স্বপনের মল্লিকা তবু ফোটে

রোমেনা লেইস
-না না না। কোনোভাবেই হবে না।
-কেন?
-না। সম্ভব না।
-কেন
-আমি কেন–এর উত্তর জানি না। তুই আমার কাজিন। তুই আমার ওপর ক্রাশ খাইছিস? আমিতো তোকে ভাই জানি।
আমাকে দেয়ালের সঙ্গে ঠেলে ধরে বলে
-তুই কচু জানিস! তোকে নিয়ে কতো কী স্বপ্ন আমার!
-আমার জানার দরকার নাই। তুই যা।
-আমি যাব না।
বড় আপার ছেলে মিঠুটা এক বছর বয়সের। কাজের ছেলে মফিজের সঙ্গে খেলছিল।
-এই, তুমি এই টাকা নিয়ে নিচে যাও। লালমিয়ার দোকান থেকে দুটো মোরগপোলাও নিয়ে আসো। মিঠু আপনমনে খেলছে গাড়ি দিয়ে। আমি নখ খুঁটতে খুঁটতে উঠে দাঁড়িয়ে বলি
-তুই যা এখন। আমি রান্না করব।
-খাবার আনতে পাঠালাম তো। বলে আচমকা আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। আমার হার্টবিট জোরে থেকে আরও জোরে হচ্ছে। আমার কাঁধে দুহাতে খামচে ধরে বলল—
-আমি তোকে ভালোবাসি বোকা। ভালোবাসলে কি কাউকে ফিরিয়ে দিতে হয়? বলে আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। তারপর বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে, এই বুকের গভীরে যতটুকু ভালোবাসা সব শুধু তোর জন্য পাগলি। আমাকে ফিরিয়ে দিস না শূন্য হাতে। সে যখন আবার মুখ নামিয়ে আমার ঠোঁটের একদম কাছে, তখন আমি ঝট করে সরে গেলাম। ওড়না টেনে টুনে ঠিক করে বললাম
–এখন যা। কখন আপা ফিরে আসে কে জানে!
সাদা পোলো টিশার্ট আর জিন্স পরা এই ছেলেকে আমার খারাপ লাগে না। সে আমার খালাতো ভাই। আমরা ইয়ারমেট। এখন সে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি পড়ি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাত্র কয়েক দিন আগেই আমার বান্ধবীর ইঞ্জিনিয়ার মামার জন্য ওর মা হীরার আংটি নিয়ে আমার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আমার আম্মা না বলে দিয়েছেন। আর এই ছেলে ইতিহাসে পড়ে আর ফুটবল খেলে ঢাকা ফার্স্ট ডিভিশনে। আর যাই হোক, যেখানে ইঞ্জিনিয়ার বাতিল, এর তো কোনো চান্স–ই নাই।
কিন্তু আমার বুকের ভেতর কী একটা ওলটপালট যেন হচ্ছে। কী এক শিহরণ! দুই কাঁধে তার ছোঁয়া আর আগুনের হলকার মতো ছ্যাঁকা লাগা কপাল–গাল–থুতনি। আমি কিছু ভাবতে পারি না। এমন সময় কলিং বেল বাজতেই আমার নিশ্বাস–প্রশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে। আবার আসল নাকি!
-কে?
বড় আপার ক্লান্ত গলা
-খোল, আমি।
বড় আপার স্বামী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ছাত্র রাজনীতি আর খুনি রাজার বিরুদ্ধে কবিতা লেখার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আজ ছয় দিন। আপা আজ উপাচার্য স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
-কোনো খবর আছে?
-হ্যাঁ, স্যারের সঙ্গে কথা হলো। স্যার বললেন এক উকিলের সঙ্গে দেখা করতে। শনিবার জামিন হয়ে যাবে।
-রান্না হয়ে গেছে?
-হুঁ। খেয়ে রেস্ট নাও। মোরগপোলাও খাবা?
-মোরগপোলাও কে আনল?
-তোমার খালাতো ভাই।
-তাই? আমার খালাতো ভাই তোর কে? ওকে তো দেখলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছে। দুনিয়াদারির কোনো খেয়াল নাই। খুব মন মরা উদাস।
-কী জানি!
তখনই বলে দিলাম বড়বোনকে
-তোমার খালাতো ভাই আমার ওপর ক্রাশ খাইছে। কঠিন ক্রাশ। আমাকে ছাড়া নাকি বাঁচবে না।
-তাইতো বলি এমন উদাস হয়ে সিগারেট টানছে কেন। আহা, তা তুই কী বললি?
