মানুষ বই প্রেমিক হয়ে উঠুক

বাংলাদেশে শুরু হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা, প্রাণের বইমেলা। পাঠকেরা এই মেলায় তাদের প্রিয় লেখকের বইয়ের জন্য সারা বছর ধরে আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে। সরাসরি দেখা হয় লেখকের সঙ্গে, পাঠকের সঙ্গে মতবিনিময় হয়। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। যেসব লেখক প্রবাসে থাকেন, তারাও এ সময় দেশে মেলায় উপস্থিত হয়।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মেলা। যত দূর জানা যায়, ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই এই বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’।
পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম বলেছেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে, কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন বই হয়।’ বই আমাদের ভালো বন্ধুও বলা চলে। একটা ভালো বই থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। বই মেলায় সব ধরনের বই আসে। যার যেটা পছন্দ, সে কিনতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে দেখা যায়, আমরা বিভিন্নভাবে টাকা খরচ করি। কিন্তু বই কিনতে সবচেয়ে বেশি কৃপণতা করি। যেন এ আর এমনকি, পড়ে কী লাভ। অথচ আমরা অনেকেই জানি না, একটা ভালো বই জীবন বদলে দিতে পারে। ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন, ‘আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তার জন্য আমি বইয়ের কাছে ঋণী।’
বই হলো মনের খোরাক। আমরা যেমন আমাদের শরীর ঠিক রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যায়াম করি, খাবার খাই সুস্থ থাকার জন্য, তেমনি বই মনকে সুস্থ রাখে। মনেরও চর্চা থাকলে, মন ভালো থাকলে সুস্থ চিন্তা করা যায়। আর সুস্থ চিন্তার নাগরিক সমাজ ও দেশকে অনেক কিছু দিতে পারে।
বই মেলায় উদ্দেশ্য যেন সেলফি মেলা না হয়। অনেকে শুধু ঘুরতে বা সেলফি তুলতে যায়, এটা ঠিক নয়। অন্তত একটা ভালো বই যদি কেউ কিনে পড়ে, এটাই হবে বই মেলার সার্থকতা। অবশ্য যারা পড়ুয়া তারা শুধু একটা না, পছন্দের সব বই কিনে। আগে থেকেই তালিকা করে রাখে। সমাজে যতবেশী মানুষ বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে, পড়বে ততই মঙ্গল। বিশেষ করে বাবা-মা যদি শিশুদের বই মেলায় নিয়ে আসে প্রতিবছর এবং পছন্দের বই কিনে দেয়, তাহলে একটা শিশু গড়ে উঠবে সুস্থ চিন্তা–ধারার মধ্য দিয়ে। সেই সঙ্গে তার বই পড়ার অভ্যাসও গড়ে উঠবে। মানুষ যত গ্রন্থ প্রেমিক হবে, সে সচেতনও হবে ততখানি। মনের মধ্যে বোধ সৃষ্টি হবে, তার প্রভাবও পড়বে আশপাশের মানুষের ওপর।
বই মেলায় পাঠক যেমন নতুন বইয়ের স্বাদ পায়, তেমনি প্রকাশকও লাভবান হয়। প্রকাশকেরাও বুঝতে পারে ক্রেতার চাহিদা। আসলে বই মেলা মানে সবার ভালো দিক বলা চলে। মেলায় যোগ দেয় সর্বস্তরের লেখক, সাহিত্যিক। প্রকাশক সাজায় তার বইয়ের ডালি ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য, পাঠকও খুঁজে বেড়ায় তার পছন্দের বই। এই মিলনমেলায় সবাই আমোদিত হয়।
দেশে থাকলে আমিও বইমেলায় থাকতাম। এবারও আমার পরিচিত অনেক লেখকের বই মেলায় এসেছে।
রওশন হকের বই ‘সীমান্তের ট্রেন’, মনিজা রহমানের ‘আকাশরেখার সীমানায়’, রোমেনা লেইসের ‘ভালোবাসার রং নীল’, উইলি মুক্তির ‘জনপাথরের যুগলবন্দী’, শেলী জামান খানের ‘আবর্তন’, হুমায়ূন কবীর ঢালীর ‘ব্রিজ টু কানাডা’, পাশা মোস্তফা কামালের ‘আমাদের জাতির জনক’ ইত্যাদি ইতিমধ্যে মেলায় এসেছে। আসলে তালিকা দিলে শেষ হবে না। শিশুদের বই থেকে শুরু করে রান্নাবান্না, ইসলামি, গল্প কবিতা, প্রবন্ধ—সব বই মেলায় পাওয়া যায়। আর এজন্য পাঠক অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে।
একটা ভালো বই একজনের মনমানসিকতা বদলে দিতে পারে। হতাশা, গ্লানি ঝেড়ে ফেলে মন হয়ে উঠে রৌদ্রোজ্জ্বল। বই মেলা দিনদিন প্রসারিত হচ্ছে, এটা খুব ভালো দিক। এখন তো বিভিন্ন চ্যানেল সরাসরি লাইভ করে লেখকের কাছে জানতে চায় তার অনুভূতি—কেমন সাড়া পাচ্ছেন, পাঠকের কাছে জানতে চায় পছন্দের বই পেলেন কিনা। এতে ভালো দিক হচ্ছে, সবাই জানতে পারছে ভালো বইয়ের নাম, লেখকের নাম। প্রচারণার জন্যও অনেক সময় ভালো বই হেলায় পড়ে থাকে। পাঠক জানে অনেক পরে।
তবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবাই এখন সরব বলা চলে। প্রত্যেকে নিজের বইয়ের প্রচারণা চালাচ্ছে। জানান দিচ্ছে পাঠকদের। অনেক পাঠক মূলত এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর ভিত্তি করে বই কিনে। কারণ, লেখকের প্রচারণা দেখে জানতে পারে। ভালো লাগলে তখনই সিদ্ধান্ত নেয়, এই লেখকের বই কিনবে। শেষ কথা হলো, যেভাবে হোক মানুষ বই প্রেমিক হয়ে উঠুক, এটাই চাওয়া। বইয়ের মাধ্যমে দেশ-বিদেশ সম্পর্কে জানতে পারবে। বাড়বে তার জ্ঞানের পরিধি। মনের আঁধার দূর করে আলোর স্পর্শ পাবে একটি ভালো বইয়ের মাধ্যমে। মেলার সব বই সৃজনশীল, ভালো—সেটা আমি বলব না। তবে পাঠকের খুঁজে নিতে হবে সে কোন বই পড়বে।