শীতল ভালোবাসা

আকাশে কালো মেঘের এলোমেলো ঝাঁক, পৃথিবীর সঙ্গে গভীর প্রণয়ে মেতে উঠেছে। শুক্লা কাচের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিষাদ ঘেরা ধূসর দিন। বৃষ্টি সব সময় শুক্লাকে অখুশি করে। বৃষ্টি মানে ভোগান্তি, যন্ত্রণা। বৃষ্টির সঙ্গে কোনো কালেই তার সখ্য গড়ে ওঠেনি। বৃষ্টি নামলেই মনের ঘরে হাহাকার বাড়ে। ফেলে আসা স্মৃতি মনের আলপথ ধরে ঝড় তোলে। বাইরে আজ অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। গুমোট অন্ধকার দিন। বৃষ্টির বাড়াবাড়ি দেখে মনে হয়, যেন বৃষ্টির ঢল নেমেছে ধরণিতে। এরই মধ্যে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় না ঘটিয়ে সূর্য উঠলেও, ফ্যাকাশে আলোর পদচারণায় মনের খাঁজে খাঁজে বিষাদ জমেছে। দিনের আলোতেও চারপাশ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সকাল পেরিয়ে দুপুর নামতেই প্রকৃতি যেন তড়িঘড়ি করে অন্ধকারের লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। শীত কিংবা গরম কোনোটাই বেশি অনুভূত না হলেও দুর্দান্ত প্রতাপে বেশ বাতাস বইছিল। এমন দিনে শরীর মনে অসারতা ভর করে। মন চায় ঘরের প্রিয় কোণে বসে বাইরের দিকে অপলক চেয়ে থাকতে, অথবা গরম চায়ের পেয়ালার ওমে প্রিয় বই পড়তে, রবীন্দ্র সংগীত শুনতে। ইচ্ছে ও বাস্তবতার মধ্যে জীবনভর যোজন যোজন ফারাক রয়ে যায়। জীবনের রুঢ় বাস্তবতার কাছে কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছা মলিন হয়ে পড়ে। ইচ্ছার তীব্রতাগুলোকে বুকের গহিনে মাটি চাপা দিয়ে শুক্লা বেরিয়ে পড়ে কাজের উদ্দেশ্যে।

বৃষ্টি শুক্লার অপ্রিয় হলেও, বৃষ্টির ছন্দে তার হাত-পা আজও দুলতে থাকে। ছোটবেলায় ঘরের সাদাকালো টেলিভিশনে বাংলাদেশের বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদের নাচের ক্লাস দেখে দেখে, শুক্লা হুবহু অনুকরণ করে নাচতে পারত। জীবন সংসারের হেঁশেলে সেই কবেই শুক্লার নাচ-গান বাষ্পীভূত হয়ে হারিয়ে গেছে! কিন্তু বৃষ্টি নামলেই হারিয়ে যাওয়া শখ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। 

এমন বৃষ্টিমুখর দিনে শুক্লার বুদ্ধিমতী সহকর্মী নিতু সিক কল করে বাসায় বসে আরাম করছে, আর কিছুক্ষণ পর পর বৃষ্টি দিন উদ্‌যাপনের হরেক রঙের খাবারের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করছে। নিজের ওপর রাগ হয় শুক্লার। জীবনের এত এত বছর পেরিয়ে এসেও, সে হাবাগোবাই রয়ে গেল। শরীর ভালো বোধ না করলেও আজ সারা দিন একাই কাজ করতে হবে শুক্লাকে। ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ বেড়েই চলছে। জিপসি ফুলের মতো ভারী বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে জমিনে। কর্মস্থলে লোকজনের সমাগম কম। শুক্লা আপনমনে স্মৃতির জাবর কাটতে কাটতে হারিয়ে যায় সেদিনের বাসস্ট্যান্ডে।
