পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় তাঁবুতে রাত

সারা রাত ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তাঁবুতে রাত কাটালাম। রাত ১২টার পর আস্তে আস্তে তাপমাত্রা নিচের দিকে নামতে থাকে। ব্যাটারিচালিত হিটারটি বেশ ভালোই গরম বাতাস দিয়ে আমাদের দুজনকেই বেশ উষ্ণতা দিল। চারদিকে শুধু উপত্যকার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এরই মধ্যে কৌতুক আর বিভিন্ন মানুষের কথা বলা, অ্যাক্টিং করা থেকে একেকজনের বিভিন্ন গল্প করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, মনে নেই।
হঠাৎ দমকা হাওয়ার ঝাপটায় ঘুম ভেঙে গেল, মনে হলো যেন তাঁবুটাকে উপড়ে ফেলে আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে পাহাড়ের ঢালুর দিকে। ভীষণ খাড়া পাহাড়ের স্লোপ-কোথাও কোথাও প্রায় নব্বই ডিগ্রি খাঁড়া। ভাবতেই ভয় লাগে, আবার ভাবলাম পাহাড়ের ওই প্রান্ত থেকে আবার বন্য কোনো পশু না এসে আমাদের আক্রমণ করে বসে। প্রতিরক্ষার জন্য কেবল আছে পাহাড়ে ওঠার লাঠি দুটি আর রাতে বার বি কিউ করার খন্তা আর মাংস-সবজি কাটার দুটি চার ইঞ্চি চাকু। আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লাম, বালিশের নিচ থেকে টর্চলাইট বের করে লাঠি নিয়ে বের হয়ে পড়লাম তাঁবু থেকে। সেই অনেক বছর পর পাহাড়ে রাত কাটাচ্ছি, চাঁদের আলো-আঁধারিতে পাহাড় দেখতে যে কি সুন্দর, রাতের বেলা তা যে না দেখেছে, তাকে বোঝানো বেশ কষ্টসাধ্য। আকাশে মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়লেও, সব কেমন যেন পরিষ্কার। মাসুদ রানা বইয়ে পড়েছিলাম, অন্ধকারে প্রথমে এক চোখ খুলে আর এক চোখ বন্ধ করে রেখে কিছুক্ষণ পর বন্ধ চোখ খুলেই সব পরিষ্কার দেখতে লাগলাম। কিছুই দেখতে পেলাম না। আমার চলাচল শুনে ফ্রেডিরও ঘুম ভেঙে গেল, ওর হাতের মাউন্টেন ক্লাইম্বিং ঘড়ি দেখে বলল, ভোর প্রায় আসন্ন, ৪৫ মিনিট পরেই ওই দিক থেকে সূর্য উঠবে। সে বলল. তাঁবু থাকুক, চলুন সূর্য উদয় অবলোকন করে আসি। বললাম, চল।
প্রায় ৬০০ গজ উপরে পাহাড়ের ওই ছোট্ট চূড়া থেকেই দেখা যাবে সূর্যোদয়। তড়িঘড়ি কাপড় পরেই বেরিয়ে পড়লাম। ওপরে উঠতে লেগে গেল ৩৫ মিনিট, সে এক কঠিন সরু মেঠো পাহাড়ি ট্র্যাক, আধো আলো আধো আঁধার, বন্ধুর সেই পথ, অনেক কষ্টে উঠলাম। কী অপূর্ব সে দৃশ্য! মনে পড়ে গেল, সেই ছোট বেলা আবার সঙ্গে সিলেটের লাঠি টিলা ইপিআর বিওপি থেকে সকালে ভারতের ওই পাস থেকে সূর্যটি পাহাড়ের গা ঘেঁষে উঠত লাল একটি অগ্নিগোলকের মতো। হারিয়ে গেলাম সেই স্মৃতির অতল গর্ভে। কয়েক মাইল দূরে লেক বারচেজের ওপর দিয়ে একটা গ্যাস বেলুনের মতো সূর্য আস্তে আস্তে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠে আসছে যেন; সে কি অপূর্ব-সবুজ লেকের পানিতে লাল সূর্যের আলোর বিকিরণ সবুজ এবং লালের সংমিশ্রণ প্রতিফলিত হচ্ছে প্রিজমের মতো। ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে দুলছে মৃদু; জ্যাকেটের পকেটে হাত দিয়ে দেখি তাড়াহুড়ায় ফোন, ক্যামেরা, ভিডিও সব-ই ফেলে এসেছি তাঁবুতে। ইস্‌, এত সুন্দর একটা ক্ষণের ছবিগুলো সেলুলয়েডে ধরে রাখতে পারলাম না।
