নিউইয়র্ক টাইমসে ভাষা আন্দোলন

১৯৫২ সালে বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদ পরিবেশন করে এবং একই সঙ্গে পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে, যেখানে তারা বলতে চেয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের এই অশান্তির কারণ শুধু ভাষা নয়, বরং প্রদেশের জন্য বাজেটে অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দ। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদিত পাট-ই পাকিস্তানের মূল বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। এ ছাড়া তখন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই আন্দোলনের জন্য বিদেশি এবং কমিউনিস্টরা দায়ী বলে অভিযোগ তুলতে থাকে।
১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে অনুকরণ করে বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’। খাজা সাহেবের এই ঘোষণায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহলে হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়, যা বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে এসে বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থার সৃষ্টি করে।
উত্তাল সেই সময়ের সব ঘটনা, ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলি নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস–এ বেশ কয়েকটি সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়।

প্রথম সংবাদ

প্রথম সংবাদটি প্রকাশ হয় ১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। করাচি থেকে নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা লেখেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে শাসক কর্তৃক সংবাদপত্র প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা’ [East Pakistan paper is banned by regime]

খবরে বলা হয়, খাজা নাজিমুদ্দিনকে আক্রমণ করে ভাষা আন্দোলন নিয়ে সম্পাদকীয় লেখায় গতরাতে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ঢাকার ইংরেজি দৈনিক দ্য পাকিস্তান অবজারভার–এর প্রকাশনা বন্ধ ঘোষণা করে। পুলিশ প্রকাশক হামিদুল হক চৌধুরী ও সম্পাদক আবদুস ছালামকে গ্রেপ্তার করলেও অবশ্য পরে তাঁদের মুক্তি দেওয়া। সংবাদের পরের অংশে বলা হয়, ‘Crypto Fascism’ বা ‘গুপ্ত ফ্যাসিজম’ শিরোনামে সম্পাদকীয় লেখার জন্যই ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করা হয়।

দ্বিতীয় সংবাদ
২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মিছিলে গুলি হলে ২২ ফেব্রুয়ারি করাচি থেকে যে সংবাদ পাঠানো হয়, তা ছাপা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে। যার শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ২ দিনের দাঙ্গায় নিহত ৬’ [6 slainin 2-day rioting in East Pakistan]। প্রতিবেদনে বলা হয়—
গতকাল ২২ ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ঢাকা থেকে পাওয়া ঘটনার সংবাদকে করাচিতে সংশোধন করে প্রকাশ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সরকার গতকাল সকালে এক প্রেসনোটে জানায়, ৭ হাজার ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের লাঠি ও রিভলবারের আক্রমণে ঘটনাস্থলে একজন নিহত হয় এবং দুজন আহত হয়ে পরে মারা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর চৌধুরী মোহাজ্জান হোসেইন বলেন, আজ ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ ছিল এবং মেডিকেল কলেজের মাঠে অবস্থান করছিল, যেখানে এই ঘটনা ঘটে। সরকার দাবি করছে, ১৮ জন আহত হয়েছে। ছাত্রদের দাবি ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং আহত ৪০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
ছাত্ররা ঘোষণা করেছে, তারা আজ একটি স্মরণ বিক্ষোভ ও চল্লিশ দিনের শোক পালন করবে। পূর্ব পাকিস্তানের রেডিও শিল্পীরা অনুষ্ঠান করতে অস্বীকার করেন এবং গতকাল বিকেলে বেশির ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের সাংসদ ‘পুলিশি বর্বরতার’ প্রতিবাদে পার্লামেন্ট থেকে বের হয়ে আসেন।
গত সপ্তাহে একটি বহুল প্রচারিত ইংরেজি সংবাদপত্র বাতিলের পর পূর্ব পাকিস্তানে সমস্যা দানা বাঁধতে থাকে।

তৃতীয় সংবাদ
নিউইয়র্ক টাইমস–এ পরের সংবাদটি প্রকাশ হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি যার শিরোনাম ছিল, ‘ঢাকার দাঙ্গা বন্ধে সেনা তলব’, শিরোনামের নিচে লাইট শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে আরও একদিন সহিংসতা, সংবাদপত্র অফিসে আগুন’ [Troops called out to end Dacca riots. East Pakistan capital sees another day of violence—Newspaper office burned]। করাচি থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা পাঠানো সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় সহিংসতা দমাতে পুলিশ বাহিনীকে সহায়তা করতে সেনা ইউনিট ডাকা হয়। গতকাল আরও গুলি ও সহিংসতা এবং একটি সংবাদপত্র অফিস পোড়ান হলে সেনা ডাকা হয়। একটি বিশ্বস্ত কিন্তু অসমর্থিত খবরে বলা হয়, আরও পাঁচ ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
গতকালের ঘটনাসহ মোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আটজন এবং আহত হয়েছেন ১০০ জনের বেশি।
পুলিশের কার্যকলাপের প্রতিবাদে গতকাল একটি সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। পুলিশ সব ট্যাক্সি এবং কিছু বাস রিকুইজিশন (অধিযাচন) করেছে এবং রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কারফিউ আরোপ করা হয়েছে।
এখানে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে, গতকাল জনতা ঢাকা মর্নিং নিউজ–এর অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছে। সংবাদপত্রটির মালিক হলেন খাজা নুরুদ্দিন যিনি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ভগ্নিপতি।
পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক দাঙ্গার সূত্রপাত মর্নিং নিউজ–এর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান অবজারভার প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনকে আক্রমণ করে সম্পাদকীয় ছেপেছিল। গতকাল পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্ত পাস করেছে। করাচি সরকার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ হারাবে এই কারণে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণে বিরোধিতা করছিল। সাধারণভাবে মনে করা হয়, বিদেশিরা পাকিস্তানে অশান্ত করতে সাম্প্রতিক সহিংসতায় ভাষা সমস্যাকে ব্যবহার করছে।

চতুর্থ সংবাদ
এই প্রতিবেদনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা করাচি থেকে পাঠান নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা মাইকেল জেমস। রিপোর্টটি করাচি থেকে পাঠানো হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি এবং ছাপা হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি। শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে বিশৃঙ্খলা শেষ, ঘটনার জন্য করাচির ভারতীয় সমর্থনকে ইঙ্গিত, বাজেট নিয়ে অসন্তোষ হেতু’ [Disorders ended in East Pakistan. Karchi hints Indian support the outbreaks—Discontent over budget is factor]।
খবরটির সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ হলো—তিন দিনের সহিংসতার পর পূর্ব পাকিস্তানে অস্বস্তিকর শান্তি এসেছে। সরকার আভাস দিয়েছে, বিদেশিদের প্ররোচনায় এই আন্দোলন হয়েছ, বিদেশি বলতে এখানে ভারতীয়দের বোঝানো হয়েছে। এদিকে গভর্নর জেনারেল পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভাকে বাতিল করেছেন, যারা প্রদেশের নাজুক প্রাদেশিক বাজেট সংকট নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছিল।
এখানে পর্যবেক্ষকগণ মনে করছেন, গত সপ্তাহে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আন্দোলনের শুরু শুধু মাত্র ভাষার জন্যই নয়, বরং প্রাদেশিক বাজেট সংকট প্রশ্নও ছিল।
পাকিস্তানের সব পাট পূর্ব পাকিস্তানে জন্মায় এবং পাট–ই হলো জাতির প্রধান রপ্তানি পণ্য। এই পাটের আয়ের ফলেই পাকিস্তানের অর্থনীতি ভালো অবস্থানে। পাট থেকে যে রাজস্ব আয় হয়, তা চালানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।

অনুপাত হীন হিস্যা
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা মনে করে, পাকিস্তানের রপ্তানি থেকে যে আয় হয় তার আরও বেশি হিস্যা তাদের পাওয়া উচিত। গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের সরকার ঘাটতি বাজেট দিয়েছে যাতে দেখা যায় যে, পাকিস্তানের করাচির কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ করা বাজেট দিয়ে তাদের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব নয়।
এই সংবাদের পরের দিকে বলা হয়, চট্টগ্রামে তিনজন সন্দেহভাজন বিদেশিকে আপত্তিকর কাগজপত্র বিতরণের সময় আটক করা হয়, সরকারি তথ্য তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।