ঈদের ছুটিতে হোস্টেল বেশ ফাঁকা হয়ে গেলেও, শুক্লা যেতে পারেনি। কয়েকজনের সঙ্গে শুক্লাও থেকে যায় প্রাইভেট পড়ার জন্য। হঠাৎ একদিন দুপুরে তার হোস্টেলের অন্য সহপাঠীরা বাড়ির দিকে রওনা দেয়। বিকেলে শুক্লাও হোস্টেল ত্যাগ করে বাড়ির পথে। সাধারণত শুক্লা বাবার সঙ্গে বাড়ি যায়, সেদিন নিরুপায় হয়ে একাই রওনা দিল।
কলেজ গেটে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে দেখে, পরিচিত মুখ দাঁড়িয়ে আছে। যাকে প্রতিদিন প্রাইভেট পড়তে আসা যাওয়ার পথে শুক্লা দেখে নীরবে চেয়ে থাকতে। পরিচিত মুখ কিন্তু অচেনা। নীরব দৃষ্টি বিনিময় হলেও কখনো কথা হয়নি তার সঙ্গে। সব সময় কলেজ গেটে এ সময় কোলাহল থাকলেও, সেদিন সুনসান নীরবতা বিরাজ করছিল। ছেলেটি শুক্লার কাছে এসে বলল, ‘ আমি তমাল, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল। দয়া করে আমাকে একটু সময় দেবেন, কথাগুলো শুনবেন।’
নিরুত্তর শুক্লা রিকশায় চেপে সোজা বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে। তমালও আরেকটি রিকশা নিয়ে তাকে অনুসরণ করে হাজির হয়। রিকশা থেকে নেমে শুক্লা তাড়াতাড়ি বাসে উঠে বসে। তমালও বাসে উঠে তার পেছনের সিটে বসে। শুক্লার ভয় কেটে যায় লোকারণ্যে। বাস দাঁড়িয়ে আছে। হালকা বৃষ্টি শুরু হয়। শুক্লা বাসের জানালা দিয়ে বিস্তীর্ণ সবুজের গা ঘেঁষে জলের নৃত্য দেখছে। খানিক আগের উজ্জ্বল কমলা রঙের অপরূপ সুন্দর বিকেল মেঘের আড়ালে ঢেকে যায়। শুক্লার মনে হয়, এ যেন আলো-অন্ধকারের লুকোচুরি খেলা। প্রকৃতির মন এবং মানুষের অবস্থানেরও কোনো ঠিক নেই। আজ যে বাড়ি যেতে হবে কয়েক ঘণ্টা আগেও ভাবেনি। বাসের জানালা দিয়ে শুক্লা প্রকৃতির রং বদল দেখছে। বৃষ্টির কারণেই বোধ হয় হকারদের আনাগোনাও চোখে পড়ছে না। শুক্লা জড়সড় হয়ে অপেক্ষা করছে বাস ছাড়ার জন্য।
যাত্রীরা একে একে বাসে উঠছে। কেউবা বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ মনে হচ্ছে যাত্রী সংখ্যা কম। অবশ্য বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের অন্য দিনে যাত্রী সংখ্যা কমই থাকে। তমাল পেছন থেকে শুক্লার মনোযোগ নেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেই যাচ্ছে। নিরুত্তর শুক্লা নীরবে বাইরের পৃথিবী দেখছে। বাস ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে তমাল উঠে এসে শুক্লার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমাকে ঝরনা ভিডিও সেন্টারে পাবে। আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।’
