ভালোবাসার নানা রূপ

প্লেটো: ‘ভালো জিনিস ও সুখের প্রতি কোনো সাধারণ আকাঙ্ক্ষা, সেটাই প্রেম।’
টলস্টয়: ‘ভালোবাসা সর্বদা ব্যক্তিগত সম্পত্তি ত্যাগের ওপর ভিত্তি করে।’
স্পিনোজা: ‘প্রেম একটি বাহ্যিক কারণের সঙ্গে আনন্দ ছাড়া কিছুই নয়।’
অধ্যাত্মবাদ: ‘ভালোবাসা একতরফা এবং সেটা তোমার নিজের মধ্যে, অন্য কোথাও না।’
এভাবে ভালোবাসা নিয়ে আছে অসংখ্য মতবাদ। ভালোবাসা মানে পরিপূর্ণতা, ভালোবাসা মানে অসম্পূর্ণতা। ভালোবাসা পেলে পূর্ণতা মেলে। ভালোবাসার অভাব থাকলে বোঝা যায়, ভালোবাসা কী? এ ভালোবাসার অভাবে মানুষ জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়। তবে কি ভয়ংকর ভালোবাসা? বেশির ভাগ মানুষেরই কথা ভালোবাসার মানুষকে না পেলে তা ঘৃণায় পরিণত হয়। কথিত আছে ‘ভালোবাসার উল্টো পিঠে ঘৃণা’। আসলেই কি তাই? এখন কথা হলো, না পেলে কি ভালোবাসা থাকবে না? যার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারি, তাকে ঘৃণা করতে হবে? নাকি ভালোবাসা মানে কেবলই লেনাদেনা?
খাঁটি প্রেম কী? যে অনুভূতি সব প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি ভুলিয়ে দেয়। যেমন এক যুবরাজকে প্রেম বাধ্য করে রাজসিংহাসন ছেড়ে পথে নেমে যেতে। দেখা যায় না, তবু এক মিষ্টি অনুভবের নাম ভালোবাসা। সৃষ্টিকর্তা বলে যে একজন আছেন, তাঁকেও দেখা যায় না। কিন্তু তাঁর প্রতিও বিনা ভয়ে মানুষের অসীম প্রেম আছে। সে শুধু অনুভব। তেমনি মানবপ্রেমও অনুভবের বিষয়, বলার না। মুখে ভালোবাসি বললেও অনেক সময় ভালোবাসা হয়তো থাকে না। যখন প্রেম সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে যায়, তখন তা অনুভব যেমন করা যায়, তেমনি দেখাও যায়। যায় না? দেখা না গেলেই তো শুরু হয় ভালোবাসার টানাপোড়ন। আমরা প্রিয় মানুষটার চোখে সব সময় প্রেম দেখতে চাই।
আমি তোমাকে ভালোবাসি—মানে আমি তোমার জন্য মনের মধ্যে এক ধরনের মিষ্টতা অনুভব করছি। সেই মিষ্টতা–মধুরতা শুধুই আমার ভেতরের সৌন্দর্যবোধ। তুমি হচ্ছো স্টিমুলাস বা উদ্দীপক, কারণ যাই বলি না কেন। সেই তুমিটা হতে পারে একজন মানব বা অন্য কিছু। যেমন সূর্য, সাগর, আকাশ, চাঁদ কত কী? এগুলোকেও অনেকে গভীরভাবে ভালোবাসে। বিচিত্র এই পৃথিবীতে সাপের প্রেমে পড়েছে এমন মানুষও আছে।
তারপরও মন বলে হায়, ভালোবাসা কি?
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’—এই কথাটির মানে হলো আমি ভালোবাসি, কিন্তু তুমি? তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না তা অজানা বা আদৌ জানি না। মুখে বললেও সেখানে সত্য কতটুকু, তা শুধু সে হৃদয় জানে আর জানেন বিধাতা। সেই তুমি ভালোবাস কিনা তা মুখ্য না হওয়ারই কথা। আমি প্রেমে পড়েছি। এখানে আরেকজন পড়েছে কী উঠেছে—তার কিছুই হয়তো ‘আমি জানি না’। তবে যখন দুজন মানুষের চাহিদা এক হয়, কাছাকাছি আসে, একজনের মন আরেক জনকে চায়—তখন দুজনই প্রেমে পড়ে। দুজন মানুষ এক হয়। এক সময় তা মন থেকে শরীরেও ছড়িয়ে পড়ে। সেই চাওয়ার সমাপ্তি ঘটে শরীরের রসায়নে। এ জন্য বলা হয় মনেপ্রাণে তোমাকেই চাই। এ চাওয়া–পাওয়ার মাঝেই দুজন মানুষের দেহমনে ভালোবাসা পরিপূর্ণতা পায়। তবে শুধু শারীরিক টান বা কাম কখনোই প্রেম নয়।

