উপলব্ধি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কষ্টগুলো বুকের মধ্যে কেমন সুপার গ্লুর মতো আটকে আছে। অনেক চেষ্টা করেও দূরে সরাতে পারছে না তানিয়া। ওর চাকরিটা কেউ মেনে নিতে পারছে না। না রোহান, না শাশুড়ি।
এক সপ্তাহ হলো একটা কফিশপে কাজ নিয়েছে তানিয়া। এই নিয়ে রোহানের সঙ্গে ঝগড়া লেগেই আছে। রোহান চায় না তানিয়া চাকরি করুক। সংসার তো সুন্দর ভাবেই চলছে। বউ যদি চাকরি করবে তাহলে তো আমেরিকায় বিয়ে করতে পারত, দেশে গিয়ে মফস্বল শহরের মেয়ে বিয়ে করা কেন।
রোহান ঠিক করেই রেখেছিল তার বউ চাকরি করবে না। অথচ আজ তাই হলো।
মাকে নিয়ে রোহান থাকে জ্যাকসন হাইটসে। ডিভি লটারিতে এসেছিল আমেরিকা। পরে মাকে নিয়ে আসে। বাবা নেই, এক বোন দেশেই থাকে। এই বোনই বিয়ে ঠিক করেছিল রোহানের। মাও বিয়ের জন্য খুব করে বলছিল, তাই দেশে গিয়ে বিয়ে করা। রোহানের বিয়ের সময় ওর বোন বলেছিল রোহান ইঞ্জিনিয়ার। ওর কথা তানিয়ার পরিবার বিশ্বাস করেছিল। আর রোহান দেখতেও সুদর্শন। কিন্তু কে জানত এমন ডাহা মিথ্যা বলেছিল তারা। আসলে রোহান ট্যাক্সি চালায়। এটা তানিয়া জেনেছে আমেরিকা আসার পর। তাও সে মেনে নিয়েছে, ভেবেছে শিক্ষা থাকলেই কী ভালো হয়? সংসার করার জন্য ভালো লাইফ পার্টনার দরকার। রোহান ভালো মানুষ হলেই হলো।
বিয়ের এক সপ্তাহ পরেই রোহান চলে এসেছিল আমেরিকা। পরে তানিয়ার জন্য আবেদন করে। এক বছরের মধ্যে স্বপ্নের আমেরিকা চলে আসে তানিয়া। ভেবেছিল নিশ্চয়ই চমৎকার সংসার হবে। কিন্তু কে জানত স্বপ্ন স্বপ্নই। বাস্তবতা আলাদা।
মফস্বল শহরের মেয়ে তানিয়া। বাবা নেই, তিন বোন এক ভাই। তানিয়া বড়। তাই বিদেশে থাকে, ফ্যামিলি ভালো, শিক্ষিত এমন পাত্র তানিয়ার মা হাতছাড়া করতে চাননি। আর তানিয়ার বোন বড় হচ্ছে তাদের কথাও ভাবতে হবে। তাই রোহানকে হাতছাড়া করতে চাননি। তানিয়ার চাচারাও বলেছিল, এমন পাত্র হাতছাড়া করা হবে বোকামি।
তানিয়া আমেরিকা আসার পর থেকেই ঘরের সব কাজ করত। রোহান বলে দিয়েছিল বিদেশে কাজের লোক নেই, থাকে না। সব কাজ নিজেদের করতে হয়। তাই তানিয়া সকালে নাশতা বানানো, রোহানের কাপড় লন্ড্রি করাসহ সব করত। শাশুড়ির কাপড় লন্ড্রি করে না, মেশিনে দিলে নাকি নষ্ট হয়ে যাবে, তাই তানিয়া হাতেই সাবান দিয়ে ধুয়ে বাসার মধ্যে ডাইনিং টেবিলে পাশে রাখা তারে শুকায়। বাইরে কাপড় শুকানো আইনত নিষেধ।
কিন্তু এই রান্নাবান্না-সংসারের কাজ করতে করতে এক সময় হাঁপিয়ে ওঠে। কোথায় যাবে বা কারও সঙ্গে মিশবে সেটা হয় না। শাশুড়ির অনুমতি ছাড়া কিছুই করতে পারে না। আর রোহানও এমন, তানিয়া কিছু বললেই বলে, মাকে বলো।
মাঝে মাঝে মনে হয় আসলে ও কি একটা মানুষ! নাকি কলের পুতুল। এই যুগে এমনভাবে মানুষ চলে কেউ বিশ্বাস করবে না, তাও আবার আমেরিকার মতো দেশে। কিন্তু এভাবে কত দিন? তানিয়া ভাবে, এই দুই কামরার জীবনের চেয়ে মফস্বল শহরের জীবন ভালো ছিল। অন্তত নিজের মতো করে চলতে পারত। আনন্দ, কষ্টগুলো শেয়ার করতে পারত। মা বোনদের সঙ্গে ফোনে যতবার কথা হয় মিথ্যে বলে। বলে রোহান অমায়িক, শাশুড়ি কোনো কাজ করতে দেয় না, অনেক আদর করে। মিথ্যার ওপর মিথ্যা।
এভাবেই চলছিল। কিন্তু তানিয়া আর নিতে পারছিল না। রোহানকে একদিন বলল, চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। কোথায় যাবে—রোহানের প্রশ্ন?
