লোভ

মেধার কথা জিজ্ঞাসা করতেই হু হু করে কেঁদে উঠলেন মেধার মা। বললেন—‘ওরা আমার নিরীহ, নিষ্পাপ মেয়েটিকে নীরবে খুন করেছে। কখনো শারীরিকভাবে, কখনো মানসিকভাবে আবার কখনো খাবার কষ্ট দিয়ে আমার কলিজার টুকরা মেয়েটিকে তিলে তিলে হত্যা করেছে।’ 

দিনের পর দিন মেয়েটি নীরবে নেশাগ্রস্ত স্বামীর নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছিল। এক সময় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মেয়েটি আমাকে ফোন করে বলত—‘মা আমি ওকে ডিভোর্স দিতে চাই। কিন্তু মেধার বাবা তা কখনো চাইতেন না। তিনি যদি চাইতেন, তবে আজ আমার মেয়েটিকে চিরতরে হারাতে হতো না।’
মেধার বাবা বলতেন—‘মেয়েটি আগে অস্ট্রেলিয়ার সিটিজেন হোক, তারপর আমরা ওখানে গিয়ে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব। আমাদের অস্ট্রেলিয়ার লোভই মেয়েটিকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে।’
মেধা খুব মেধাবী ছিলি। ক্লাসের পরীক্ষায় সে সব সময় প্রথম হতো। দেখতেও বেশ সুদর্শনা ছিল। ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে। তারপর নিজের পছন্দের কাউকে জীবন সঙ্গী করে নেবে। কিন্তু পরিবারের ইচ্ছার কাছে তার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।
স্কুলের আঙিনা অতিক্রম করে মেধা মাত্র কলেজে পা রাখল। হঠাৎ করে একদিন কলেজ থেকে বান্ধবীর সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে মেধাকে রাস্তায় দেখে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী এক যুবক। দেখেই মেধার রূপে মুগ্ধ হয়ে যায় ছেলেটি। মেধার বান্ধবী ওই ছেলেটির গ্রামের। তাই তার কাছ থেকে মেধার বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে মেধার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় ছেলেটি। মেধার বেকার বাবা অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ছেলের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারেননি। তিনি বাড়িতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে মেধার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। স্ত্রীর অনিচ্ছাকে অনেকটা উপেক্ষা করেই, বিয়ের ব্যাপারে মেধার কাছে মতামত জানতে চান তিনি। মেধা প্রথমে প্রবাসী ছেলেটিকে বিয়ে করতে রাজি না হলেও একপর্যায়ে বাবার প্রবল আগ্রহের কাছে হার মেনে নিতে বাধ্য হয়।
দিন-তারিখ ঠিক করে ঘটা করে বিয়ের আয়োজন সম্পূর্ণ করা হয়। বিয়ের পরের দিনেই বরের অসংলগ্ন আচরণে মেধা বুঝতে পারে তার স্বামী মাদকাসক্ত। স্বামী মাদকাসক্ত কিনা তা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে মেধার কয়েক দিন সময় লেগে যায়। একদিন মেধার হাতেই মাদকসহ তার স্বামী ধরা পড়ে। তখন মেধা স্বামীকে মাদকের পথ থেকে ফিরে আসতে বলে। এতেই শুরু হয় তাদের মধ্যে ঝগড়া। মেধাকে তার স্বামী স্পষ্ট বলে দেয়—‘আমি প্রয়োজনে তোমাকে ছেড়ে দেব, কিন্তু মাদক ছাড়তে পারব না।’
এরই মধ্যে মেধার অস্ট্রেলিয়ার ভিসা হয়। সে স্বামী-সংসারের স্বপ্ন নিয়ে বাবা-মা এবং পরিবারের চেনা পরিবেশ ছেড়ে বহুদূরের এক অজানা পরিবেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু মেধার সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়, যখন সে স্বচক্ষে দেখতে পায় তার স্বামী আসলে একজন চরিত্রহীন ও মাদকাসক্ত। সে স্ত্রী-সংসারের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। দিনের পর দিন কোনো কাজ কর্ম না করে, বন্ধুদের বাজে আড্ডা ও মাদকে বুঁদ হয়ে থাকে।
মেধা তার স্বামীকে বাজে আড্ডা ও মাদকের পথ ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে বলে। কখনো কখনো মাদক গ্রহণে বাঁধা দেয়। এতে মেধার স্বামী আরও ক্ষিপ্ত হয়ে মেধার গায়ে হাত তোলা শুরু করে। মাঝে মাঝে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মেধাকে মারধর করে। দিনের পর দিন নির্মম নির্যাতন সহ্য করে, অবশেষে একদিন বাধ্য হয়েই মেধা থানায় কল করে। স্বামীর বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে মারধর ও নির্যাতনের অভিযোগ করে। সেই অভিযোগের কারণে মেধার স্বামীকে কিছুদিন কারাভোগ করতে হয়।
যদিও পরবর্তীতে শর্ত সাপেক্ষে মেধার স্বামী জামিনে মুক্তি পায়। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পর মেধার স্বামী যেন আগের চেয়ে আরও বেশি অত্যাচারী এবং প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে।
মেধা তার পরিবারকে স্বামীর এ অত্যাচারের কথা বারবার জানিয়েছে। কিন্তু বাবার অসম্মতির কারণে সে ডিভোর্স দিতে পারেনি। একদিন মাদকাসক্ত স্বামীর মারধরে মেধা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পরে তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু মেধার জ্ঞান আর কোনো দিন ফেরেনি।