চিকিৎসা ও রাজনীতিতে ছিলেন সমানতালে

আমাদের বয়সী যাঁদের ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের আগের জন্ম, তাদের স্কুল, কলেজের পাঠ্যপুস্তকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যক্ষেত্রে মুসলমানদের অনেক ভূমিকা ও উপস্থিতি পরিলক্ষিত হতো। ধীরে ধীরে সিলেবাস বদল হতে হতে, বিশেষত ইতিহাস বারবার পুনর্লিখিত হওয়ার ফলে, ভারতের নানা ক্ষেত্রে মুসলমানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদানের কথা একরকম ধামাচাপা পড়ে গেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে তা অজানা আর চোখে না পড়ার ফলে বয়স্কদের কাছেও সেসব স্মৃতিও আর বেঁচে নেই। ভারতের স্বাধীনতাপূর্ব, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রেই মুসলমানদেরও যে অনেক মূল্যবান অবদান আছে, সে সম্পর্কে পাঠকদের জানাতে এই ধারাবাহিক লেখা

মহাম্মদ আজমল খান দিল্লিতে খুবই প্রসিদ্ধ ও উঁচু দরের একজন চিকিৎসক ছিলেন। সে কারণে হাকিম আজমল খান নামেই তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি দিল্লির নামকরা শিক্ষায়তন, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ছিলেন। দিল্লির আরেকটি প্রতিষ্ঠান আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি চিকিৎসার জন্য একটি কলেজ এবং হাসপাতালেরও তিনি প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
প্রাথমিক জীবন: হাকিম আজমল খান ১৮৬৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা বংশ পরম্পরায় প্রায় সবাই চিকিৎসক ছিলেন। এঁরা মুঘল সম্রাট বাবরের শাসনামলে ভারতে আসেন। তাঁর পরিবার ছিল ইউনানি ডাক্তার (হাকিম, যাঁরা এ দেশে আসার পর থেকে ওই প্রাচীন ধরনের ওষুধ প্রচলন করা শুরু করেন। তখন তাঁরা দিল্লির ‘রইস’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দাদা হাকিম শরিফ খান ছিলেন মুঘল সম্রাট শাহ আলমের চিকিৎসক। তিনি ইউনানি মেডিসিন শেখানোর উদ্দেশ্যে ‘শরিফ মঞ্জিল’ নামে একটি হাসপাতাল-কাম-কলেজ নির্মাণ করেছিলেন।
শিক্ষা ও সামাজিক কাজকর্ম: আজমলের প্রাথমিক শিক্ষা আরবি ও ফারসি ভাষার মাধ্যমে শুরু হয়। তারপর পর তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ আত্মীয়দের তত্ত্বাবধানে ওষুধ গবেষণায় তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তাঁর এই তত্ত্বাবধায়ক গুরুজনেরা সবাই সুপরিচিত চিকিৎসক ছিলেন। তিব্বি-ইউনানি বা ইউনানি মেডিসিন চর্চাকে জনগণের মধ্যে সুপরিচিত ও আকর্ষণীয় করার জন্য তাঁর পিতামহ ভারত উপমহাদেশের সর্বত্র ‘শরিফ মঞ্জিল হাসপাতাল-কাম-কলেজ’ নামে অন্যতম সর্বোত্তম চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন, যেখানে গরিবদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দেওয়া হতো।
আজমল দিল্লির সিদ্দিকী দাওয়াখানার হাকিম আবদুল জামিলের অধীনে তাঁর ইউনানি অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন। শিক্ষা ও ট্রেনিং শেষ করার পর হাকিম আজমল খান রামপুরের নবাবের প্রধান চিকিৎসক নিযুক্ত হন।
হাকিম আজমল খানকে ‘মাসিহা-ই-হিন্দ’ (ভারতের স্বাস্থ্য ত্রাণকর্তা) এবং একজন ‘মুকুটহীন রাজা’ উপাধিতেও ভূষিত করা হতো। আজমল খানও তাঁর পিতার মতো একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। তিনি অলৌকিকভাবে রোগ সারাতে পারতেন। তাঁর ওষুধের সিন্দুকের (মেডিসিন টেস্ট) মধ্যে কী কী অদ্ভুত ওষুধ থাকত, তার গোপন খবর একমাত্র তিনিই জানতেন। রোগ নির্ণয়ের ব্যাপারে তাঁর মেধা নাকি এমনই ছিল যে, তিনি কোনো ব্যক্তির মুখ দেখেই তার অসুস্থতা নির্ণয় করতে পারতেন। রোগীকে চিকিৎসার জন্য যদি হাকিম আজমল খানকে শহরের বাইরে যেতে হতো, তাহলে তখনকার দিনে তিনি নাকি প্রতিদিন ১০০০ টাকা চার্জ করতেন। কিন্তু রোগী যদি দিল্লিতে আসত, তাহলে তিনি কোন চার্জ করতেন না, তা তিনি গরিব, বিত্তবান, সমাজের সম্ভ্রান্ত বা নিম্নস্তরের লোক—যেই হোক না কেন।