এসব করতে করতে সূর্যি মামা চোখের নিমেষেই প্রজ্বলিত হয়ে উঠল পূর্ব দিগন্তে। কুয়াশায় ভিজে যাওয়া ঘাসের পাতার চূড়ায় সূর্যের আলোর বিকিরণ জমে থাকা শিশিরের বলয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে প্রিজমের মতো। নেই কোনো কোলাহল, প্রকৃতি তার আপন আঙিনায় নিস্তব্ধ ও আড়মোড়া ভেঙে যেন রাতের বিছানার চাদরটি সরিয়ে জেগে উঠছে নিত্যনৈমিত্তিক কর্মকাণ্ড শুরু করার জন্য। আস্তে আস্তে অতি সন্তর্পণে এক পা দু পা করে নিচে নামতে লাগলাম। পায়ে বুট ছিল না, এডিডাস ট্রেইনার হটাৎ পিছলে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেডি ধরার আগেই নিচে নেমে গেলাম কয়েক ফুট, তাকিয়ে দেখি আমি ওর থেকে ২০-৩০ ফুট নিচে দুই তিনটা ওলট-পালট খেয়ে একটা গর্তে শুয়ে আছি। মাথার হ্যাট নেই, পাহাড়ে ওঠার লাঠিও নেই, বাম হাতে কনুইয়ের পাশে বেশ বড় একটা ক্ষত। বাম পায়ের গোড়ালি মনে হলো মচকে গেছে।
আমার নামতে সময় লেগেছে মনে হয় কয়েক সেকেন্ড, আর ওখান থেকে উঠে দাঁড়াতে সময় লাগছে কয়েক মিনিট। ফ্রেডি নেমে আসল বেশ কসরত করে, তাকিয়ে দেখলাম। এ যাত্রায় জমের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি কপালের গুনে। তা না হলে বড় একটা দুর্ঘটনা হয়ে যেত পারত। সব ঘটে গেল কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে। উঠে দাঁড়াতে বেশ কষ্ট হল। চারদিকে তাকিয়ে খুঁজতে লাগলাম লাঠি আর হ্যাটটি। চোখ বুজে কয়েক মুহূর্ত নিজেকে বললাম, ব্রেনে মেসেজ পাঠানোর জন্য, ইমরান তোমার কোনো ব্যথা নেই, কোনো ব্যথা নেই, কোনো ব্যথা নাই। এক মিনিটে ৫৫ বার বললাম এবং তারপর হাঁটতে লাগলাম। ব্যথা কম অনুভূত হতে লাগল যেন।
ইতিমধ্যে ফ্রেডি এসে হাজির আমার পাশে। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তাঁবুর বেজ ক্যাম্পে নেমে আসলাম। ট্রেইনার খুলে একটু রেস্ট নিলাম, ইতিমধ্যে ফ্রেডি তাঁবু গুটিয়ে ফেলল সবকিছু র‍্যাকস্যাকে ঢুকিয়ে ফেলল। সে ব্যাগ থেকে একটি স্প্রে বের করে গোঁড়ালিতে স্প্রে করে দিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ব্যথা বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। কাঁধে ৮০ পাউন্ড ওজন নিয়ে পাহাড় বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম। আধা পথে এসে রোপ ক্যারেজ ওয়ে দিয়ে নেমে আসলাম। গাড়িতে সবকিছু রেখে একটা গরুর খামারের গরুর দুধের বানানো পনির এবং দুধের ক্রিম চা ও গরুর মাংসের সঙ্গে বানানো পনির স্কিলেট দিয়ে প্রাতরাশ সেরে গাড়িতে চেপে বসলাম। ততক্ষণে পায়ের ব্যথা কম ও হাতের রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেছে।
ফ্রেডির পোরসে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দ্রুতগতিতে সকাল সর্বসাকল্যে কেবল ৭-৪৫, রাস্তায় লেক বারচেজে থামলাম, কোভোলো পাহাড়ের এবং সংলগ্ন সব পাহাড়ের নিঃসৃত জলরাশি জমে জমেই সৃষ্টি করেছে এই বিশাল লেকের। সেটির পাস দিয়েই আগের আমলের পাহাড় খুঁড়ে সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে ওল্ড রোড দেখলাম। কি বিশাল কাজ, কি ওদের প্রকৌশলীদের মেধা-আর শ্রমিকদের সাহস! হাতুড়ি, কোদাল, বেলচা, শাবল দিয়ে খুড়ে খুড়ে বানিয়েছে প্রায় ৫ মাইল দীর্ঘ সুড়ঙ্গ পথ। এক পাশে পাহাড়ের ছাদ আর দেয়াল, আর অন্য পাশে তিন হাজার ফুট বিশাল পাহাড়ের খাদ। বিশাল সেই খাদের দিকে তাকালেই গা শিউরে উঠে।

ওই ভ্যালি বা ক্যানিওনের মধ্যেই জন্ম নিয়েছে ইতালির অন্যতম প্রধান নদী, যা পারদোনোনা হয়ে কিছু জায়গা শুকিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও প্রবাহিত হয়েছে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে। লেকের পাড়েই মাছের পোনা ঘুর ঘুর করছে ঝাঁকে ঝাঁকে; কেউ কণিজাল বা বড়শি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না ওই সব বালি মাছ জাতীয় মাছগুলোকে। পাহাড়ের বিশাল গহ্বরের ওপর দিয়ে দুটি পাহাড়কে জোড়া লাগিয়েছে একটা দড়ির ঝুলন্ত ব্রিজ দিয়ে সেই ২ হাজার ফুট ওপরে এবং এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের মধ্যে তফাত ২৫০-৩০০ ফুট। ওই ঝুলন্ত ব্রিজটি পার হলাম একা একা হেঁটে হেঁটে কোমরে সেফটি বেল্ট বেঁধে আর বেল্টের শেষে ক্লিপগুলো দঁড়িতে লাগিয়ে, যাতে পা পিছলে পরে গেলেও একেবারে দুই হাজার ফুট নিচে না পড়ে যায় কেউ। হাজার হাজার পর্যটক চারদিকে, কেউ এসেছে গাড়ি নিয়ে, কেউ কেউ এসেছে হেঁটে হেঁটে। তারা ইতালিতে হেঁটেই ভ্রমণ করবে ৬-৭ সপ্তাহ। এসেছে ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স বা রাশিয়া থেকে, কেউ বা এখানেই তাঁবুতে কিংবা মোটর হোমে থাকবে কয়েক সপ্তাহ। আবার অন্যরা এসেছে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে কোচে করে। গরম যত বৃদ্ধি পাচ্ছে, পরিধেয় কাপড়ও তত সংকীর্ণ হচ্ছে। কেউ কারওর দিকে তাকাবার সময় নেই। ঘাসের মধ্যেই প্রেমিক-প্রেমিকারা বিকিনি এবং হাফ পেন্ট পরে কড়া রোদে শরীরের চামড়া ঝলসানোর জন্য শুয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

