চিঠি

চিঠি
চিঠি

কর্মসূত্রে বরিশালে ছিলাম অনেক দিন। মোটামুটি তিন বছর। অমৃতলাল দে কলেজের সামনে সেই গলি। সুমন স্যারের মেসবাড়ি। মেসবাড়ির সামনে সরু ড্রেন। আরও অনেক কিছু আবছা মনে আছে। স্মৃতি হাতড়ালে শুধু ফারহার স্মৃতিটা আস্তই পাওয়া যাবে।তখন কেবল অফিসে জয়েন করেছি। আষাঢ়ের এক বিকেল। দুপুর থেকে বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যা নেমেছে আগে আগে। অফিস থেকে ফিরে কেবল কাপড় ছাড়ছি, রুমমেট ফাহিম ভাই একটা চিঠি ধরিয়ে দিলেন।
চিঠির প্রেরিকা ফারহা
প্রাপক: রুবেলের আব্বা, ১৩/১ গৌতম লেন, বরিশাল।

রুবেলের আব্বা’ নামটা কেটে পরে আবার লেখা হয়েছে জুবায়ের। প্রেরিকা মেয়েটার হাতের লেখা দেখলেই বোঝা যায়, সে দায়ে পড়ে চিঠি লিখেছে। শখ করে না। ‘ফারহা’ লিখতে গিয়েও একবার কাটতে হয়েছে। ‘হ’-এর চেয়ে আকারের দৈর্ঘ্য বেশি দেখলেই বোঝা যায়, এ চিঠির প্রাপক আমি নই। ফারহা নামে আমার কোনো ‘স্ত্রী’ নেই। রুবেলের বাবা হওয়া তো দুরস্ত।ফাহিম ভাই বারান্দায় লুঙ্গি মেলতে মেলতে বললেন, ‘ভাবির চিঠি মনে হয়, জুবায়ের ভাই, দেখেন।’আমি কিছু বললাম না। খামটা খুললাম। অতি সংক্ষিপ্ত চিঠি। হিজিবিজি ভাঙাচোরা লেখায় পুরো পৃষ্ঠাটা একটা ওয়াটার ল্যুর ময়দান। তবে সারমর্ম হলো, রুবেলের জ্বর। বাজারের নেহাল ডাক্তার একটা বিশেষ শর্তে ওষুধ দিতে রাজি হয়েছে। শর্তটা ভীষণ কঠিন। গত মাসের ঝড়ে রান্নাঘরটা পড়ে গেছে। ঘরের চালে ফুটো। আপনার নামটা (স্বামীর নাম) ভুলে গেছিলাম। পাশের মুদি দোকানি সালামের কাছ থেকে শুনতে হলো।এই সম্ভাষণ আর ‘ইতি’ ছাড়া চিঠিটা পড়ে মনটা কেন জানি ভীষণ খারাপ হলো। মেয়েটা তার স্বামীর নাম ‘রুবেলের আব্বা’ নামেই জানত। এই গ্রাম্য স্বল্পশিক্ষিতা বধূটি তার স্বামীর ঠিকানাটাও ঠিকভাবে লিখতে পারেনি। নাম অনেক দূরের ব্যাপার।আমি চিঠিটা মজার একটা স্মৃতি হিসেবে আমার ডায়েরির ভেতরে রেখে দিলাম। ঠিক পরের মাসে আবার দুটো চিঠি এসে হাজির।এবার চিঠির বিষয়বস্তু হলো, ফারহার তলপেটে চুলকানি মতো হয়েছে। শহরের ডাক্তারকে বলে ভালো একটা ওষুধ আনতে পারলে যেন আনা হয়। নেহাল ডাক্তার বলেছে, তাকে তার স্বামীর কাছে নিয়ে যাবে। সে রাজি কিন্তু স্বামীর অনুমতি না পেলে সে কীভাবে যাবে? স্বামীর জন্য তার মন টানে। কারণ, আশপাশের মানুষজন তাকে বলেছে, শহর থেকে কোনো মানুষ আর গ্রামে ফিরে যায় না।আমি এই পল্লিবালার দুঃখগুলো নিকোটিনের ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিলাম। কারণ, এ ছাড়া আমার আর উপায় ছিল না।কারণ, প্রেরিকার ঠিকানার ঘরটা ছিল ফাঁকা। আমি তাকে কীভাবে লিখে জানাব তারপর দীর্ঘ এক বছর কোনো চিঠি আসেনি। আমার ক্ষুদ্র জীবনে কাঁচা হাতের লেখা সেই চিঠিগুলো সেই সময় অনেক শূন্যস্থান পূরণ করেছিল। পুরো একটা বছর যখন কোনো চিঠি এল না, তখন আমি ধরেই নিলাম ফারহা মেয়েটার স্বামী নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরেছে এত দিনে। আর স্ত্রীর ছেলেমানুষি ভুল দেখে হেসেই কুটিকুটি হয়েছে। রুবেলকে কোলে নিয়েছে।আমার ধারণা ভুল ছিল।এক বছর পর ফারহার চতুর্থ চিঠিটা আসে।রুবেল মারা গেছে। ফারহার আর ভালো লাগছে না। তলপেটের চুলকানিটা হাতেও সংক্রমিত হওয়ায় রান্নাবান্না মোটামুটি বন্ধ। নেহাল ডাক্তার ওষুধ দিতে পারেনি। কিন্তু সে ফারহাকে তার স্বামীর কাছে পৌঁছে দেবে। ফারহা আবার লেখাপড়া শিখতে চায়। ক্লাস ওয়ান পাস বিদ্যে নিয়ে সে আর থাকতে চাচ্ছে না।চিঠির শেষে ফারহা বারবার জানতে চেয়েছে, তার স্বামী দ্বিতীয় কোনো বিয়ে করে তাকে ভুলে গেছে কি না। সে এই ঠিকানায় লিখতেই থাকবে, যত দিন না সে চিঠির উত্তর পাবে।আশ্চর্য! এই মেয়েটার মাথায় একবারও তার স্বামীর মৃত্যুভাবনা উদয় হয়নি।২০১১ সালে আমি কুষ্টিয়ায় বদলি হই।আমার জীবনে অবিবাহিত এবং ফারহা-অধ্যায়ের সমাপ্তি সেখানেই।

কুষ্টিয়া