ভালো থেকো ভালোবাসা

ও কিশোর, এই পরিণত বয়সেও যে তোমাকেই মনে পড়ে। পুরান ঢাকার নারিন্দায় আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। সে আমার দুই বিনুনির কিশোরী বেলা। সে বয়সে সব মেয়ে যেমন নিজের প্রেমে ডুবে থাকে, আমিও তাই ছিলাম। মনে হতো চন্দ্র, সূর্য আমাকে কেন্দ্র করেই উদয় হয়, অস্ত যায়। শয়নে-স্বপনে নায়কোচিত দেবপুত্র বা রাজপুত্রের আনাগোনা চলতে থাকে।
ঠিক সে সময় আমারই বয়সী এক কিশোর পাশের বাড়িতে বেড়ে উঠছিল। কিশোর ছেলেরা এই বয়সেই তরুণ হওয়ার ভাবনায় থাকে। সেও তেমন ছিল। পাড়ার লোকের কাছ থেকে ‘বখাটে ছেলে’ খেতাব সে তখনই পেয়ে গিয়েছিল।
সেই বখাটে ছেলেটি একদিন টুপ করে আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসে। ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কোথাকার কোন বখাটে—তার এত সাহস! সে তো মোটেই আমার স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র নয়। সাফ ‘না’ বলে দিলাম। কড়া হুঁশিয়ারি দিলাম যেন, সে আমাকে একদম বিরক্ত না করে। তাতে সে মোটেই পিছিয়ে গেল না। বরং নাছোড়বান্দা হয়ে আমার মন জয় করার নিত্য নতুন কায়দা বের করতে লাগল। তাতে কী? আমার মনের ভাব কিছুতেই বদলাল না। তার চেহারা দেখামাত্র আমার মেজাজ সপ্তমে চড়ে যেত। এভাবেই সময় যেতে থাকে।
তার প্রথম বখাটেপনার নমুনা হলো ক্লাস টেনের মাঝামাঝি এসে স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিল। সে সময় পুরান ঢাকায় সব বাসায় এক-দুটি ফলের গাছ ছিল। এর পর থেকে প্রায়ই শোনা যেত, আজ এর বাড়ির আম, তো কাল অন্য বাড়ির শখের গাছের পেয়ারা বা কুল চুরি গেছে। আর এ সব চুরিই তার নামে রিপোর্ট হতো। সব রকমের দস্যিপনায় তার নাম শোনা যেত। তখন আমরা পাড়ার কয়েকজন মেয়ে মিলে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। প্রেম-ভালোবাসা নিবেদনের মাধ্যমে আমাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নিজের স্কুল কামাই দিয়ে, অতি যত্নের সঙ্গে প্রতি দিনই সে আমার পিছে পিছে স্কুল আসা যাওয়া করেছে। আমরা পাশাপাশি হেঁটে যেতাম। চরম বিরক্তি ও অবহেলা প্রদর্শন করলেও সে ক্ষান্ত হয়নি।
এতটাই সাহসী ছিল যে কখনো কখনো প্রেমপত্র কিংবা কোনো দিন কিছু ফুল আমার স্কুল ব্যাগে ঢুকিয়ে দিত। আমাকে বোকা বানিয়ে সে আমার ব্যাগে তার ভালোবাসার কথা জানান দিত; অনেক সময় টেরই পেতাম না। বাড়ি ফিরে স্কুল ব্যাগ খোলার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারতাম না। তাই পড়তে বসার আগে তার ভালোবাসার চিরকুট পড়তে হতো।
এমনই দস্যিপনায় মগ্ন ছিল যে, রাস্তায় পায়ে-পায়ে বল নিয়ে ঘুরত। একদিন এমন পায়ে-পায়ে বল নিয়ে পিছে পিছে আসছিল। বলটা এক সময় আমার পায়ের কাছে চলে আসে। হয়তো সে ইচ্ছে করেই ছুড়েছে। সে সুযোগে আমার পায়ের কাছাকাছি এসে আমার পায়ের কাছে নুয়ে বল তুলতে গেল। আমি সেই সময়ে বলে লাথি দিতে গিয়ে তাকেও দিয়ে বসলাম। সে বলসহ রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল। আমি তখন রাজ্য জয়ের আনন্দ পেয়েছিলাম।
এসএসসির পর কলেজে ভর্তি হলাম। আমার ভাব-সাব আরও বেড়ে গেল। এবার সত্যি সত্যি বড় হয়ে গেছি। সে আর আমাকে পায় কোথায়! কলেজে ভর্তি হয়ে আমি আকাশে উড়ছি। আমার আর কোনো ছিঁচকে প্রেমিকের ভালোবাসার দরকার নেই। সে বছর রোজা শেষে ঈদ এল। তখন ঈদের দিনটা খুব আনন্দের ছিল। ওই একটা দিন, যা ইচ্ছা তাই করতে পারতাম। সেদিনও পাড়াময় ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দ উৎসব শুরু হয়েছে। হঠাৎ সেই বখাটের বাড়িতে কান্নার রোল উঠল। সবাই হতবাক হয়ে শুনল, সেই পথ আগলে থাকা দুষ্টু প্রেমিক আর নেই।
এখনকার মতো তখনো চাঁদরাতে সব ছেলের দল পাড়া মাথায় করে ঘুরে বেড়াত। ওই চাঁদরাতে সে আরও তিন দুষ্টু বন্ধুসহ বুড়িগঙ্গায় গিয়েছিল নৌকা ভ্রমণে। এক স্টিমার এসে ওদের ছোট নৌকায় ধাক্কা দেয়। তাল সামলাতে না পেরে নৌকা উল্টে যায়। সেই দুর্ঘটনায় চার বন্ধুর তিনজনই না ফেরার দেশে চলে যায়।
এ খবর শুনে আমার সেই কিশোরী মনে কী অনুভূতি হয়েছিল, তা লেখার মতো ভাষা আমার জানা নেই। এখন ভাবি কেন এতটা নির্দয় ছিলাম। যে ছেলেটা আমাকে এতটা ভালোবাসত তাকে লাথি মেরে আমার কিশোরী মন আনন্দে মেতে উঠেছিল। কতটা অবুঝ ছিলাম দুজনে। এখনো ভাবতে কষ্ট হয়।
এখন তো প্রায় তিন যুগ পার হয়ে গেছে। এই পরিণত বয়সেও আমার মন আজ তার প্রতি ভালোবাসা, প্রেমে, মায়ায়, আদরে, স্নেহে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। আজও প্রশ্ন করি এত অল্প আয়ু নিয়ে কেন সে এসেছিল এই পৃথিবীতে? তার জন্য আমার সেই কিশোরী মনে একটু প্রেম দিলে কি এমন ক্ষতি হতো? আজ হয়তো সে সাগর কন্যার সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে। অতল সাগরের অপ্সরীরা তাকে নিশ্চয়ই ভালোবেসেই বুকে আগলে রেখেছে। ভালো থাকুক ভালোবাসা স্বর্গের অপ্সরী বুকে।