কৃতজ্ঞতা স্বীকার করুন

চীনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসকদের জন্য সারা দেশে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেন চলছে প্রশংসার বন্যা। বিষয়টা খুবই ভালো দেখাত, যদি না তার সঙ্গে না থাকত আমাদের দেশের চিকিৎসকদের নিন্দা ও সমালোচনা। এ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত লিখতে গিয়ে প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগে, আমরা কী ভুলে গেছি, সারা দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীদের জন্য আমাদের মহান ডাক্তাররা ও সেবক-সেবিকারা কী করছিলেন? আমরা কি বিন্দুমাত্র তাঁদের প্রশংসা করেছি বা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছি?
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, কী বলছেন আপনি! আমরা প্রশংসা করি না মানে? এক শ্রেণির মানুষ এটাতে এমনি পারদর্শী যে, তারা ভালো-খারাপ, উত্তর-দক্ষিণ না বুঝে সদা-সর্বদাই এক ধরনের প্রশংসায় নিয়োজিত থাকেন। না, সেটা প্রশংসা নয়। সেটাকে আমরা পাম্প, তেলবাজি বা তোষামোদ বলি। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেটিকে সবচেয়ে সুন্দর করে তুলে ধরছিলেন সাহেব ও মোসাহেবের মাধ্যমে। তাই আমি আর সেদিকে যাচ্ছি না।
তবে এটাই বলতে চাই, আমার এ লেখা কোনোভাবেই কোন পাম্প বা তেলবাজি নিয়ে নয়। এটি মানুষের সৎ, ন্যায় ও দায়িত্বের কথা তুলে ধরার। যে কথা উপযুক্ত, সত্য ও ন্যায়ের সমর্থন করে এবং যে কথা বলার পেছনে কোন ধরনের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করার কোন লুকায়িত উদ্দেশ্য থাকে না, তা–ই হল প্রশংসা। অন্যদিকে, পাম্প? সেটি ভণ্ডামি, মিথ্যা ও নিজ স্বার্থ হাসিল করার লোভনীয় একটা ফাঁদ। এটি দুর্নীতি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এটিকে নিশ্চয়ই আপনার মতো সৎ ও ন্যায়পরায়ণ লোকেরা ঘৃণা করেন। তাই, আসুন বাকিটুকু পড়ার আগে এ বিষয়ে শত ভাগ পরিষ্কার হই।
কী করতে পারে এই উপযুক্ত প্রশংসা? চলুন, দেখা যাক উদাহরণসহ। গত ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট, শুক্রবার ছিল আমার বাসার লিজ শেষ হওয়ার শেষ দিন। নিয়ম ও চুক্তি অনুযায়ী আমাকে ৩১ তারিখ সকাল ১১টা ৩০ মিনিটের মধ্যে বাসার চাবি হস্তান্তর করার কথা। বলার প্রয়োজনই নেই, ওই সময়ের মধ্যে আমার সব জিনিসপত্রও সরাতে হবে এবং বাসা পরিষ্কারও করতে হবে। কাজেই, আমাকে জিনিসপত্র সরানোর কাজটা বৃহস্পতিবারে করলেই ভালো হয়। কিন্তু এ দুই দিনই আমার অফিস, ছুটি নেই। যদি সেটা ১ সেপ্টেম্বর শনিবারে হতো, খুবই ভালো হতো, সেটাই ভাবছিলাম।
যদিও জানতাম, কোন কাজে আসবে না। তবু উপায় না পেয়ে বাসার রেন্টাল অফিসে যাই। বুঝিয়ে বলি বিষয়টা। অনুরোধ করি একদিন অতিরিক্ত সময় দেওয়ার জন্য। ম্যানেজার আমাকে দুঃখ প্রকাশ ছাড়া কিছুই করতে পারলেন না। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম, দুই বছর একটা বাসাতে থাকার পর একটি দিনও বাড়ানো যায় না? যাকগে, বাসায় আসার পর ভাবলাম, তাঁরাই ঠিক। তাঁদের হয়তো অন্য কোন মানুষ আছেন যারা বাসা নেবেন বা কেনই তাঁরা আমাকে একদিন বেশি থাকতে দেবেন? তাঁরা তো তাঁদের নিয়মে ঠিকই আছেন।
বাসা ছাড়ার আগে সৎভাবে তাঁদের জন্য একটা রিভিউ লিখি। রিভিউটা গুগলে ‘winding lane apartments largo fl’ লেখে অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে। আমি সেটি এখানে কপি করে দিচ্ছি।
বাসা ছেড়ে যাওয়ার তিন দিন পর লিসা আমাকে ফোন করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এক মাসের ইউটিলিটি বিল ফেরত দেন ও আমার নতুন বাসার জন্য কিছু জিনিস গিফট পাঠান। একটি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স ম্যানেজ করতে তিনি এতই ব্যস্ত থাকতেন যে, আমার সঙ্গে কোন দিনই সরাসরি কথা বলার সময় হয়নি তাঁর। সেই লিসা আমাকে সময় দিতে তাঁর ৪-৫টা মিটিংয়ের সময় পরিবর্তন করে দুপুরে খাবারে নিয়ে যান। এখনো কেমন আছি জানতে চেয়ে ই-মেইল দেন। সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? তাঁর কাজের উপযুক্ত, সৎ ও সঠিক কৃতজ্ঞতা জানানোয় সেটি সম্ভব হয়েছে। মনে রাখবেন, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এতই বিরল যে, এটি যেকোনো মানুষের অন্তরে ভালোবাসার দাগ কাটে খুবই সহজে।