-আমি না বলেছি। বলেছি কোনোভাবেই সম্ভব না।
-অহহহ।
হলের খাবার খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে। খালাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম
-আজ কী রান্না করেছ খালা?
-ইলিশ মাছ আর গরুর মাংস। আসবি?
-হ্যাঁ আসছি।
হল থেকে খালার আজিমপুর চায়না বিল্ডিংয়ের বাসার গলিতে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খালাতো বোনের সঙ্গে।
মুক্তা যেমন শুক্তির বুকে
তেমনি আমাতে তুমি
আমার পরানে প্রেমের বিন্দু
তুমি শুধু তুমি।’
কে গায়? চমকে উঠলাম। তারপর পুরো শরীর মনে হলো অবশ হয়ে আসছে। এত কাজিন ব্রাদার। গানখানাত আমাকে উদ্দেশ্য করে গাইছে। হায় আল্লা। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ। কাউকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না।
স্বাভাবিকভাবে হাত–মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গেলাম। খালা চা বানাবে। খালাকে বলি
-তুমি যাও। গান শোন। আমি আসছি চা নিয়ে।
‘স্বপনের মল্লিকা আজ
তোমায় দিলাম
কবে যে ফুটবে এ ফুল
আশায় ছিলাম আশায় ছিলাম।’
এত আমার বুকে প্রেমের বান ডাকিয়ে দিল। কী জ্বালা! আমি আজ আসলাম। ওর কেন আজ আসতে হবে? চা নিয়ে এসে বসলাম লিভিং রুমের এক পাশে। ওর চোখে যাতে চোখ না পড়ে, সে জন্য উল্টো দিকে ঘুরে।
‘বলে ছিলে তাই চিঠি লিখে যাই
কথা আর সুরে সুরে।
মন বলে তুমি রয়েছ যে কাছে’
গানের কথা আর সুরের টানে টানে সেতো আমার বুকে বাণ মারছে। ও হ্যাঁ, কাজিন ব্রাদার আবার গান করে জটিল। ছেলেবেলায় শুনেছি নজরুল গীতি আর দেশাত্মবোধক গান করত।
এখনতো বেছে বেছে হেমন্ত, শচীন কর্তা আর জগন্ময় মিত্রের গান করছে। আজ কী এ বাসায় থাকব? নাকি চলে যাব হলে? ঘড়িতে চোখ যেতেই দেখি হলের গেট বন্ধ হয়ে গেছে। খালার আশপাশে থাকার চেষ্টা করছি। খালা আর খালু এ সময় আবার খালাতো বোনটিকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে গেলেন। ডেন্টিস্ট। আমি মহা ফাঁপরে পড়লাম। সে আমার সামনে বসল। বলল
-ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হলেই কী শুধু মানুষ ভালবাসে? আমার ভালোবাসা নিখাদ। আমি নিজেকে সব ত্রুটি খুঁত মিটিয়ে একদম তোর যোগ্য করে তুলব। শুধু একবার বল হ্যাঁ।
-এত জোর করিস না। আমি প্রস্তুত না। আমি কখনো ভাবিনি তুই এমন কথা বলতে পারিস! আমার পক্ষে এটা মানা সহজ না। আমি ছোট এক বছরের বেবী বোনকে নিয়ে সিরিয়াল খাওয়াতে থাকি।
পরদিন আমি হলে যাওয়ার জন্য রিকশা নিলাম। চায়না বিল্ডিংয়ের মোড়ে এসে দেখি মোটরসাইকেল নিয়ে কাজিন দাঁড়িয়ে আছে। রিকশার পাশে পাশে মোটরসাইকেল চালিয়ে হলের গেটে যখন নামলাম তখনো দেখি দাঁড়িয়ে। আমি ভেতরে যাব যখন, তখন আবার বলল
-আই লাভ ইউ।
আমি চোখ কটমট করে একটা লুক দিয়ে ভেতরে চলে গেলাম।
অনেক দিন আর আজিমপুর যাইনি। বড় আপার বাসায়ও যাইনি। খালাকে ফোন করলাম কয়েনবক্স থেকে।
-কীরে আসিস না যে? এক্ষুনি আয়। জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না, আর কেউ আছে কি না! রিকশা থামল। মোটরসাইকেল নজরে আসল না। স্বস্তি নিয়ে ঢুকলাম। কলিং বেল চাপ দিয়ে নিশ্চিন্তে দরজায় তাকাতেই দেখি দরজা খুলল সে।
-কি রে কেমন আছিস?
-হুম ভালো।
-মোটরসাইকেল কই?