সন্দেহভাজন কলকাতা উৎস
এটি বিশ্বাস করা হয়, কলকাতার বন্ধ হওয়া পাটকলগুলো পাটের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের এই আন্দোলনে অর্থ জোগান দিচ্ছে। সাম্প্রতিক আন্দোলন নিয়ে পাকিস্তানের সরকার ভীত। তারা মনে করে, পূর্ব পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার মানসিকতা জন্ম নিতে পারে।
করাচিতে এটি মনে করা হয়, পাকিস্তানের উন্নয়ন পূর্ব পাকিস্তান ছাড়া চলতে পারে না এবং এই আন্দোলন যেভাবেই হোক সফল হয়েছে। এটা নিশ্চিত যে, অচিরেই বাংলা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে এবং করাচি তাদের দূরবর্তী প্রদেশের জন্য আর্থিক সহায়তার পুনর্বিন্যাস করবে।

পঞ্চম সংবাদ
এই খবরটি নিউইয়র্ক টাইমস–এর নয়াদিল্লি সংবাদদাতা ২৯ ফেব্রুয়ারি পাঠান এবং ১ মার্চ তা ছাপা হয়। সংবাদটিতে ভারতের প্রতি ভাষা আন্দোলনে ভারতীয়দের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। শিরোনাম ছিল, ‘দাঙ্গায় ভারতের ভূমিকা অস্বীকার, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনে ইন্ধন প্রত্যাখ্যান’ [India denies riot role...Rejects charge of inspiring Easdt Pakistan language row]
সংবাদটিতে বলা হয়, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র পাকিস্তানের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রের ভাষা কী হবে, তা নিয়ে ভারতের কোনো স্বার্থ নেই। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন, ভাষা বিতর্ক পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান ও সংখ্যালঘু হিন্দুদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করবে। ইতিমধ্যেই ঢাকায় একাধিক হিন্দুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ষষ্ঠ সংবাদ
নিউইয়র্ক টাইমস–এর পূর্ববর্তী সব সংবাদ করাচি ও নয়াদিল্লি থেকে পাঠানো হলেও এই সংবাদটি নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা মাইকেল জেমস ঢাকা থেকে পাঠিয়েছিলেন ১০ মার্চ, যা ছাপা হয় ১১ মার্চ। সে সময় বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট আতঙ্ক চলছিল এবং ‘লাল’ শব্দটি দিয়ে কমিউনিস্ট বোঝানো হতো। শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে লাল ঝুঁকি দেখা গেছে...বাংলার প্রধানেরা নতুন সৃষ্টি দূরদর্শন করছেন, যদিও সাম্প্রতিক বহিঃপ্রকাশ দমন করা হয়েছ’ [Red danger in East Pakistan...Bengal premier foresees new trouble, through recent outbreaks were curbed]
সংবাদটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ হল এমন—সরকারি কর্মকর্তা ও বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, কমিউনিস্টদের সত্যিকার প্ররোচনায় ২১ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি সহিংসতা হয়েছিল যা পাকিস্তান সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পেরেছে।
ঝামেলার সূত্রপাত হয় যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা না করায় আন্দোলন করছিল। সবাই সাধারণভাবে একমত, এটি ছিল একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন। কিন্তু কমিউনিস্টরা তাদের কলাকৌলশ প্রয়োগ করে আন্দোলনকে সাংঘর্ষিক করে তোলে এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটি সহিংসতায় রূপ নেয় যার ফলে অনেক মানুষ প্রাণ হারায়।

আরও ঝামেলার আশঙ্কা
পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন, ফিরোজ খান নুনের সঙ্গে একমত হন, কমিউনিস্টরাই এই অসন্তোষের জন্য দায়ী। ফিরোজ খান মনে করেন, এই আন্দোলন এখানেই শেষ। তবে নুরুল আমিন মনে করেন, করাচি যদি বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি না দেয় তবে দুই তিন মাসেই আন্দোলন আবার শুরু হবে।
দেশ বিভক্ত হওয়ার সময় বাঙালিদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। মেধাবী হিন্দুরা বেশির ভাগই ভারতে চলে গেলে স্থানীয় মেধাবীদের অভাবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সে সব জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়।
বাংলা ও উর্দু ভাষা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ অসন্তোষ চলছিল। তবে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত আগুন জ্বলে ওঠেনি যত দিন পর্যন্ত না প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা, তারা পছন্দ করুক আর না করুক।’

লেখক: আবদুল্লাহ জাহিদ, গল্পকার ও কুইন্স লাইব্রেরি হলিস, নিউইয়র্ক শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]