বাস থেকে নেমে তমাল আবার বাসের জানালায় এসে দাঁড়াল। শুক্লা মুখ ফিরিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস চলা শুরু করল। শুক্লা বাসের জানালা দিয়ে ঘাড় বের করে দেখে তমাল করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। শুক্লাকে তাকাতে দেখে তমাল হাত নাড়াল। শুক্লা হাত বের করে তমালের দেওয়া চিরকুট শূন্যে উড়িয়ে দিল। তমাল এক দৃষ্টিতে চিরকুট উড়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকল। বাসের গতি বেড়ে যেতে লাগল, তমালও দৃষ্টি সীমানা থেকে হারিয়ে গেল। তমালের সঙ্গে শুক্লার আর কোনো দিন দেখা হয়নি।
জীবনের এ বেলায় এসে আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলেই শুক্লার ভীষণ তমালের কথা মনে পড়ে। তমালের জন্য শুক্লার মন খারাপ হয়, বুকে চিনচিন ব্যথা অনুভব করে। তমালের মুখে অদ্ভুত রকমের একটা মায়া ছিল, যা আজও শুক্লাকে তাড়িত করে। আজন্মকালের ভিতু শুক্লা তমালের সঙ্গে ভয়ে কোনো কথা বলেনি। চিরকুট পর্যন্ত পড়ে দেখেনি। কী লেখা ছিল তাতে? শুক্লার মনের নির্জনতায় তমাল শীতল মুগ্ধতা হয়ে থেকে গেল।
শীর্ষেন্দুর লেখায় শুক্লা পড়েছিল—‘কেচ্ছা কেলেঙ্কারির মতো বৃষ্টি হচ্ছে।’ লাইনটি পড়ার সময় বৃষ্টির সঙ্গে কেচ্ছার সম্পর্ক কী তখন না বুঝলেও আজ বৃষ্টির গতি দেখে বেশ বুঝতে পারছে। কেচ্ছার মতো বৃষ্টিও ছুটছে অবিরাম গতিতে আয়েশ করে। যে বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে আছে তেপান্তরের পথঘাট, শহরের অলিগলি। একটু দূরের আকাশে ধবধবে ফরসা সিগাল ভেজা শরীরে উড়ছে, গাছের ডালগুলো সুর তুলে বাতাসে দুলছে, সামনের রাস্তায় পথচারী সুন্দর হ্যাট মাথায় কুকুর কোলে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। সভ্যতার চেয়ে ক্ষুধার বয়স বেশি। ক্ষুধায় শুক্লার পেট জ্বলছে। পৃথিবীর কোনো সুন্দর দৃশ্যই এখন আর তার ভালো লাগছে না। বৃষ্টির এমন বাড়াবাড়ি অসহ্য লাগছে। শুক্লা একা কাজ করছে বলে খাবারের জন্য বাইরেও যেতে পারছে না। শরীরও খারাপ লাগছে। জ্বর জ্বর বোধ করছে। সাতটার আগে কোনোভাবেই কাজ থেকে ছাড়া পাবে না। এখন মাত্র বাজে পাঁচটা। শুক্লা অসহায় বোধ করে। বসকে কয়েকবার কল করেও কোনো উত্তর পেল না। তার বস হয়তো ফোনের সুইচ অফ করে সুখ নিদ্রায় আছে।
শুক্লার মনে পড়ে মায়ের কথা। এমন বৃষ্টির দিনে সে ঘুম থেকে উঠতে চাইত না। বৃষ্টির গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুক্লার ঘুম বেড়ে যেত। মা যত ডাকত শুক্লা তত কাঁথা দিয়ে নাকমুখ ঢেকে দিত। মাথায় হাত বুলিয়ে কত আদর করে মা খেতে ডাকত। মাতৃহীন শুক্লা আকাশের দিকে তাকায়, তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। অদ্ভুত একটা শীতল ভালোবাসায় মোড়া বাতাসের ঝাপটা এসে গায়ে লাগে। ভেতর থেকে গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর শুক্লা কাজের ফাঁকে বাসায় কল দেয়। ফোন রিসিভ করেই শুক্লার মেয়ে জানতে চায়, আম্মু তুমি কী খুব ক্ষুধার্ত? অবাক বিস্ময়ে শুক্লা জানতে চায়, তুমি কী করে বুঝলে মা? মেয়ের উত্তর, তোমার ক্লান্ত কণ্ঠস্বর ও দুর্বল নিশ্বাসের শব্দ শুনে বুঝতে পেরেছি। শুক্লা তার ছোট্ট মেয়েটির কথা শুনে ক্ষুধার কথা ভুলে ভাবতে থাকে, জীবন একটি অদ্ভুত চক্র। এই জীবন ফিরে ফিরে আসে। জীবন শুধু ছিনিয়ে নেয় না, মুঠো ভরে দেয়ও। জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে শীতল ভালোবাসা। অজান্তেই জীবনের ভান্ডার ক্রমশই ভরে উঠে প্রাপ্তিতে। ঘুচে যায় যত শূন্যতা। শুক্লার মা হারা শূন্যস্থান পূর্ণ হয়ে ওঠে মেয়ের ভালোবাসায়। মেয়ে তার জীবনের স্রষ্টা প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। শুক্লার মনের সব কষ্ট উবে যায় নিমেষেই। হাতের তালু ভেজা দেখে শুক্লা ভাবছে, এ কি বৃষ্টিভেজা জল নাকি আনন্দাশ্রু? সে যাই হোক জীবনে ওই টুকুই সবচেয়ে বড় পাওয়া হয়ে থাকল।
বাতাসে হিমের দাপাদাপি। চতুর্দিক বাংলাদেশের শীতকালের মতো ধোঁয়াটে হয়ে আছে। শরীর শিন শিন করলেও মেয়ের আদুরে ভাবনায় ডুবে আছে শুক্লা। মেয়ের সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া মায়ের ভালোবাসার অদৃশ্য একটি মিল টের পায় সে। মেয়ের কাছে মায়ের স্বর্গীয় সুখ, মমতা খুঁজে পায়। মেয়ের ভালোবাসার কাছে সব দীর্ঘশ্বাস বিলীন হয়ে যায়। মেয়ের সঙ্গে ফোন রাখার পর থেকে বুকে সুখের তোলপাড় বয়ে চলে। মেয়ে তার বেঁচে থাকার, ভালোবাসার অনুষঙ্গ। মেয়ের মাঝে শুক্লা জীবন প্রবাহ খুঁজে পায়।
আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। যেন অন্তহীন বৃষ্টি নেমেছে আজ। বৃষ্টির সঙ্গে শো শো জোর বাতাসের শব্দে চারপাশ দুলছে। গাড়িগুলো যেন জলপ্রপাত ডিঙিয়ে সামনে এগোচ্ছে। এর মধ্যেই শুক্লা দেখে তার মেয়ে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কাক ভেজা হয়ে খাবার হাতে তার কর্মস্থলে এসে উপস্থিত হয়েছে। খাবার হাতে মেয়েকে এভাবে দেখে, শুক্লা তার অশ্রুসিক্ত চোখ লুকানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। নির্বিকার শুক্লা তার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বর্গীয় শীতল ভালোবাসায়।
শুক্লার কাজ শেষ হতে এখনো খানিকটা দেরি আছে। এতক্ষণ বসে থাকতে কষ্ট হবে ভেবে মেয়েকে বাসায় ফিরে যেতে বলে। শুক্লার মেয়ে নোভা এতে অসম্মতি জানায়। নোভা মাকে নিয়ে বাসায় ফেরার অপেক্ষায় এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে। মায়ের জন্য মেয়ের এমন হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দেখে, শুক্লা যেন সুখের ভেলায় ভাসতে থাকে। তার বুকের ভেতরে এমন দুর্যোগপ্রবণ দিনে, বসন্তের কোকিল ডেকে ওঠে। মনের বাগানে রং বেরঙের ফুল ফোটে। ভাবনার দশ দিক আলো করে পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে। শুক্লা চাঁদের আলোয় স্নান করে। তার মুখ থেকে কেবল আলো গলে গলে পড়ে। আজ জীবনে ভালোবাসার উন্মোচন, উদ্‌যাপনের দিন। ঝিরিঝিরি ভালো লাগার হাওয়ায় শুক্লা ভাসছে। নোভার মুখে শুক্লা নিজেকে দেখে আর ভালোবাসার মহাকাব্য রচনা করে চলে। সে ভালোবাসার এক অতল সমুদ্রে ডুবে ডুবে বহুকাল বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে।

>ঘোরের ভেতর থেকে বের হয়ে শুক্লা আবারও জানালার পর্দা টেনে দিয়ে নোভার রুমে যায়। বিশ্ব চরাচর কাঁপানো আনন্দ বুকে ঘুমন্ত নোভার কপালে চুমু খায়। নোভা অতল ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে আছে। অনেক সময় ধরে শুক্লা আত্মজের ঘুম জড়ানো নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নোভার মুখের দিকে তাকিয়ে শুক্লা তার অতীতে হারিয়ে যায়। ঠিক এভাবে কত দিন ঘুম ভেঙে শুক্লা দেখেছে, মা তার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। জগতের সব মায়েরা যুগ যুগ ধরে সন্তানের মনভূমিতে একইভাবে ভালোবাসার বন্দনা করে চলে। বাঁচার আনন্দ খোঁজে। ভালোবাসায় আশ্রয়ে জড়িয়ে থাকে।


কাজ শেষে শুক্লা ও নোভা একসঙ্গে বাসায় ফিরে আসে। বাসায় ফিরে শুক্লা টের পায় তার জ্বর আসছে। কেঁপে কেঁপে জ্বর আসছে। দুপুর বেলায় কাজের জায়গায় মনে হয়েছে শরীর কাঁপছে। মানুষের কষ্টের দিনে সবার আগে মাকে মনে পড়ে। শুক্লারও আজ তাই হয়েছিল। শুধু মাকে মনে পড়ছিল। নোভার এত কষ্ট করে নেওয়া খাবারও খেতে পারেনি। মুখে বিস্বাদ লাগছিল। খাবারে কোনো ঘ্রাণ না পেয়ে তখনই শুক্লা বুঝেছে, দেহ কোষগুলো বিগড়ে উঠেছে। আবারও মায়ের কথা মনে পড়ে শুক্লার চোখ থেকে পানি ঝরছে। ছোটবেলায় জ্বর এলে মা কত যত্ন করত বুকে জড়িয়ে ধরে। লেবু, ডাল দিয়ে জোর করে ভাত খাওয়াত। ভাত খাওয়ানোর পর ওষুধ খাওয়াত। শুক্লার তখন মনে হতো, দুনিয়ার সবচেয়ে বিরক্তিকর বস্তু মা। শুক্লা তখন মনে মনে প্রার্থনা করত, বড় হয়ে মায়ের থেকে অনেক দূরে চলে যাবে। এত দূরে যাবে যেখানে মা আর তাকে খুঁজে পাবে না। শুক্লাও বেঁচে যাবে মায়ের যত শাসন আর অতিষ্ঠ যন্ত্রণা থেকে৷
শুক্লা সত্যি সত্যি মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। মায়ের জন্য কষ্টে শুক্লার বুকের আলপথ রক্তস্রোতে ভেসে গেলেও, মায়ের দেখা পায় না। আজ মায়ের হাতের ডাল, ভাত খাওয়ার জন্য শুক্লার মন ব্যাকুল বৃষ্টির মতো অঝোরে কাঁদছে। কিন্তু শুক্লার মা নেই।
শুক্লার গায়ের কাঁপুনি বেড়ে চলছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। শক্তি পাচ্ছে না শরীরে। বুক ব্যথা করছে। কোনো মতে কম্বল গায়ে শুক্লা সোফার ওপরে শুয়ে পড়ে। নোভা মাথার নিচে একটা বালিশ এনে দেয়। শুক্লার মায়ের সঙ্গে নোভার অন্তরঙ্গ ভালোবাসা ছিল। নানি-নাতনি মিলে সারা দিন কুটুর কুটুর গল্প করত। মাঝে মধ্যে শুক্লা মজা করে বলত, কিসের এত গল্প করো রাত জেগে? নানির কাছ থেকে নোভা শিখেছে, থার্মোমিটারের বদলে কপালে হাত রেখে কীভাবে জ্বর মাপতে হয়! নানির কাছ থেকে নোভা এমন আরও অনেক কৌশল শিখেছে, যেমন মোবাইল স্ক্রিনে আবহাওয়ার সংবাদ না দেখে, ঘর থেকে জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে তাপমাত্রার পরিমাণ দেখে নেওয়া। একদিন প্রচণ্ড শীতের সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে নোভা যখন এভাবে ঘর থেকে জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে তাপমাত্রা দেখছিল, তখন শুক্লা অবাক হয়ে যায়। পরে জানতে পারে নোভাকে এসব অ্যানালগ কৌশল তার নানি শিখিয়েছে।
আজও নানির থেকে শেখা কৌশল প্রয়োগ করে, নোভা মায়ের মাথায় হাত রেখে বলে, ‘মা অনেক জ্বর এসেছে তোমার।’ ওষুধ খেতে হবে। নোভা তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে যায়। স্লাইস পাউরুটির মধ্যে গ্রেপ জেলি লাগিয়ে নিজ হাতে মাকে খাইয়ে দেয়। কুসুম গরম পানি দিয়ে মুখ মুছে দেয়। জ্বরের ওষুধ নিয়ে আসে। ছোটবেলার মতো শুক্লা খেতে না চাইলে জোর করে ওষুধ খাইয়ে দেয়। তীব্র ভালোবাসার সুখে শুক্লার চোখ আবারও ঝাপসা হয়ে আসে। নোভা মাথার চুলে বিনুনি কাটতে কাটতে মায়ের চোখ মুছে দেয়। বেঁচে থাকার জন্য, জীবনের জন্য শুক্লার বড্ড লোভ হয়। মেয়ের নিষ্পাপ ভালোবাসার শীতলতায় শ্রান্ত, ক্লান্ত শুক্লা ঘুমিয়ে পড়ে।
মেয়ের সেবা-যত্নে শুক্লার জ্বর নেমে যায়। মধ্য রাতে শুক্লার ঘুম ভাঙলে মেয়ের কথা ভেবে বোকার মতো কান্না পায়। দুঃখ পেলেই কাঁদে না, মানুষ সুখেও কাঁদে। এই কান্না সুখের কান্না। নোভা মাকে জড়িয়ে ধরে আছে পরম আদরে। দুর্বল শুক্লা মেয়ের হাত দুটো শক্ত করে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ওর শরীরের স্বর্গীয় ঘ্রাণ নেয়। মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। মেয়েও তার মাকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরে বুকে। ভালোবাসা, নির্ভরতার পরম আশ্রয়ে মেয়ের আদরে শুক্লা ঘুমিয়ে পড়ে। মা-মেয়ের ভালোবাসার আদর মাখা চাদরে মোড়ানো পৃথিবী তখন স্বর্গ হয়ে ওঠে।
শেষ রাতে ঘুম ভেঙে শুক্লা ফুরফুরে, সতেজ বোধ করছে। রাতভর মেয়ের সেবা শুশ্রূষায় শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ফজরের নামাজ শেষে শুক্লা জানালার পর্দা সরিয়ে প্রকৃতির কাঁচা সৌন্দর্য উপভোগ করছে প্রাণভরে। ভোরের হিম হিম হাওয়ায় সুখের গল্পরা বুক সিন্দুকে ভালোবাসার তুমুল আলোড়ন তোলে। আনন্দে বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে। ভেতর বাইরে কে যেন ভালো লাগার বাঁশিতে সুর তোলে। যে সুর জীবনের শাখায় শাখায় ভালোবাসার গল্প বুনে চলে। নিঃসীম শূন্যতায় অপলক তাকিয়ে