বেছে নিন নিজের পছন্দের কাজটি

কম্পিউটার বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও লেখক ড. রাগিব হাসান। ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হন। পরে পুরো বুয়েটে সব বিভাগের মধ্যে শীর্ষ ফল নিয়ে পাস করেন তিনি। বাংলা ভাষায় প্রথম অনলাইন শিক্ষা ওয়েবসাইটের এ জনক বর্তমানে শিক্ষকতা করছেন ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহামে। সম্প্রতি নিজের ব্যক্তিগত ও কর্মজীবন নিয়ে তিনি কথা বলেন প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ মোক্তাদির।
পরিবারের সঙ্গে রাগিব হাসান
পরিবারের সঙ্গে রাগিব হাসান

প্রথম আলো: আপনার ব্যক্তিগত জীবন দিয়েই শুরু করা যাক।
রাগিব হাসান: দেশের বাড়ি জামালপুরে। তবে আমার জন্ম চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে এবং সেখানেই বেড়ে ওঠা। বাবা মো. শামসুল হুদা ছিলেন চট্টগ্রামের সরকারি শিপিং অফিসের প্রধান। মা রেবেকা সুলতানা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। ২০০৩ সালে বিয়ে করি। আমার স্ত্রী ডা. জারিয়া আফরিন চৌধুরী ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছেন এবং পরে ইউএসএমএলই পাস করার পর ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহাম হাসপাতালে সাইকিয়াট্রিতে রেসিডেন্সি শেষ করেছেন। তিনি বর্তমানে বার্মিংহামেরই ব্রুকউড হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট কর্মরত। নয় বছরের ছেলে যায়ান ও চার বছরের মেয়ে রিনীতা যোয়ীকে নিয়ে বার্মিংহাম শহরে চলছে আমাদের জীবন।
প্রথম আলো: আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে পাঠকদের কিছু বলুন...
রাগিব হাসান: আমি পড়েছি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। সেখান থেকে ১৯৯৪ সালে কুমিল্লা বোর্ড থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অর্জন করি। ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে চট্টগ্রাম বোর্ডে সম্মিলিত মেধাতালিকায় বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম স্থান নিয়ে এইচএসসি পাস করি। তারপর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার মেধাতালিকায় প্রথম হই। ভর্তি হই বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে। ২০০২ সালে বুয়েট থেকে নিজ বিভাগ এবং পুরো বুয়েটের সব বিভাগের মধ্যে রেজাল্টের দিক দিয়ে প্রথম স্থান অর্জন করি। এ জন্য কম্পিউটার কৌশল বিভাগ থেকে গোল্ড মেডেল ও বুয়েট থেকে চ্যান্সেলর পুরস্কার পাই।
প্রথম আলো: বুয়েটে পড়াকালে উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি...
রাগিব হাসান: কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে যখন ভর্তি হই, তখন দেশে এ বিভাগ ছিল বেশ নতুন। দেশে তখন ইন্টারনেট ব্যবস্থাও সহজলভ্য ছিল না। আর থাকলেও তা ছিল খুবই ধীর গতির। এসব সমস্যা পাশ কাটিয়েই আমাদের ভালো করতে হয়েছে। আমার শিক্ষক শ্রদ্ধেয় ড. কায়কোবাদ স্যারের কথা বিশেষভাবে বলতে চাই। স্যার আমাদের গবেষণা ও প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু হাতে-কলমে শিখিয়েছিলেন। তাঁর জন্যই স্নাতক পর্যায়েই গবেষণার সঙ্গে পরিচয় হয়। জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করি। কায়কোবাদ স্যার শিক্ষার্থীদের জন্য এত নিবেদিতপ্রাণ যে, বাসায় ডেকে নাশতা খাইয়ে গবেষণা শেখাতেন হাতে ধরে। আমি থাকতাম বুয়েটের হলে। একদিন খুব ভোরবেলায় দেখি কে যেন দরজায় কড়া নাড়ছেন। ঘুম ঘুম চোখে ‘কে?’ প্রশ্ন করে জবাব পেলাম, ‘আমি কায়কোবাদ। পড়াশোনা আর গবেষণা কেমন হচ্ছে দেখতে এসেছি।’ গবেষণায় স্যারই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন।
প্রথম আলো: বুয়েট থেকে পাস করে বের হয়ে কী করেছিলেন?
রাগিব হাসান: ছোটবেলা থেকেই আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষক ও বিজ্ঞানী/গবেষক হওয়া। ২০০৩ সালে বুয়েটে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দিই। প্রায় ৬ মাসের মতো শিক্ষকতা করার পর ২০০৩ সালের আগস্ট মাসে কম্পিউটার নিরাপত্তার ওপর পিএইচডি করতে আমেরিকার সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আরবানা শ্যাম্পেইনে ভর্তি হই। সেখান থেকে ২০০৫ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানে মাস্টার্স এবং ২০০৯ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করি। পিএইচডির বিষয় ছিল কীভাবে কম্পিউটারের তথ্য ও ডেটাবেইজকে আরও নিরাপদ করা যায়। পিএইচডি গবেষণা চলাকালীন ২০০৭ সালে গুগলের প্রধান কার্যালয়ে তিন মাসের ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ হয়। পিএইচডি সম্পন্নের পর নতুন একটি আইডিয়া নিয়ে আমেরিকার সরকারি বিজ্ঞান সংস্থা ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনে একটি গবেষণা প্রস্তাব জমা দিয়েছিলাম। তার ভিত্তিতে সেখান থেকে কম্পিউটিং ইনোভেশন ফেলোশিপ অর্জন করি। মোট ৫২৫ জন আবেদনকারীর মধ্যে মাত্র ৬০ জন এ ফেলোশিপ পেয়েছিল। সেই ফেলোশিপ নিয়ে তারপর ক্লাউড কম্পিউটিং এবং কম্পিউটার নিরাপত্তার ওপর পোস্ট ডক্টরেট করতে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক ও কম্পিউটার বিজ্ঞানী হিসেবে দু বছর গবেষণা করি। ২০১১ সালে বর্তমান কর্মস্থল ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহামে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিই। এখন আমি সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে সেখানেই শিক্ষকতা ও গবেষণা করছি। এখানে সিক্রেট ল্যাব নামের একটি গবেষণাগার গড়ে তুলেছি, যেখানে সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে গবেষণা করা হয়। ১০ জনেরও অধিক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষক এখানে আমার অধীনে গবেষণা করেছে।
প্রথম আলো: উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় আসার পর অনেকে অনেক রকম সমস্যায় পড়েন। আপনার কি কোনো রকম সমস্যায় পড়তে হয়েছিল?
রাগিব হাসান: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা মুখস্থনির্ভর। আর আমেরিকায় সাধারণত শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দেওয়া হয়। এ বিষয়গুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে প্রথম দিকে একটু-আধটু সময় লেগেছিল। কিন্তু পরে ভাষা ও সংস্কৃতি সবকিছুর সঙ্গেই অভ্যস্ত হয়ে যাই।

প্রথম আলো: আপনার অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সুযোগ ছিল হয়তো। কিন্তু শিক্ষকতা বা বৈজ্ঞানিক হওয়ার পথ বেছে নিলেন কেন?
রাগিব হাসান: আমি কীভাবে বিজ্ঞানে আগ্রহী হলাম বা বৈজ্ঞানিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, তার পেছনে একটা মজার কাহিনি আছে। খুব ছোটবেলায় আমি একসময় ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিনের লেখা ‘আবিষ্কারের নেশায়’ বইটা পড়ি, যাতে বিজ্ঞানীদের কথা লেখা ছিল। আমার বয়স তখন ৬/৭ বছরের মতো। সেটা পড়ে তখনই সিদ্ধান্ত নিই, বড় হয়ে আমি বিজ্ঞানী হব। আমার পাড়ার বন্ধুরা এই কথা শুনে হাসাহাসি করত। কারণ, সবাই যখন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অথবা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিসিএস অফিসার হবে বলে চিন্তা করে, আমি সেই সময়ে বিজ্ঞানী হতে চাইছি। ঠাট্টা করে আমাকে ‘পঁচা ডিমের বিজ্ঞানী’ বলে অনেক ক্ষেপিয়েছিল তারা। কিন্তু আমার ধ্যান-জ্ঞান ছিল এই বিজ্ঞানী হওয়া। বর্তমানে কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে পেরেছি। ছোটবেলার স্বপ্নটা সফল হয়েছে সেই অর্থে। আর এ জন্যই আমি চেষ্টা করছি, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কথা শিশুকিশোরদের কাছে পৌঁছে দিতে, যাতে আমাদের দেশে আরও অনেক বিজ্ঞানী তৈরি হয়।
শিক্ষকতা আমার পেশাই কেবল নয়, নেশাও বটে। এক ক্লাস ভর্তি আগ্রহী শিক্ষার্থীর কাছে জ্ঞানের জগৎটাকে তুলে ধরতে, তাদের মনের জানালা খুলে দিতে একজন শিক্ষক হিসেবে যে আনন্দ পাই, মিলিয়ন ডলারের অন্য চাকরিও তার সমকক্ষ না আমার কাছে। আর আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার কাজটা শিক্ষক হিসেবে করতে পারি, সেটা অনেক আনন্দের কাজ। বাংলাদেশের জন্যও অনেক কিছু করতে পারছি এভাবে, বহু দূরে থেকেও। আমার তত্ত্বাবধানে চারজন বাংলাদেশি ছাত্র পিএইচডি করেছে। এদের দুজন আমেরিকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছে। বাকি দুজন রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে আছে। আমার অধীনে মাস্টার্স করা পাঁচজন ছাত্র গুগল, ফেসবুক, আমাজন, মাইক্রোসফট ও ভিএমওয়ারে কাজ করছে এখন। বর্তমানে তিনজন শিক্ষার্থী আমার অধীনে পিএইচডি করছে। নতুন কিছু আবিষ্কার করা, মানবজাতির কল্যাণের জন্য উদ্ভাবন করা—এমন গবেষণার মজাই আলাদা। নিজের কাজে আনন্দ খুঁজে পাই বলেই শিক্ষক ও গবেষক/বিজ্ঞানী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে পেরে আমি সন্তুষ্ট।
প্রথম আলো: দেশের শিক্ষার্থীদের সামনে এগিয়ে নিতে বা বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে আপনার উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ যদি পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করেন...
রাগিব হাসান: দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১২ সালের আগস্ট মাসে বাংলা ভাষায় প্রথম অনলাইন এডুকেশন ওয়েবসাইট (www.shikkhok.com) তৈরি করি। ‘বাংলায় অনলাইনে মুক্ত জ্ঞানের মেলা’ স্লোগানে চলতে থাকা ওয়েবসাইটটিতে এখন প্রায় ৭৫টির মতো কোর্স চালু রয়েছে। সাইটটিতে যুক্ত হয়ে যে কেউ বিনা মূল্যে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবেন। বর্তমানে নানা বিষয়ের মধ্যে সাইটটিতে রয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান, ক্লাউড কম্পিউটিং, তড়িৎকৌশল, ফিন্যান্স, বায়োইনফরমেটিক্স, ক্যালকুলাস, সি প্রোগ্রামিং, রান্নাসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেকচারসহ ভিডিও টিউটোরিয়াল। শিক্ষা খাতে এমন অবদানের জন্য ২০১৩ সালে বিশ্বখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলের ‘রাইজ’ পুরস্কার পেয়েছে শিক্ষক ডট কম। গুগলের শিক্ষা খাতের উন্নয়নে বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয়ে পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই গুগল রাইজ পুরস্কার দেওয়া হয়। বাংলাদেশ থেকে শিক্ষক ডট কম এ পুরস্কার প্রথম লাভ করে। তা ছাড়া বাংলা ভাষাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ইন্টারনেটে মুক্ত বিশ্বকোষ বাংলা উইকিপিডিয়ার বুরোক্র্যাট ও ইংরেজি উইকিপিডিয়ার প্রশাসক হিসেবে কাজ করছি। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার জন্য বাংলা ব্রেইল প্রকল্প চালু করি।
প্রথম আলো: উইকিপিডিয়ার সঙ্গে জড়ালেন কীভাবে?
রাগিব হাসান: ২০০৪ সালে পিএইচডি করার সময় উইকিপিডিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। বাংলা ও ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় কাজ করার পেছনে আমার অনুপ্রেরণা ছিল দু রকম। ২০০৪ সালে ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় কাজ শুরুর পর দেখি, সেখানে বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য নেই বললেই চলে, আর যেটুকু ছিল তার মধ্যে অনেক ভুল ছিল। যেমন, পাকিস্তানিরা সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা মাত্র কয়েক হাজার বলে চালিয়ে দিত। বাংলা আমার মায়ের ভাষা, অথচ সেটায় মুক্ত বিশ্বকোষ ভালো করে নেই। তাই ইংরেজি উইকিতে বাংলাদেশের নিবন্ধগুলো গুছিয়ে নেওয়ার পর ২০০৬ সালে বাংলা উইকিপিডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করি। দেশে প্রচুর সাড়া পাই, প্রচুর উৎসাহী কর্মীর সহায়তা পাই। বর্তমানে বাংলাদেশে উইকিপিডিয়ায় প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন। তাঁদের হাতেই গড়ে উঠেছে জনমানুষের এই বিশ্বকোষ।
প্রথম আলো: দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বাংলা ব্রেইল প্রকল্প নিয়ে কাজ করার ভাবনার শুরু কীভাবে?
রাগিব হাসান: ব্রেইল হলো অন্ধ ও যারা চোখে কম দেখে, তাদের জন্য পড়ালেখার একটি মাধ্যম। ১৮২১ সালে লুই ব্রেইল নামে ফ্রান্সের একজন প্রতিবন্ধী এটি উদ্ভাবন করেন। আমার নেতৃত্বে একদল স্বেচ্ছাসেবী অনলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের কয়েক হাজার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর জন্য ব্রেইল ও অডিও বুক তৈরি করছেন। জার্মান বেতার সংস্থা ডয়চেভেলে আয়োজিত দ্য বেস্ট অব ব্লগস (ববস) প্রতিযোগিতায় ২০১৪ সালে ‘সেরা উদ্ভাবন’ বিভাগে ‘জুরি’ ও ‘পিপলস চয়েস’ পুরস্কার পেয়েছে বাংলা ব্রেইল প্রকল্প।
প্রথম আলো: আপনার দৃষ্টিতে নিজের কোন গবেষণা বা আবিষ্কারকে এগিয়ে রাখবেন?
রাগিব হাসান: আমি মূলত কাজ করি সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা নিরাপত্তা বা সিকিউরিটির সমস্যাকে কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়েই গবেষণা করি। এ ছাড়া কাজ করি ক্লাউড কম্পিউটিং ও বিগ ডেটা নিয়ে। আমার সাম্প্রতিক একটা গবেষণার কথা বলি, হঠাৎ মাথায় এল ব্যাগে করে ল্যাপটপ বা হাতে স্মার্টফোন নিয়ে ঘোরার বদলে যদি আমাদের পরনের কাপড়টাই স্মার্ট হতো, তাহলে কেমন হয়? সেই ভাবনা থেকেই বানিয়ে ফেললাম ক্লাউড জ্যাকেট, যার মধ্যে ১০টি কম্পিউটার দিয়ে তৈরি একটি পূর্ণাঙ্গ ক্লাউড বসানো ছিল। স্মার্ট জ্যাকেট বা অন্যান্য পরিধেয়র সুবিধাটা হলো আলাদা করে কম্পিউটার বা স্মার্টফোন বয়ে বেড়ানোর দরকার হবে না। আর শার্ট বা জ্যাকেট নানা সেন্সরের মাধ্যমে মানুষের দেহের সবকিছু সারাক্ষণ খেয়াল রাখতে পারবে। হৃদ্‌রোগ বা এমন কোনো অসুখ গুরুতর রূপ নেওয়ার আগেই স্মার্ট শার্টই সেটা বুঝতে পারবে। আমাদের এই কাজ আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের (এনএসএফ) ওয়েবসাইটের প্রথম পাতায় দেখানো হয়েছিল খুব গুরুত্বের সঙ্গে।
প্রথম আলো: গবেষণা আপনার ধ্যানজ্ঞান। গবেষণায় অবদানের জন্য কী কোনো পুরস্কার পেয়েছেন?
রাগিব হাসান: ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে নিরাপত্তার ওপর গবেষণার জন্য ২০১৪ সালে আমেরিকার এনএসএফের ‘ক্যারিয়ার অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কার পাই। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ‘ফ্যাকাল্টি আর্লি ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট’ কর্মসূচির আওতায় সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারের একটি। পুরস্কারের অর্থমূল্য ছিল ৪ লাখ ৮৫ হাজার ডলার। শিক্ষকতায় যোগদানের দু বছরের মাথায় এ পুরস্কার আমাকে গবেষণায় এগিয়ে যেতে অনেক সাহায্য করেছে। তা ছাড়া গুগল থেকে ২০১৩ সালে গুগল ফ্যাকাল্টি রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পাই। আমার গবেষণাকাজের জন্য আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের অনুদান পেয়েছি।
প্রথম আলো: লেখালেখির প্রতি আপনার অনেক আগ্রহ। আপনার বেশ কয়েকটি বই পাঠকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ নিয়ে পরিকল্পনা কী?
রাগিব হাসান: আমি বাংলা ব্লগে ও অন্যত্র লেখালেখি করি সেই ২০০৪ সাল থেকেই। ফেসবুকে ও ব্লগে প্রায়ই গবেষণা, বিজ্ঞান নিয়ে নিয়মিত লিখি। এ থেকেই চিন্তা করলাম আমার লেখাগুলো বই আকারে বের করলে আরও বেশি মানুষ উপকৃত হবে। এ পর্যন্ত আমার ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার ওপর ইংরেজি ভাষায় বই ও অনেক আর্টিকেল আছে। কিন্তু গবেষণা কীভাবে করতে হয় বা এর খুঁটিনাটি নিয়ে বাংলা ভাষায় কোনো বই নেই। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রতি আগ্রহ তৈরির জন্য ২০১৫ সালে ‘গবেষণায় হাতেখড়ি’ নামে বইটি লিখি। একই বছর ‘মন প্রকৌশল’ নামে আমার আরেকটি বই প্রকাশিত হয়। ২০১৫ সালের একুশে বইমেলায় আমার এ দুটি বই বেস্ট সেলারের তালিকায় প্রথম তিনের মধ্যে ছিল। ২০১৬ সালে ‘বিদ্যাকৌশল’ নামে বই প্রকাশ হয়, যাতে পড়াশোনায় ভালো করার জন্য শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পরামর্শমূলক তথ্য দেওয়া হয়। শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরির জন্য ২০১৮ সালে ‘বিজ্ঞানীদের কাণ্ডকারখানা’ নামে বই প্রকাশ করি। ২০১৯ ও ২০২০ সালে এ বইয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। এই বইগুলো লেখার পেছনে আরেকটা কাহিনি আছে। আমার আর জারিয়ার ছেলেমেয়ে যায়ান ও যোয়ীকে ঘুম পাড়ানোর আগে গল্প শোনাতে হয় প্রতি রাতে। ওদের দুজনেরই বিস্তর আগ্রহ বিজ্ঞানের ও বিজ্ঞানীদের গল্প শোনায়। প্রতি দিন ওদের বিজ্ঞানীদের নানা আবিষ্কারের পেছনের মজার সব গল্প শোনাতে হয়। আমি ভাবলাম, এই গল্পগুলো যদি আরও অনেক বাচ্চার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থেকে আরও অনেক বিজ্ঞানী তৈরি হবে। সে জন্যই বিজ্ঞানীদের কাণ্ডকারখানা সিরিজের বইগুলো লিখছি। আমার খুব ভালো লাগে এটা ভেবে যে, এই বইগুলোতে আইনস্টাইন, নিউটনের পাশাপাশি বাংলাদেশের বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, প্রকৌশলী ফজলুর রহমান খানের কথা লিখতে পেরেছি, যা দেখে বাংলাদেশের শিশু কিশোরেরা বুঝতে পারবে, বাংলাদেশেও প্রথিতযশা সব বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছিল।
প্রথম আলো: কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে পড়া শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আপনার কোনো পরামর্শ...
রাগিব হাসান: কম্পিউটার বিজ্ঞান হচ্ছে এমন একটি শাখা, যেখানে মুখস্থের ওপর নির্ভর করে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বেসিক খুব ভালো করে গড়ে তুলতে হবে। কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে পড়া একজন শিক্ষার্থীকে অ্যালগরিদম, ডেটা স্ট্রাকচারের মতো বিষয়ে ভালো দক্ষতা অর্জন করতে হবে। প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের ক্ষেত্রে দেখা যায়, একেক সময় একেকটি জনপ্রিয়। তাই কম্পিউটার বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব, অ্যালগরিদম ইত্যাদি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকলে কখনো পিছিয়ে পড়তে হবে না।
প্রথম আলো: অনেকেই হুজুগে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ভর্তি হওয়ার পর পরে ভালো না লাগায় হতাশায় ভোগে। তাদের জন্য কোনো পরামর্শ দেবেন?
রাগিব হাসান: কম্পিউটার বিজ্ঞান হলো অনেক বিশাল একটি বিষয়, যার অনেক শাখা রয়েছে। সবাই যে সব শাখায় ভালো হবে, তা ধরে নিলে ভুল হবে। আর কম্পিউটার বিজ্ঞান মানেই যে শুধু প্রোগ্রামিংয়ে ভালো হতে হবে—এমন নয়। এখানে ভালো করার অনেক শাখা ও সুযোগ রয়েছে। তার মধ্যে সিস্টেম ডিজাইন, ক্লাউড কম্পিউটিং, ডেটা সায়েন্স, সাইবার সিকিউরিটি অন্যতম। আমেরিকা ও সত্যি বলতে সারা বিশ্বেই সাইবার সিকিউরিটির জন্য দক্ষ কর্মীর অভাব। ভবিষ্যতে এ সেক্টরে চাকরির চাহিদা বাড়বে। তাই মন খারাপ না করে নিজের ভালো লাগার ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে। কমিউনিকেশন/ নেটওয়ার্কিং স্কিল, প্রেজেন্টেশন স্কিল বাড়াতে হবে।
প্রথম আলো: বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম অনলাইনে এটা-সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলে তাদের নামে অভিযোগ করা হয়। আবার তরুণ প্রজন্ম অনেক কিছু নিয়েই হতাশ। তাদের জন্য কী বলবেন?
রাগিব হাসান: আসলে আমাদের নতুন প্রজন্মের ওপরে আমার অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা আছে। তারা সোশ্যাল মিডিয়াসহ অনলাইনের নানা প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করতে পারছে; সারা বিশ্বের সঙ্গে প্রযুক্তিবিপ্লবে সমানতালে এগিয়ে যেতে পারবে তারাই। তবে সব প্রযুক্তিরই ভালো দিকের পাশাপাশি কিছু অন্ধকার দিকও থাকে। সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে আমি আলোকিত ভবিষ্যৎ ও আলোকিত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে বলব। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কাজ করতে বলব। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মই আমাদের দেশকে সামনের দিকে নিয়ে যাবে। আর হতাশ হওয়ার কিছু নেই। যারা ক্যারিয়ার কিংবা পড়াশোনা নিয়ে চিন্তিত, আমি তাদের সবাইকে বলব হুজুগে গা না ভাসিয়ে নিজের পছন্দের কাজটা বেছে নিতে, যে কাজটা করে মিলবে আনন্দ, আর হবে সবার মঙ্গল।

প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
রাগিব হাসান: আপনাকেও ধন্যবাদ।