-বেচে দিয়েছি।
-ওহ কেন?
-বাড়ি যাচ্ছি। সিজন শেষ।
-ওহ।
বুকে আবার ড্রাম বাজতে শুরু করল। বুঝি না। আগে তো এমন হয়নি। খালার বাসায় আসলে আমাদের দাবা খেলা হয়। প্রতিবার কীভাবে যেন আমি জিতে যাই। একসময় আমার মনে হয়, সে যেন ইচ্ছে করেই হেরে যায়। হেরে গিয়ে কী সুখ? ও আসলে আমাকে জিতিয়ে দিয়ে সুখ পেতে চায়, নাকি আমাকে খুশি করতে চায়। আমি ওর ছায়া আর নিজের ওপর পড়তে দিতে চাই না। তাই আপার বাসায় চলে যাই।
বাইরে থেকে ফিরে আপার বর বলেন
-তোমার আরমানকে দেখলাম লাইট পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছে। ঘটনা কী? একটা মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান কথা। কেন মিছেমিছি মানুষের মনে কষ্ট দিচ্ছ?
-বারে, আমি কী করব? সে আমার খালাতো ভাই। আমরা তুই–তুকারি করি। ও কীভাবে আমার প্রেমে পড়ে। যাক জাহান্নামে।
আমি চলে গেলাম গ্রামের বাড়ি। দুই মাস কোনো যোগাযোগ নেই। আমার ট্রেনের জানালা গলে পূর্ণিমার আলো। ঝকমক করছে বাইরের অতিপ্রাকৃত রাত। ভোরের আলো ফুটে উঠেছে কিছুক্ষণ আগে। কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন থামলে একটা বেবিট্যাক্সি নিয়ে আমি খালার বাসায় আসলাম।
অল্প কিছুক্ষণ পর কলিং বেল বাজলে
-খালা আমি খুলে দিচ্ছি বলে দরজা খুলে আমি ভূত দেখার চেয়েও চমকে উঠলাম। এও কী সম্ভব? পাক্কা দুই মাস। কোনো যোগাযোগ নেই। আজ আমি ঢাকায় এসেছি, আর সেও আসল! জীবনে ‘নিয়তি’ ‘ভবিতব্য’ এগুলো মানতে চাইনি কখনো। কিন্তু এই এক ক্ষেত্রে আমি পরাজিত। হ্যাঁ, যুবকের বারবার প্রেমের প্রস্তাব নাকচ করার মতো মনোবল আমি হারিয়ে ফেললাম। আসলে ‘না’ বলার দিন থেকেই প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আমি তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি।
খালা বাড়ি বদল করে আজিমপুর ছেড়ে মিরপুর চলে যাচ্ছেন। আমরা বাঁধাবাঁধিতে সহায়তা করছি। আমাদের ঝগড়া হচ্ছে। খুনসুটি হচ্ছে। খালু বলছেন গান করতে। সে গান করছে—
‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন করে
জেনেছি আমি,
পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই।’
‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি
আমায় আর কান্নার ভয় দেখিয়ে
বলো লাভ কী...’
আবার আমার ভেতরে উথাল–পাথাল কী যেন হয়। এরই ভেতর সে একদিন মিরপুর স্টেডিয়ামে খেলতে গেছে। আরামবাগ বনাম মোহামেডানের খেলা। আমি খালার বাসায় এসেছি সকালে। ছাদে পায়চারি করছিলাম। হঠাৎই খেয়াল করলাম গন্ডগোল হচ্ছে। টেলিভিশনের সামনে এসে দেখি ধারা ভাষ্যকার বলছেন,
‘এক গোলে আরামবাগ জিতে গেছে আর তাই মাঠে আর চারপাশে হট্টগোল শুরু হয়েছে। মোহামেডান আর আরামবাগের সমর্থকদের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা–ধাওয়া চলছে।’
আমি আমার মনকে শাসন করছি। আরামবাগ জিতলে আমার তো রাগ হওয়ার কথা। আমি মোহামেডানের সমর্থক। তবে আমি এত খুশি হচ্ছি কেন? আমি নিজেকে বুঝাই। যুক্তি দিয়ে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে বের হয়ে যাব। আর কাজিন ব্রাদার এখনো অনার্স ফাইনাল দেননি। প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার সময় খেলা থাকে। খেলার কন্ট্রাক্টে সই করে টাকা নেওয়া হয়েছে আগেই। তাই পরীক্ষা দিতে রাজশাহী যেতে পারেনি।
কী যে হবে! এমনও কী প্রেম হয়!!!