—চল না নায়াগ্রা ফলস যাই।
রোহান ব্যঙ্গ করে হাসে, বলে সময় কোথায়? আর ছয় দিন কাজ করি। ডলার কীভাবে আসে বোঝ কিছু? জমানো যে ডলার ছিল তোমাকে আনতে উকিলকে দিতে হয়েছে। কিছু ঋণ ছিল সেগুলো শোধ করতে হয়েছে। ছুটি নিলে, কাজ না করলে সংসার চলবে? আরামে আছ তো সারা দিন, কীভাবে বুঝবা এসব!
তানিয়ার কান্না পায় এসব কথা শুনে। রোহানকে বলে, আচ্ছা আমি তো কাজ করতে পারি।
তুমি কাজ করবে? কী কাজ করবে ভ্রু কুচকে অবাক সুরে বলে রোহান? বিএ তো পাস করোনি। এখানে এমএ পাশের মূল্য নাই আর উনি করবে কাজ।
—কেন, দোকানে কত মেয়েরা কাজ করে।
—কোনো দরকার নেই।
তানিয়া ভেবে পায় না কী করবে। এভাবে আর কত দিন চলবে। দুই কামরার এই বাসায় ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। দেশেও যে ফিরে যাবে সেটা তো ভাবতেই পারে না। এমনিতে বাবা নেই, তার ওপর ভাই বোনদের নিয়ে মা হিমশিম খায় সংসার চালাতে। তানিয়া কিছুই ভাবতে পারে না।
এভাবেই চলে যায় এক বছর। তানিয়ার কাছে জ্যাকসন হাইটস আর অপরিচিত মনে হয় না। মাঝে মধ্যে হেঁটেই বাজার করে নিয়ে আসে। দুই-চারজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। এর মধ্যে লায়লা নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়, গ্রোসারি স্টোরে কাজ করে। তানিয়া ওকে খুব করে ধরে যেন একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। এই লায়লা কফিশপে কাজের ব্যবস্থা করে দেয় তানিয়ার। বাসার কাছে। তানিয়া হেঁটেই যেতে পারে।
আর এ নিয়ে সংসারে অশান্তি। বিশেষ করে তানিয়া কাজে যাওয়াতে শাশুড়ির রান্নাবান্না, ঘর গোছানো সব করতে হচ্ছে। এই বয়সে কী এসব হয়? ভেবেছিল দেশ থেকে ছেলের জন্য মেয়ে নিয়ে আসবে। নিজে একটু আয়েশ করবে। পোড়া কপাল বউ এখন আট ঘণ্টা কাজ করে। বাসায় নাকি দম বন্ধ হয়ে যায়। এ কেমন কথা তানিয়ার শাশুড়ি ভেবে পায় না।
আজকাল রোহান কথাও বলে না ঠিকভাবে। গতকাল এমন ঝগড়া হয়েছে যে তানিয়াকে সোজা বলে দিয়েছে হয় চাকরি ছাড়বে না হয় সংসার। চয়েজ ইজ ইয়োরস। তানিয়া ভেবে পায় না কেন সে চাকরি করতে দেবে না। তানিয়া যথাসম্ভব চেষ্টা করে কাজ থেকে বাসায় ফেরার পর শাশুড়িকে সাহায্য করতে। সকালে কাজ থাকলে বিকেলে বাসায় ফিরে সব কাজ তানিয়াই করে। তবুও মন ভরে না এদের। শাশুড়ি আরও উল্টো খোঁটা দিয়ে বলে, বউ কাজ করে কারণ নিশ্চয়ই মাকে দেশে ডলার পাঠাবে। এসব কথা শুনে তানিয়ার মন খারাপ হয়ে যায়। আগে কাