অভিশংসন নিয়ে উল্টো বিপদে ডেমোক্র্যাটরা!

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন

হান্টার বাইডেন এমন কিছু আহামরি বিখ্যাত মানুষ নন। তিনি আমেরিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির একসময়ের অগ্রগামী প্রার্থী জো বাইডেনের ছেলে। একেবারে সাধারণ মানুষও তিনি নন। তিনি নিজেও ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে পড়েছেন। তবুও তাকে এত মানুষ চেনার কথা নয়, তার নাম গণমাধ্যমে এতবার আসার কথা নয়। বিশেষত সিনেটে তার নাম এত বেশি উত্থাপিত হওয়ার কারণ ভিন্ন।
আমেরিকার বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের ছেলেমেয়ে দূরে থাক, তাঁর নিজের সম্পর্কেই মানুষ প্রায় ভুলে গেছে। তাঁর এক ছেলে দুই মেয়ে। নাম? সে প্রসঙ্গ নয়, প্রসঙ্গ হান্টার বাইডেন। তার নাম আগামী কয়েক মাস আরও বেশি আসতে থাকবে। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি তার মহৎ কাজের জন্য নন, বিতর্কিত কাজের জন্য আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসনের মূল ঘাঁটতে গেলে বেরোবে ইউক্রেনের চার শ মিলিয়ন ডলার অনুদানের অর্থ আটকে রাখা। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলস্কির সঙ্গে একটি ফোনকল, বারিসমা নামের গ্যাস কোম্পানি, রুডি জুলিয়ানি ও জো বাইডেন—একের পর এক চলে আসে। তারও মধ্যখানে আসে হান্টার বাইডেনের নাম। তিনি ঘটনার মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন।
ডেমোক্র্যাটদের ভাষ্য ধরা হলে, হান্টারের মাধ্যমে তাঁর বাবাকে হেনস্তা করার জন্য ট্রাম্প চার শ মিলিয়ন ডলারের অনুদান, যা কংগ্রেসে পাস হয়ে গেছে এবং প্রেসিডেন্টের আটকে রাখার কোনো এখতিয়ার নেই—সেটাকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের ওপর চাপ প্রয়োগ করছিলেন। উদ্দেশ্যটা ব্যক্তিগত। প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের নামে কালিমা লেপন করা।
রিপাবলিকানদের ভাষ্য হচ্ছে, হান্টার বাইডনকে দুর্নীতির মাধ্যমে অসম্ভব একটি পদে বসিয়ে তাঁর মাধ্যমে বিস্তর অর্থ বাইডেন পরিবার হাতিয়ে নিয়েছে। যার বিনিময়ে বারিসমা বলা যায় ইউক্রেনই ওবামা-বাইডেন সরকারের কাছ থেকে কিছু একটা সুবিধা নিয়েছে। কাজেই, প্রেসিডেন্ট যদি সেই দুর্নীতি উদ্ঘাটন করতে ইউক্রেনের জন্য বরাদ্দ আটকে দেয়, তার জন্য কী তিনি দায়ী? না বাইডেন পরিবার?
যেই ভাষ্যেই যান, হান্টার বাইডেন পুরো ইমপিচমেন্ট বিষয়টার একেবারে মধ্যখানে রয়েছেন। তাঁকেই প্রথম সাক্ষী হিসেবে আনার জন্য সিনেটে রিপাবলিকানরা দাবি জানিয়েছেন। যদি নিয়ে আসা হয়, তাঁর নাম আরও বেশি উচ্চারিত হবে। কতটা সম্মানের সঙ্গে, সেটা দেখার বিষয়।
জো বাইডেন দীর্ঘদিনের ত্যাগী রাজনীতিবিদ হিসেবে খ্যাত। তাঁর পরিবারে বড় কয়েকটি দুর্ঘটনা আছে। ১৯৭২ সালে তাঁর স্ত্রী ও এক বছরের মেয়ে নাওমী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। ছেলে বো-এর পা ভেঙে যায়, হান্টারের মাথা ফেটে যায়। তখন তিনি একাই সন্তান লালন-পালন, একই সঙ্গে সিনেটর হিসেবে রাজনীতির গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। সিনেট থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন, দেওয়া হয়নি। তাকে ছাড়া চলবে না। ত্যাগী মানুষ তো বটেই। তাঁর বড় ছেলে বো বাইডেন ২০১৫ সালে ক্যানসারে মারা যান। জো বাইডেনের ধন-সম্পদও তেমন ছিল না। ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়া পর্যন্ত তাঁকে মধ্যবিত্ত, সৎ একজন মানুষ হিসেবেই সবাই জানতেন।
কিন্তু এমন একটি মানুষ কেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তাঁর ছেলেকে বারিসমার পরিচালক হতে দিয়ে সম্পূর্ণ ঘোলাটে একটা পরিস্থিতি তৈরি করলেন? তিনি তখন ইউক্রেনের দুর্নীতি দমন নিয়ে সরাসরি কাজ করছেন। মার্কিন নীতিতে যে সব দেশে বড় সাহায্য দেওয়া হয়, সেখানে মানবাধিকার, দুর্নীতি দেখভাল করা সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে তিনি দেন-দরবার করছেন। সেই রকম একটা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে তিনি তাঁর পরিবারের জন্য কেন ইউক্রেনের আনুকূল্য গ্রহণ করলেন?