এবার চিন্তা করে দেখুন তো, তাঁরা আমাকে একদিন বেশি থাকতে না দেওয়ায় আমি যদি এখানে একটা খারাপ রিভিউ দিতাম, তাহলে কী হতো? আমার মতে—
১. আমার ব্যক্তিগত লাভ না হওয়ায় তাঁদের ওপর দোষ চাপিয়ে দিতাম।
২. ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বঞ্চিত হতাম।
৩. কোন এক দিন আমার অনুশোচনা হতো।
৪. লিসা আমাকে কোন দিনই ফোন করে ক্ষমা চাইতেন না।
৫. বিল ফেরত বা গিফট পাওয়ার চিন্তাই করা যেত না।
৬. একদিন বেশি থাকা তো দূরের কথা।
এবার আপনার সিদ্ধান্ত আপনিই নিন, আপনি কোনটার পক্ষে।
আরেকটা উদাহরণ দিই। শিকাগো ডাউন-টাউনে একটা সিকিউরিটি প্রজেক্টে কাজ করছিলাম প্রায় তিন বছর আগে। চার মিলিয়ন ডলারের সেই প্রজেক্টের সাপোর্ট দিতে আর একটা প্রজেক্ট চলছিল পাশাপাশি। ওই প্রজেক্টে আমি একদিনও কাজ করিনি। প্রজেক্টটিতে বড়দিনের ছুটিতে সবাই চলে যাওয়ার পর ৫টা বাগ (ভুল/ত্রুটি) ধরা পড়ে। খুবই সিরিয়াস বাগ! সবাই ছুটিতে চলে গেছেন ভেবে আমি নিজেই যতটুকু পারি বাগ সমাধান করতে বসি অতিরিক্ত সময়ে। তিন দিনে প্রায় ১০ ঘণ্টা অতিরিক্ত কাজ করে ৪টি বাগ সমাধানও করে দিই। ছুটি শেষে কর্তৃপক্ষ কাজে যোগদান করে যে বাগটি সমাধান হয়নি, সেটা নিয়ে পরিস্থিতি গরম করে ফেলে। একবারও ধন্যবাদ জ্ঞাপনও করেনি চারটি বাগ অতিরিক্ত সময়ে সমাধান করার জন্য। আমি তাতে খুবই কষ্ট পাই। ভাবি, কী দরকার আমার অন্যের প্রজেক্টে কাজ করার? সে যাই হোক, আমি আর ওই বাগে হাত দিইনি। গত সপ্তাহে আমার সেখানকার সহকর্মী রিচার্ডের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, সে বাগ এখনো বাগ লিস্টেই আছে!
এবার একটু চিন্তা করে দেখুন, যদি আমার অতিরিক্ত সময়ে কাজ ও চারটি বাগ সমাধানের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হতো, তাহলে কি তাঁদের লাভ হতো? না, যে বাগ সমাধান হয়নি সেটা নিয়ে চিল্লাচিল্লি করে তাঁদের লাভ হয়েছে?
আমার মতে, এই ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা স্বীকার শুধু ভালো কাজের ন্যায্য অধিকারই নয়। এটি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা গাঁজা বা হেরোইনের নেশার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। কারণ, মানুষ পরিস্থিতিতে পড়ে চাইলেই ধূমপানের নেশা ছাড়তে পারে, কৃতজ্ঞতা পাওয়ার আশা নয়। মানুষের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলে মানুষ কাজে আগ্রহী হয় এবং অনেক ভালো কাজ করে পদোন্নতি পায়। আর কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করলে চাকরিই ছেড়ে দেয়। মানুষ এটা পেলে যে শুধু পরিবারে মায়ার বন্ধনে থাকে তা নয়, মানুষ এমনকি সমাজসেবীও হয়। আর এটা না পেলে মানুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে অজানা পথে পাড়ি জমায়। সেই মানুষ যখন এটা পায়, তখন মায়ার বাঁধনে দুই দিনের এই নশ্বর পৃথিবীতে ভালোবাসার ঘর বাঁধে। আর এটি না পেলে মানুষের বিবাহ-বিচ্ছেদও হয়।
আপনার ছোট ছোট বাচ্চাদের ওপর কৃতজ্ঞতা বা ভালো কাজের প্রশংসা এমনই মহৌষধের মতো কাজ করবে যে, এটি পেলে ওরা মাতৃভক্ত ও পিতৃভক্ত হবে। আর এটি না পেলে ওরা যে জেদি হবে না, তার নিশ্চয়তা দিতে পারলাম না। এটির নেশা মানুষের মন ও রক্তের মধ্যে এতই প্রভাব ফেলে যে, এটি পেলে মানুষ ক্ষুধা নিয়ে ভিক্ষা করেও লক্ষ বছর এই সমস্যা জর্জরিত পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়। আর না পেলে? এমনকি আমাদের আপাতদৃষ্টিতে দেখা স্বর্গ সুখী মানুষও আত্মহত্যা করতে দ্বিধাবোধ করে না। তাই, মানুষের ভালো কাজের প্রশংসা করুন। এতে মানুষ কাজ করার আগ্রহ পাবে ও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবে।