প্রসঙ্গ: ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) ছুটি

আমেরিকায় ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)’–এর দিনে ফেডারেল হলিডে ক্যাম্পেইন নিয়ে ব্যাপক জনসংযোগ চলছে। নিউইয়র্কের মিনি বাংলাদেশ জ্যাকসন হাইটসের মোহাম্মদী কমিউনিটি সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আমি স্থানীয় আন্তঃধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও জন্মসূত্রে আমেরিকায় আমাদের নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে জলসা, জুলুশ, মাহফিল ও একটি ঐতিহাসিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঈদে মিলাদুন্নবীতে সরকারি ছুটি মঞ্জুরির দাবি জানিয়ে আসছে।
নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন শহরে ২০১২ সাল থেকে অনুষ্ঠিত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্‌যাপন এবং এদিন ছুটির দাবিকে সমর্থন এখন নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এ দাবি এখন নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যেও উত্থাপিত হয়েছে। জার্সি সিটির সিটি হল ও স্থানীয় সুন্নি রিজভী ইসলামিক সেন্টার ও জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে আমি নিজে প্রস্তাবটি তুলেছি।
২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বরনিউজার্সির জার্সি সিটি হল ও স্থানীয় সুন্নি রিজভী ইসলামিক সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. রফীক চৌধুরী ঈদে মিলাদুন্নবীতে (সা.) সরকারি ছুটির ঐতিহাসিক এই দাবির প্রস্তাবটি সেই রাজ্যে উত্থাপনের জন্য আমার কাছে অনুরোধ জানান। তাঁর অনুরোধে আমরা সেখানে ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) শোভাযাত্রা শেষে জোহরের নামাজের আগে প্রথমে সিটি হলে ও পরে ইসলামিক সেন্টারে সমবেত মুসল্লি ও প্রেস কমিউনিটির সামনে ঐতিহাসিক এ দাবিটি উত্থাপন করি। এতে নারী-পুরুষ, দলমত ও ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে দাবিটির প্রতি সবার স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লক্ষ্য করা যায়।
নাইন–ইলেভেনের পর ২০০৫ সালে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে মোহাম্মদী সেন্টার প্রতিষ্ঠা ও এর মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদবিরোধী সচেতনতা, নিউইয়র্ক ঈদগাহ প্রতিষ্ঠা, আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি স্থাপন ও জ্যাকসন হাইটসে ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) প্রচলন ও ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) দিনে সারা আমেরিকায় সরকারি ছুটির দাবি ও মঞ্জুরি পর্যন্ত ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।
মহান আল্লাহর পবিত্র মহাগ্রন্থ আল-কোরআন যেভাবে ‘হুদাল্লিন্নাস’ অর্থাৎ ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে পুরো মানব জাতির জন্য পথনির্দেশনা দানকারী গাইড, নবী মোহাম্মদ (সা.) তদ্রূপ শুধু ইসলাম ধর্ম অনুসারীদেরই নন, বরং সব মানবতার তরে ‘রাহমাতাল্লিল আলামিন’ অর্থাৎ ত্রিভুবনের সবার দয়ার নবী হিসেবেই প্রেরিত হয়েছেন।
যেহেতু নবী মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) জাত–ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য নবী হয়ে প্রেরিত হয়েছেন, তাই ২০১২ সালে ঈদে মিলাদুন্নবীতে (সা.) সরকারি ছুটি মঞ্জুরির ঐতিহাসিক প্রচার শুরুর প্রাক্কালে আমরা স্থানীয় জুইশ সেন্টার, চার্চ, গুরুদুয়ারা, মন্দির ও কাউন্সিল মেম্বারের সমর্থন লাভে সমর্থ হয়েছি। মূল দরখাস্তে নিজ নিজ সেন্টারের ধর্মীয় গুরুরা স্বাচ্ছন্দ্যে আমাদের দাবির সংবলিত আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন। এ সময় সংবাদ সম্মেলনে আসা পশ্চিমা সাংবাদিকেরা রিপোর্টটি লেখার আগে স্থানীয় জুইশ সেন্টারের প্রেসিডেন্ট স্টিভ নবেলকে প্রশ্ন করেন, একজন ইহুদি হয়ে নবী মোহাম্মদ (সা.)–এর জন্মদিন ঈদে মিলাদুন্নবীতে ফেডারেল হলিডে সমর্থন করার কারণ কি? তিনি অকপটে বলেন, ‘আমরা আমাদের নবী হজরত মুসার (আ.) জন্মদিনের সঠিক তথ্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নই। মুসলমানরা ভাগ্যবান, তারা তাদের নবীর জন্মদিন সম্বন্ধে অবহিত।’
রিপোর্টার নবেলকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, এ ছুটি মঞ্জুর হলে আপনি খুশি হবেন? হলে কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে স্টিভ নবেল বলেন, আমি আরেকটি দিন বিনা কাজে কাটাব, বাসায় বসে আনন্দ করব, এটা কি আমার ও আমার পরিবারের কাছে আনন্দের বিষয় নয়?

>ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপনের বৈকালিক সেশনের আন্তধর্মীয় সমাবেশে স্থানীয় সিনেটর হোজে পারাল্টা, অ্যাসেম্বলিম্যান ফ্রান্সিসকো মোইয়া, বিচারপতি থমাস রাফায়েল, এনওয়াইপিডির ডিটেকটিভ টরোসহ ভারত, নেপাল ও অন্যান্য দেশের আন্তঃধর্মীয় নেতৃবৃন্দ নবী মোহাম্মদ (সা)–এর জীবনী, শিক্ষা ও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্‌যাপনের ওপর সারগর্ভ আলোচনা করেন। সেদিনের সেই দৃশ্যটির অবলোকনে এমনি মনে হয়েছিল, মহান আল্লাহ যথার্থই বলেছেন, ‘ওয়ামা-আরসালনা-কা ইল্লা-রাহমাতাল্লিল আ-লামীন’—হে নবী আপনাকে আমি সারা বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।


স্থানীয় গ্রিক চার্চের পাদরি আয়াকোভস কোওস্তাকিস, যিনি ২০১১ সালে মোহাম্মদী সেন্টার কর্তৃক আয়োজিত জ্যাকসন হাইটসের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) শোভাযাত্রা ও আন্তঃধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উদ্‌যাপনে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে উপস্থিত হন এবং ছুটির মূল পিটিশনে স্বাক্ষর করেন। তিনি বলেন, সেন্টারের কর্মতৎপরতা আমার কাছে ভালো লাগে, তাই আমি পিটিশনটিতে স্বাক্ষর করে দিয়েছি। এমন ছুটির প্রতি আমাদের সমর্থন আছে।
স্থানীয় গুরু রবি দাস মন্দিরের পণ্ডিতেরা বলেন, ‘ভারতের শান্তি প্রিয় মুসলমানদের আমরা ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করতে দেখেছি। তাই যেখানেই ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) থাকবে, সেখানেও আমাদের সমর্থনও থাকবে।’
তা ছাড়া নিউইয়র্কের বাংলাদেশ হিন্দু মন্দিরের পণ্ডিত গুরু শংকর পারিয়াল ও বাংলাদেশি খ্রিষ্টান চার্চের পাদরি জেমস রায়, যিনি মোহাম্মদী সেন্টারের আন্তধর্মীয় প্রোগ্রামের একজন নিয়মিত সম্মানিত অতিথি, তিনি ঈদে মিলাদুন্নবীতে (সা.) সরকারি ছুটির প্রতি তাঁদের পুরো সমর্থন জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, নিউইয়র্কের মিনি বাংলাদেশ বলে পরিচিত প্রবাসী বাংলাদেশিদের ঘনবসতিপূর্ণ শহর জ্যাকসন হাইটসে ২০০৫ সালে মোহাম্মদী সেন্টারের কার্যক্রম শুরুর ৬ বছর পর ২০১১ সালে জ্যাকসন হাইটসে প্রথম ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) জলসা, জুলুস ও মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় মোহাম্মদী সেন্টারের আয়োজনেই। ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) ওই ঐতিহাসিক শোভাযাত্রায় বাংলাদেশি ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, সুরিনাম (বিশ্বের একমাত্র অমুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে ঈদে মিলাদুন্নবীতে সরকারি ছুটি রয়েছে), আমেরিকান, আরব ও আফ্রিকার মুসলমানরা যোগ দিয়েছিলেন।
স্থানীয় কাউন্সিল মেম্বার ড্যানিয়েল ড্রম, কুইন্স সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি থমাস রাফায়েল ঈদে মিলাদুন্নবীর শোভাযাত্রার ওই ব্যানারটি ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্‌যাপন ও জ্যাকসন হাইটস মুসলিম কমিউনিটির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে নিজ হাতে নিয়ে শোভাযাত্রার অংশ নিয়ে সৌন্দর্য বর্ধন করেছিলেন, যা আমেরিকায় ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্‌যাপনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষর হয়ে লেখা থাকবে।
ওই দিন ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপনের বৈকালিক সেশনের আন্তধর্মীয় সমাবেশে স্থানীয় সিনেটর হোজে পারাল্টা, অ্যাসেম্বলিম্যান ফ্রান্সিসকো মোইয়া, বিচারপতি থমাস রাফায়েল, এনওয়াইপিডির ডিটেকটিভ টরোসহ ভারত, নেপাল ও অন্যান্য দেশের আন্তঃধর্মীয় নেতৃবৃন্দ নবী মোহাম্মদ (সা)–এর জীবনী, শিক্ষা ও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্‌যাপনের ওপর সারগর্ভ আলোচনা করেন। সেদিনের সেই দৃশ্যটির অবলোকনে এমনি মনে হয়েছিল, মহান আল্লাহ যথার্থই বলেছেন, ‘ওয়ামা-আরসালনা-কা ইল্লা-রাহমাতাল্লিল আ-লামীন’—হে নবী আপনাকে আমি সারা বিশ্বের জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।
জাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সেদিন প্রমাণিত হয়েছিল, আমরা সবাই নবী মোহাম্মদ (সা.)–এর উম্মত। জ্যাকসন হাইটসের ৩৭-৪৬ ৭২ স্ট্রিটের ঠিকানায় অবস্থিত মোহাম্মদী সেন্টারের ভাড়া বাড়িটি ফেব্রুয়ারির শিশির ভেজা দিনেও ছিল আলো ঝলমল।