>আধ্যাত্মবাদীরা বলেন, তুমি নিজেই ভালোবাসা হয়ে ওঠো। যখন একজন বলল—I am a love full soul তখন সে নিজেই হলো ভালোবাসা। সূর্য যেমন সে যার কাছেই যাচ্ছে, তাঁকেই আলো ছড়াচ্ছে। অনেকটা তেমন। তবে তাই বলে বলছি না, একজন অনেকের সঙ্গে প্রেম করবে। মানুষ নিজে যখন ভালোবাসা হয়ে ওঠে, তখন অন্যজন তাঁকে ভালোবাসল কিনা, এমন দ্বন্দ্বে কখনোই যাবে না।


একজন ব্যক্তি নিজে থেকে প্রেম অনুভব করে অন্যজনের বাহ্যিক মুগ্ধতায় এবং তাঁকে প্রলুব্ধ করে। তাঁকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। যোগ্যতার বিচারে আরেকজন কাছে আসে। সে ক্ষেত্রেও দুজন মানুষের মধ্যে ভালোবাসা হয়, সম্পর্ক হয়। এমন ভালোবাসা কখনো শূন্যতা সৃষ্টি করে। খুব কম ক্ষেত্রে এটাও হয়ে ওঠে গভীর প্রেমের ভিত্তি। ভালোবাসায় শূন্যতা তখনই থাকে, যখন আত্মা একত্রিত হয় না। দুটি আত্মা যখন মনেপ্রাণে এক হওয়ার চেতনায় থাকে, তখন পৃথিবীর অনেক কিছুই গৌণ হয়ে যায়।
ধনাত্মবাদ বলে ভালোবাসা হচ্ছে দুরকম। একটা আত্মা থেকে আত্মা। একটা হচ্ছে ইগো বা অহংবোধ টু ইগো। আত্মা টু আত্মা কথাটা বুঝতে পারবেন যারা অন্যের পালস বুঝতে পারেন। নতুবা বলবেন, কী যা–তা সব বলছেন? এমন প্রেমে হয়তো আত্মা বা ব্যক্তির সঙ্গে কথাও হয় না। কিন্তু তাঁরা একজন আরেকজনের আত্মার টান আপনা-আপনি বুঝতে পারেন। আত্মার টানে যেসব প্রেম, তা কখনোই মরে না। সে বিচ্ছেদে কিংবা সংসারের খুঁটিনাটি হিসাব–নিকাশেও। আত্মার মাঝে যে প্রেম, সে দিন দুনিয়ার হিসাবের বাইরে থাকে। যার সম্পর্ক লেনাদেনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই।
ইগো টু ইগো যে ভালোবাসা, তাতে লেনাদেনার ব্যাপার থাকে প্রকট। হয়তো দামি কোন উপহারের ভিত্তিতে ভালোবাসা মূল্যায়ন হয়। মান–অভিমানের ক্ষেত্রেও থাকে ইগো। অহং। তুমি মাথা না ঝোঁকালে আমি কেন ঝোঁকাবো? তখনই প্রশ্ন ওঠে, তুমি ভালোবাসো কিনা? আমার চিন্তা, শব্দ, আচরণ তা প্রকাশ করতে পারে না। কখনো কখনো আমার শব্দ খুব সুন্দর, আচরণ খুব সুন্দর, ব্যবহার করি সুন্দর। কিন্তু আমি আমার পার্টনার সম্পর্কের ভেতরে ভালো চিন্তা ক্রিয়েট করছি না। এ ক্ষেত্রে ভালোবাসা থাকে কনফ্লিকটের মাঝে, জটিলতার ভেতর। বিয়েতে বেশির ভাগ সফলতার পেছনে প্রেমের চেয়ে থাকে প্রতিপত্তি, যোগ্যতা। যোগ্যতার মাপকাঠি ছাপিয়ে কখনো প্রেম গভীর হয়ে ওঠে, আবার সেখানে হয়তো আদৌ প্রেমের জন্ম হয় না। নতুন অবস্থায় যে মোহ গভীর প্রেম ছিল, তা যেন কর্পূরের মতো উবে যায়। একজন আরেকজনকে বলেন, তুমি আমাকে ভালোবাসছো না। সুখের তরে চলে মনোমালিন্য।

এ জন্য বোধ করি রবি ঠাকুর গেয়েছেন-
তাই কেঁদে কাটে নিশি, তাই দহে প্রাণ
তাই মান–অভিমান, তাই এত হায় হায়
প্রেমে সুখ-দুঃখ ভুলে তবে সুখ পায়
সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায়, এমনই মায়ার ছলনা
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না

এখানে প্রেমের সংজ্ঞা রবি ঠাকুর এক লাইনেই দিয়েছেন, ‘প্রেমে সুখ-দুঃখ ভুলে তবে সুখ পায়।’ দোষ ত্রুটি, সুখ–দুঃখ সবকিছু ভুলে যে সুখ, তাই ভালোবাসা।
ভালোবাসা কখনোই ঘৃণায় পরিণত হয় না, যখন আমরা নিজের মধ্যে ভালোবাসার চাষাবাদ করি। কারণ আমার নিজের মধ্যে যদি ভালোবাসা না থাকে, তবে আমি দেব কী? নিজে যদি অনুভব না করি, তবে কেউ যদি দেয়, তা অনুভবই করব কীভাবে? অন্য একজন ভালোবাসার হাত তখনই গুটিয়ে নেয়, যখন তাঁর মধ্যে আসলে ভালোবাসা থাকে না। সে জায়গাটা দখল করে নেয় পার্থিব সুখ, বিলাসিতা, যোগ্যতা। যা একজনের প্রেমকে ঢেকে দেয় চরম স্বার্থপরতায়। অতি প্রিয় মানুষটির কাছেও নাম পাল্টে যায়। হয় স্বার্থপর! এ জন্যই প্রেম হবে সম্পূর্ণ নির্মোহ।
নিজেকে যদি নিজেই পূর্ণ করা যায়, অভাব চলে যায়। আমার যখন অভাব থাকবে না, তখন আমি পূর্ণ। অভাব থাকে বলেই অন্যের কাছে চাইতে হয়। চাইতে চাইতে ভালোবাসায় মানুষ ভিখারি হয়ে যায়। এমনকি জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়। তবে মনের স্থিতি ঠিক রেখে সঠিকভাবে ভাবতে পারলে বোঝা যায়, কারও চলে যাওয়াতে প্রেমের মৃত্যু হয় না। যার প্রেম তার মাঝেই থাকে। যে গ্রহণ করেনি, সেটি তাঁর ব্যর্থতা। অথচ এই সঠিক ইকুয়েশনটা বুঝতে আমাদের জীবন চলে যায় বিরহ ব্যথায়। মনে হয় প্রাপ্তিতেই প্রেমের বেঁচে থাকা। যদি তাই হয়, তবে কেন যে দম্পতি একদিন ভালোবেসে সংসার শুরু করেছিল, তাঁরা একদিন একই ঘরে দুই ভুবনের দুজন হয়ে যায়?
আধ্যাত্মবাদীরা বলেন, তুমি নিজেই ভালোবাসা হয়ে ওঠো। যখন একজন বলল—I am a love full soul তখন সে নিজেই হলো ভালোবাসা। সূর্য যেমন সে যার কাছেই যাচ্ছে, তাঁকেই আলো ছড়াচ্ছে। অনেকটা তেমন। তবে তাই বলে বলছি না, একজন অনেকের সঙ্গে প্রেম করবে। মানুষ নিজে যখন ভালোবাসা হয়ে ওঠে, তখন অন্যজন তাঁকে ভালোবাসল কিনা, এমন দ্বন্দ্বে কখনোই যাবে না। কারণ, সে নিজেই তাঁর চারিদিক ভালোবাসা বিচ্ছুরিত করবে। সে হোক জীবনসঙ্গী, হোক প্রেমিক বা মা-বাবা সন্তান, ভাইবোন যে কেউ। শুধু সঙ্গী নয়, পৃথিবীর সর্বত্র যে প্রেম ছড়িয়ে দেয়, সেই আসলে ভালোবাসে।
ভালোবাসার সূত্র যেহেতু দুজন মানুষের বন্ধনে, তাই সে বন্ধনের শিকল মাঝে মাঝে চেক করতে হয়, যেন মরিচা না ধরে যায়। এ জন্য সুন্দর সম্পর্কের স্থায়ীত্ব চাইলে দুজন সঙ্গীকেই একে অন্যের লভ্যাংশের কথা ভাবতে হয়। ব্যবসায় যেমন লাভের অঙ্ক সঙ্গীকে দিতে হয়, তেমনি প্রিয় মানুষটিকেও কিছু না কিছু দিয়ে লাভের অংশ বুঝিয়ে দিতে হয়।
আর আত্মা, মন, হৃদয় যখন দুটি এক হয়ে যায়, তখন হয় নিঃশর্ত ভালোবাসা। খেলেও আছি, না খেলেও আছি। দিলেও আছি, না দিলেও আছি। কাছে থাকলেও প্রেম থাকবে, দূরে থাকলেও প্রেম থাকবে। মুখে বলতে হবে না, ভালোবাসি। আচরণই বলবে, এটি ভালোবাসা।