থাকে শুক্লা। ভালোবাসার ঝালরে ঢেকে আছে গোটা আকাশ। জমিনজুড়ে পড়ছে সে ভালোবাসার উজ্জ্বল ছায়া। সুন্দর-দুচোখ জুড়ে শুধুই সুন্দরের সমাহার। সুন্দরের কাজ একটাই, অসুন্দরকে দূর করে দেওয়া। সুন্দরের কাজ আলো জ্বেলে দেওয়া, ভালোবাসা বিলি করা। অফুরান ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়া জীবনের আর অন্য কোনো মানে নেই। কল্পনার রাজ্যে সাঁতার কাটতে কাটতে শুক্লা ভালোবাসার এক গভীর স্টেশনে এসে পৌঁছেছে।
ঘোরের ভেতর থেকে বের হয়ে শুক্লা আবারও জানালার পর্দা টেনে দিয়ে নোভার রুমে যায়। বিশ্ব চরাচর কাঁপানো আনন্দ বুকে ঘুমন্ত নোভার কপালে চুমু খায়। নোভা অতল ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে আছে। অনেক সময় ধরে শুক্লা আত্মজের ঘুম জড়ানো নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নোভার মুখের দিকে তাকিয়ে শুক্লা তার অতীতে হারিয়ে যায়। ঠিক এভাবে কত দিন ঘুম ভেঙে শুক্লা দেখেছে, মা তার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। জগতের সব মায়েরা যুগ যুগ ধরে সন্তানের মনভূমিতে একইভাবে ভালোবাসার বন্দনা করে চলে। বাঁচার আনন্দ খোঁজে। ভালোবাসায় আশ্রয়ে জড়িয়ে থাকে।
মনের উথাল পাতাল অবস্থা দূরে সরিয়ে শুক্লা নিজের রুমে ফিরে গেলেও, ভালোবাসা উপচে পড়ছে বুকের রেলিঙে। দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দে শুক্লা ভাবতে থাকে জীবন আসলে কী?
জীবন একই সুতোয় গাঁথা একটি ফুলের মালা। জীবনে অনেক ধরনের দিন আসে, ফুল ফোটে, ভালোবাসারা হাসে। যে যেভাবে মালা গাঁথে জীবন সেভাবে প্রস্ফুটিত হয়। যে যেভাবে জীবন বেছে নেয় সেভাবে জীবন আলো বিলায়। জীবন একটি খোলা জানালা। যে যেমন জীবনের চাষ করবে, সে আবহাওয়া এই জানালা দিয়ে জীবনে প্রবেশ করবে। এত এত আদর, স্নেহ, ভালোবাসায় মাখামাখি জীবন উপভোগ করতে পারার জন্য শুক্লা কায়মনোবাক্যে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানায়।
পৃথিবীজুড়ে হরেক রঙের মানুষের বাস। সবার মত, পথ আলাদা। প্রতিটি মানুষ বাঁচার মতো বাঁচতে চায় ভালোবাসার আদরে। কেউ তার সন্ধান পায়, কেউ পায় না। পৃথিবীতে যত না পাওয়া থাকুক, মালিন্যহীন হৃদয়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
কল্পনার দোল চেয়ারে দুলতে দুলতে, শুক্লার মনে জীবনের গূঢ় রহস্য নিয়ে অগণিত ভাবনারা দোল খেতে থাকে। শুক্লার চোখ বন্ধ। সে আরাম পায় তার জীবনকে ভেবে। দেয়াল ঘড়ির সঙ্গে তার বুকের ঘড়িও ঘাসফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে এগিয়ে চলে। শুক্লা ভাবে, বেঁচে থাকাটাই জীবনের বড় প্রাপ্তি, সুখ।
একমাত্র মেয়ে নোভার ভালোবাসায় শুক্লার দিনগুলো যেন একেকটি স্নিগ্ধ কবিতা, আর রাতগুলো হয়ে উঠে প্রশান্তিতে ভরা শীতল ভালোবাসার গল্প।