এটিকে কিছুতেই চাকরি বলা যায় না। ব্যাপারটা যে কত অসম্ভব, সেটা একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। ডেমোক্র্যাটরা এ নিয়ে এক মিনিট কেন, পাঁচ সেকেন্ড সময় দেবেন কি না সন্দেহ। তাদের প্রতিপক্ষ এ নিয়েই কিন্তু বিরাট কাণ্ড করে ফেলবেন। কাজেই এদিকে নজর দিন অথবা না দিন, ব্যাপারটা কিন্তু গৌণ হয়ে যাচ্ছে না।
১. বারিসমা ইউক্রেনের একটি গ্যাস ও জ্বালানি কোম্পানি। এক্সন মবিলের মতো, তবে অনেক ছোট।
২. সেই কোম্পানির বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। যে বিষয়ে তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন।
৩. হান্টার বাইডেনের গ্যাস ও জ্বালানি বিষয়ে ইউক্রেন বা পৃথিবীর সেই অঞ্চল বিষয়ে সামান্যতম অভিজ্ঞতাও তখন ছিল না। ভাইস প্রেসিডেন্টের ছেলে, এর বাইরে তাঁর আর কোনো যোগ্যতা ছিল না।
৪. হান্টারকে মাসিক ৫০ হাজার ডলার বেতনে সেই জ্বালানি কোম্পানির একজন পরিচালক বানিয়ে দেওয়া হলো। (হান্টার বাইডেনের বেতনের অঙ্কটি অসমর্থিত সূত্রের)
৫. কেউ যদি এমন একটি জ্বালানি কোম্পানির পরিচালক হওয়ার পূর্ণ যোগ্যতাও রাখেন, তার বেতন অনেক কম হওয়ার কথা। একসূত্র মতে, বারিসমার মতো কোম্পানির পরিচালকদের যা বেতন হওয়ার কথা, হান্টার বাইডেনকে তার কয়েকগুণ বেশি অর্থ দেওয়া হয়েছে।
৬. রয়টার্সের একটি সূত্র মতে, হান্টার বাইডেন এই পুরো সময়টাতে একদিনের জন্যও ইউক্রেনে যাননি।
একেই তো বলে ‘কিক ব্যাক’। তোমাকে তো দিতে পারব না, আইনে ধরবে, তোমার বউ বা ছেলে-মেয়েকে আমার কোম্পানির কনসালট্যান্ট করে নাও। কনসালট্যান্টের বেতন তো আকাশচুম্বী হতেই পারে। কেউ কিছু বুঝবে না। আমার কাজটা কিন্তু করে দিয়ো।
শুধু অল্প কেউ নয়, বিষয়টা আসলে সবাই বুঝে।
হান্টার বাইডেন তাঁর বেতন কত ছিল, বলছেন না। বারিসমাও বলছে না। নিউইয়র্ক টাইমস-এর এক রিপোর্টার বের করেছেন, ওই সময়টিতে হান্টারের ব্যাংক হিসাবে অজ্ঞাত খাত থেকে মোট সাত লাখ ডলার এসেছে। বারিসমা থেকে সরাসরি নয়, মধ্যবর্তী একটি কোম্পানি থেকে। সেটা নিশ্চয়ই বারিসমায় তাঁর বেতন বাবদ পেয়েছেন। সেই সংখ্যাটাকে, কত মাসে এসেছে তা দিয়ে ভাগ দিয়ে মাসিক বেতন বের করা হলো। বেতনের এই অঙ্কের পেছনে কোনো নিরেট প্রমাণ নেই। তবে অঙ্কটা যে অত নয়, তার চেয়ে অনেক কম, সেটাও হান্টার বাইডেন অথবা বারিসমা দাবি করছেন না।
ইউক্রেনের তখনকার প্রসিকিউটর ভিক্টর সকিন নাকি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছিলেন না। অজান্তে নিজেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ আছে। সেই সকিনকে সরিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য ইউক্রেনকে তৈরি করতে জো বাইডেন ছুটে গেলেন সেখানে। অথচ তাঁর ছেলেকে তিনি এমন এক বিতর্কিত আসনে বসতে সহায়তা করলেন? প্রত্যক্ষ সহায়তা যদি নাও করেন, সেখানে তো বাধও সাধলেন না। যেখানে পরিষ্কার স্বার্থের দ্বন্দ্ব (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট), সেই কাজে যোগ্যতা নেই যে ছেলের, তাঁকে টাকার এমন বিরাট এক অঙ্কের ভেতরে ঢোকালেন যে, তাঁর নিজের সম্পর্কেই এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। সেই পথ তিনি ও তাঁর ছেলেই সুগম করে দিয়েছেন।
ব্যাপারটি ‘এমন কতই তো হয়’ মতো নয়। এটি জো বাইডেনকে ভোগাবে। ইমপিচমেন্ট এনেছে ও ডুবিয়েছে। আর হান্টার বাইডেনকে এখন তো দেখাই যাচ্ছে, তাহলে রিপাবলিকানরা আবার সমন করবে।
জাতিসংঘের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ট্রাম্পের এক সময়ের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অনেক সরাসরি তথ্য আছে তাঁর কাছে। ট্রাম্পের স্বেচ্ছাচারিতা, নিজের স্বার্থে জনগণের, দেশের অনুদানকে ব্যবহার করারও তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী বলে সবাই ভেবেছেন। যে কারণে তাঁকে সাক্ষী হিসেবে সিনেটে যেতে দিতে হোয়াইট হাউস যতভাবে সম্ভব, বাধার সৃষ্টি করেছে। বোল্টন একটি বইও লিখে ফেলেছেন, পাণ্ডুলিপির বোম শেলের মতো কিছু অংশ ইতিমধ্যে ফাঁসও হয়ে গেছে।
এই নাজুক পরিস্থিতিতে আবার হান্টার বাইডেনকে নিয়ে খেলা শুরু হলো। রিপাবলিকানরা বলেছেন, জন বোল্টনকে সাক্ষী দিতে দিলে হান্টার বাইডেনকে সিনেটে নিয়ে এসে জেরা করার সুযোগ দিতে হবে। জন বোল্টন সিনেটে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তথ্য বোমা ফাটাবেন। হান্টার বাইডেনকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে জো বাইডেনের স্বজনপ্রীতি ও সম্ভাব্য দুর্নীতির তথ্য জনসমক্ষে উদ্ঘাটন করে রিপাবলিকানরা সেই ঘটনার মোড় হয়তো ঘুরিয়ে ফেলতে পারবেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাই ভাবছিলেন তারা।
বাবা ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় হান্টার বাইডেনের সেই বারিসমার চাকরিটি নেওয়া তিনি এখন বলছেন ‘পুওর জাজমেন্ট’ হয়েছে। বিষয়টা শুধুই বোঝার ভুল নয়, তার থেকেও অনেক ঘোলাটে। আমেরিকার ইতিহাসে তৃতীয় ইমপিচমেন্টের মতো বড় ব্যাপারটিকে হান্টার বাইডেনেই লেজে-গোবরে করে ছেড়েছে। তার বাবার প্রেসিডেন্ট পদে ডেমোক্রেটিক টিকিট পাওয়া এখন সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। মনে হচ্ছে, সামনে তাকে অনেক জবাবদিহি করতে হবে। শুধু তার বাবা জো বাইডেন নয়, পুরো ডেমোক্রেটিক পার্টিই এ কারণে অসুবিধার মধ্যে পড়েছে এবং আরও পড়তে যাচ্ছে।