>সাইকেলের পেছনে বেয়ারিংয়ের গাড়ির মতো ট্রেইলারে শিশু সন্তানকে বসিয়ে মা বা বাবা দিব্যি সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকে লোকারণ্য, আগস্ট মাসে ইউরোপজুড়ে চলে বার্ষিক ছুটির মাস, এ মাসে বাচ্চাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকে। হোটেল, মোটেল, বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট, হোস্টেল কোথাও কোনো জায়গা পাওয়া দুষ্কর হয়। সারা দিন ঘুরে বেড়ায় সব পর্যটক, আর রাতের বেলা সবাই ভালো দামি কাপড়চোপড় পরে শহরে বেরিয়ে পড়ে।


সাইকেলের পেছনে বেয়ারিংয়ের গাড়ির মতো ট্রেইলারে শিশু সন্তানকে বসিয়ে মা বা বাবা দিব্যি সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। লোকে লোকারণ্য, আগস্ট মাসে ইউরোপজুড়ে চলে বার্ষিক ছুটির মাস, এ মাসে বাচ্চাদের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব ৬ থেকে ১২ সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকে। হোটেল, মোটেল, বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট, হোস্টেল কোথাও কোনো জায়গা পাওয়া দুষ্কর হয়। সারা দিন ঘুরে বেড়ায় সব পর্যটক, আর রাতের বেলা সবাই ভালো দামি কাপড়চোপড় পরে শহরে বেরিয়ে পড়ে। সবাই রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে, বার বা পাব-এ যাবে মদ্যপান ও অন্যদের সঙ্গে সামাজিক আড্ডা মারা এবং গান শুনবে, ডার্ট খেলবে বা কারাওকিতে গান গাবে আর বিয়ার, ওয়াইন বা স্পিরিট পান করবে। আর তরুণ-তরুণীরা দল বেঁধে শহরের ডিসকোতে নেচে গেয়ে মদ্যপান করে সেই গভীর রাতে যার যার ঘুমানোর স্থানে ফিরে যাবে। আবার সকালে শুরু করবে তাদের ভ্রমণ কার্যক্রম। এক অদ্ভুত সংস্কৃতি আমাদের কাছে হয়তো মনে হয় বা হবে।
এই আগস্টের জন্য চাতক পাখির মতো অধীর আগ্রহে বসে থাকে ইউরোপের সব ভ্রমণপিপাসু মানুষ। প্রসিদ্ধ বা নৈসর্গিক স্থানগুলো এবং সমুদ্র সৈকতগুলোতে বছরে এক দশমিক চার বিলিয়ন পর্যটক এই মহাদেশে পর্যটনে বের হয়। একেক পরিবার কম করে হলেও তিন থেকে ছয় পাউন্ড ব্যয় করে এ সময়ে। মনে হয় গোটা ইউরোপে বসেছে এক বিরাট মিনা বাজার। বার্ষিক এই হলি ডে কালচার সম্পূর্ণ ইউরোপের জন্য এক মিলনমেলা। ইস্‌, শুধু যদি এ রকম একটা কিছু করা যেত আমাদের দেশে, বাচ্চাদের স্কুল ছুটির সময়; তবে আমাদের মতো দেশ অনেক লাভবান হতো। যদিও বর্তমানে দেশের ভেতরে ও বাইরে ভ্রমণপিপাসু মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এসব অসংলগ্ন অনেক হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে কখন যে ইতালির অন্যতম ইউনেস্কো অনুমোদিত হেরিটেজ (ঐতিহ্য) নগর অ্যাঁকিলাতে এসে পড়লাম, খেয়ালই করিনি। বন্ধু ফ্রেডি বলল, চলেন হুজুর আমরা পৌঁছে গেছি আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে। রোমান আমলের এক বিশাল সমুদ্র বন্দর ছিল এই শহরটি। আজ যা আছে তার অর্ধেকই পুরাকীর্তি এবং পুনঃখনন করে আবিষ্কৃত নমুনা।