আজমল খান তাঁর যুগের একজন অসাধারণ ও বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষ ছিলেন। ভারতীয় স্বাধীনতা, জাতীয় ঐক্য ও বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে সমন্বয় ও সমঝোতার ব্যাপারে তাঁর অতুলনীয় অবদান ছিল। দেশীয় ভেষজ ব্যবস্থা বা ইউনানি মেডিসিনের স্বদেশি ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও বিকাশের ব্যাপারে তিনি খুব আগ্রহ দেখান। সে ব্যাপারে তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন—দিল্লির সেন্ট্রাল কলেজ, হিন্দুস্তানি দাওয়াখানা এবং আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি তিব্বিয়া কলেজ, যা এক কথায় তিব্বিয়া কলেজ নামে পরিচিত। দিল্লির এই তিব্বিয়া কলেজ মাঠ পর্যায়ের (গ্রাউন্ড লেভেল) প্রচুর মৌলিক গবেষণা, অনুশীলন ও প্রসার করে ভারতের নিজস্ব ওষুধের ইউনানি ব্যবস্থাকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। আজমল খানের অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবের মধ্যেও একটি ক্ষয়িষ্ণু ইউনানি চিকিৎসা ব্যবস্থায় নতুন শক্তি ও প্রাণ সঞ্চার করেছিল।
খান ইউনানি সিস্টেমের মধ্যে পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে চিকিৎসা ব্যবস্থার সংমিশ্রণ ঘটানোর প্রস্তাব করেন। কিন্তু লক্ষ্ণৌ ঘরানার চিকিৎসকেরা সম্পূর্ণ উল্টো এক চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে মিশ্রণ না করে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখার পক্ষে মত দেন। হাকিম আজমল খান রসায়নবিদ ড. সালিমুজ্জামান সিদ্দিকীর প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেন। এই প্রতিভাবানের গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি গাছপালার পরিচিতি ও তাদের গুণাগুণ আবিষ্কার ইউনানি চিকিৎসা ক্ষেত্রকে নতুন এক দিশা দেয়।
জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খান ১৯২০ সালের ২২ নভেম্বর তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রথম চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন। ১৯২৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই অবস্থানে বহাল ছিলেন। এই সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আলীগড় থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি বিভিন্ন সময় নিদারুণভাবে আর্থিক সংকটে পড়লে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে সে সব দূর করতে সাহায্য করেন। সেটা করা হতো সাধারণত ব্যাপক তহবিল উত্তোলন করে। কিন্তু প্রায়ই তিনি নিজের সঞ্চিত অর্থ ব্যবহার করেই সেই সংকটগুলো দূর করতেন ।
রাজনীতি: হাকিম আজমল খান তাঁর পরিবারের চালু করা উর্দু সাপ্তাহিক ‘আকমল-উল-আখবার’-এ লেখালেখি শুরু করার পর আস্তে আস্তে দিক পরিবর্তন করেন। চিকিৎসা বিদ্যা ত্যাগ করে তিনি রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকেন। ১৯০৬ সালে তিনি মুসলিম লীগের প্রধান হন এবং শিমলায় গিয়ে ভারতের ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে লীগের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। ১৯০৬ সালের একেবারে শেষের দিকে ৩০ ডিসেম্বর তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের ঢাকায় অফিশিয়াল প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯১৭ সালের দিকে যখন অনেক মুসলিম নেতা গ্রেপ্তারের মুখে পড়েন, তখন খান সাহেব তাদের সাহায্যের জন্য মহাত্মা গান্ধীর শরণাপন্ন হন। তাঁদের মধ্যে একটা সমঝোতা হয় এবং তিনি গান্ধীজির সঙ্গে একত্রিত হয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। সে সময় খিলাফত আন্দোলনও বেশ জোরেশোরে চলছিল। আজমল খান খেলাফতের প্রধান প্রধান নেতা যেমন মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, মাওলানা মোহাম্মাদ আলী জৌহর ও মাওলানা শওকত আলীর মতো মুসলিম নেতাদের সঙ্গে দেখা করে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। কংগ্রেস ও খিলাফত—এই উভয় দিকের সম্মিলিত আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে এক প্রবল শক্তি হয়ে দাঁড়ায় এবং জনগণের মনেও অনেক সাহস জোগায়। বস্তুত হাকিম আজমল খানই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি একধারে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ও অল ইন্ডিয়া খিলাফত কমিটি—এই তিনটি প্রতিষ্ঠানেরই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মৃত্যু ও কিছু কথা: আজমল খান ১৯২৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দেহত্যাগের আগে হাকিম আজমল খান তার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার দেওয়া ‘হাজিক-উল-মুলক’ সরকারি উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর ভারতীয় অনেক অনুসারী তাঁকে ‘মাসিহ-উল-মুলুক’ (জাতির চিকিৎসক বা আরোগ্য কর্তা) উপাধিতে ভূষিত করেছিল। আজমল খানের মৃত্যুর পর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার চ্যান্সেলরের পদে ড. মুখতার আহমেদ আনসারি স্থলাভিষিক্ত হন।
আজমলাইন (Ajmaline) নামে হৃদ্‌যন্ত্রের জটিলতা রোধের (Anti-Arrhythmatic agent) একটি ওষুধ তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছিল। আজমলান নামের পেরেন্ট হাইড্রাইডের নামও তাঁর নামানুসারে হয়। আজমল খান পরিবারের মূল মন্ত্র ছিল ‘আজাল-উল-আল্লাহ-খুদাতুলমাল’—যার অর্থ, নিজেকে ব্যস্ত রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা। দিল্লির তিব্বিয়া কলেজ সংলগ্ন এলাকায় তাঁর নামে আজমল খান পার্ক নির্মিত হয়।
উদ্ধৃতি: ১৯২১ সালের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আহমেদাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশজুড়ে এখন এই অসহযোগ আন্দোলনের আবহ তৈরি হয়েছে। আজ কোনো সত্যিকারের ভারতীয় হৃদয় নেই, এমনকি এই মহান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এমন কেউ নেই, যে হাসিখুশি ভুলে গিয়ে কষ্ট ও আত্মত্যাগ স্বীকারের প্রত্যয় নিয়ে স্বরাজ লাভে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না এবং পাঞ্জাব ও খিলাফতের ওপর যে অন্যায় করা হয়েছে তার প্রতিকার করবে না।’
নোট: আয়ুর্বেদ ও ইউনানি ওষুধ কয়েক হাজার বছরের পুরোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা। আয়ুর্বেদের উৎপত্তি ভারত থেকে ও ইউনানির উৎপত্তি গ্রিস থেকে। আয়ুর্বেদ প্রধানত ভারতে ব্যবহৃত ও ইউনানি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত হয়। এদের এখন অ্যালোপ্যাথিকের বিকল্প চিকিৎসা (অলটারনেটিভ মেডিসিন) হিসেবে ধরা হয়। দুই সিস্টেম এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে যে, পাঁচটি মৌলিক উপাদান—বায়ু, জল, আগুন, পৃথিবী ও ইথার—এর ভারসাম্যহীনতাই রোগের প্রকৃত কারণ। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা নির্ণয় করা হয় শরীরের আটটি বিভিন্ন দিক পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু ইউনানি সিস্টেম রোগ নির্ণয়ের জন্য হৃৎস্পন্দন (পালস) ও চেহারার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। উভয় সিস্টেম বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও প্রাকৃতিক পদার্থ থেকে তৈরি ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে শরীর শুদ্ধিকরণে বিশ্বাস করে।