি আমার খোঁপায় জড়িয়ে দাও ভালোবাসার মালা। সারা রাত কবিতা আর গান ছুঁয়ে যায় মন প্রাণ। তুমি গেয়ে ওঠো, ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানি, দেব খোঁপায় তারার ফুল...’
আমি বলি তখন—
‘তুমিময় আমি
নাকি আমিময় তুমি?
তুমি জানো, আমি জানি,
জানে অন্তর্যামী।’
তোমাতেই আমি মুগ্ধ। একটা স্বপ্নিল ভালো লাগা ছুঁয়ে থাকে তোমাতে। একজন তুমিতে এত গুন কী করে বোঝাব সে কথা মধুবাবু। ‘তবু সে সবার ঊর্ধ্বে নির্লিপ্ত নির্মল ফুটিয়াছে কাব্য, তব সৌন্দর্য কমল।’ সে তুমি। অন্তর্লীন অতীন্দ্রিয় সত্তার খুব গভীরে মিশে আছি যেন, যেখানে কেবল মঞ্জুরিত সৌরভে ফুলের মেলা বসে ভালোবাসার তাগিদে। মৃদুমন্দ শিহরণে রাধাচূড়ার যৌবন যেমন। শাশ্বত বনভূমির কাছাকাছি যেতে ইচ্ছে করে, যেখানে বৃষ্টির রোমান্টিকতায় প্রকৃতি সবুজ ও সতেজ যেখানে দগ্ধ হৃদয় নয়, বৃষ্টিভেজা বাতাসের সুতীব্র আলিঙ্গন নিয়ে যায় আনন্দলোকে।
ধ্রুপদি ভঙ্গিমায় একটি হৃদয় আর একটি হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়...। যেখানে ভালো লাগার শাশ্বত সুখটুকু মুহূর্তেই নিয়ে যায় কোনো এক স্বর্গালোকে। আর সেখানেই তুমি। তুমি ছাড়া শূন্য এ মনভূমি।
মধুবাবু, তুমি জানো কতটা প্রিয় তুমি। তুমি ছাড়া আকাশটা নীল রং ছুঁয়ে থাকে না, তুমি ছাড়া বৃষ্টিরা গান গায় না, তুমি ছাড়া প্রজাপতি মন আনন্দে রং ছড়ায় না। কী করে বোঝাব সেসব না বলা কথা। শেষ হবে না পাতার পর পাতা লিখে গেলেও। তোমার জন্য এক পৃথিবী লিখব একটু একটু করে, যত দিন বাঁচব।
মধু বাবু, মনে আছে তোমার? আমি মাঝে মাঝে বলি চলো হারিয়ে যাই গভীর কোনো মনোবনে।
যেখানে তুমি আমি, নীল আকাশ, ফুল পাখি, কবিতার পাতায় পাতায় আমাদের ভালোবাসা। তুমি হেসে বলতে মন্দ না। মাঝে মাঝে তোমার আমার এই কবিতাময় জীবনে একটু ছন্দপতন ঘটে, দুজনেই অভিমানের কালো মেঘে ঢেকে থাকি। তুমিতো জানো তোমার মুখে বৃষ্টির গান শুনব বলে অপেক্ষায় থাকি। মনের আকাশে মাঝে মাঝে মেঘ না জমলে বৃষ্টির রোমান্টিকতায় ভিজব কেমন করে। তাইতো বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দাও তুমি।
কবি, তোমাকেই বলছি। হয়তো শুনেছ, জেনেছ তা না হলে আমার জন্য এত কবিতা কেন তুমি লিখেছ। তোমার এত কবিতা আমার জন্য, সত্যিই কবি আমি মুগ্ধ তোমাতেই। এটা আমার পরম পাওয়া, কবিতার প্রতিটি অক্ষরে অক্ষরে আমার জন্য ভালোবাসা। আমি হয়তো তোমার মতো ভালোবাসতে পারব না। কিন্তু আমার নির্ভেজাল ভালোবাসা তোমার জন্য।
ভালোবাসি যতন করে
আমার মতো শুভ্র ভোরে
ভালোবেসে এই তোমারে
রাখব আমার বাহু ডোরে।
ভালো থাকিস, ভালো থাকিস
চির জীবন, চির জীবন ওরে।
ভালো থাকিস, ভালো থাকিস
পাখি হয়ে কাছে আসিস।
মধু বাবু, আমার ভালোবাসার এলোমেলো কথাগুলো শেষ হবে না কোনো দিন। তুমি যখন সামনে থাকবে তখন টুপটাপ করে ভালোবাসার কাব্যগুলো থেকে একটি একটি শব্দ জোছনার ফুল হয়ে ভালোবেসে তোমাকে দেব। তোমার জন্য যত্ন করে সেগুলো তুলে রাখলাম মনের আকাশে।
জানো মধুবাবু, আমি যখন নীল আকাশে তাকাই আমার মনে হয়, নীল আকাশটা যে তুই, ইচ্ছে করে কাছে গিয়ে একটুখানি ছুঁই। মাঝে মাঝে মনে হয়, তোর বুকের জমিনটাতে আমি সেই ঘাসফুল, দোষ কী তাতে।
আজ আর লিখব না। তোমার জন্য লিখব এক পৃথিবী, যেখানে আমাদের ভালোবাসার স্বপ্ন গাঁথা।
‘তোমার এবং আমার কণ্ঠে এমন ধ্বনি চাই
যেনবা দূরে শান্ত ঘর, তার ভেতরে কলস্বর
উভয় ঠোঁটে উচ্চারিত একটি কবিতাই।
স্বপ্নহীনের দীর্ঘশ্বাসে বল না তুমি ‘নাই’
বল না তুমি নাই, আমাদের সম্ভাবনা নাই।
বর্তমানের রসায়নে, ভবিষ্যতের ধূসর বনে
বসন্তকাল আগেই আসে আমরা যদি চাই।
স্বপ্নহীনের দারুণ শীতে বল না তুমি, ‘নাই’।’
কবিতার কথাগুলো কখনো কখনো মনের কথা হয়ে ওঠে তাই বলতে ইচ্ছে করে। যখন তুমি জলের গান হয়ে আমার দেহে আমার মজ্জায়, কী উজ্জ্বল জোয়ারে যাও বয়ে, শান্তি পাই। যখন তুমি আমার ঠোঁটে রাখ একটি লাল গোলাপ, আত্মায় ঝরাও পাতা, আবেগ ভরে ডাকো, শান্তি পাই।
আজ আর নয়। ভালো থেকো। শুধু তোমাকে বলতে চাই ভালোবাসি, শুধু ভালোবাসি...। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য, সবটুকু আনন্দ উচ্ছ্বাস, সবটুকু বিশ্বাসে ভরা একটি সুন্দর মন, সে শুধু তুমি। পৃথিবীর যত সুরভিত ফুল তার সবটুকু না হোক, তোমার প্রিয় বেলির গন্ধ মেখে ভালো থেকো, যেখানে পাবে আমার ভালোবাসার মিষ্টি ঘ্রাণটুকু। ভুলে থেকো না আমায়। তুমিতো জানো, তুমি যে আমার সেই নীল আকাশ, যেখানে আমার মনোবাস, তুমি যে আমার সেই নীল আকাশ, যার বুকেতে আমার নিশ্বাস।
তোমার যাদুমনি।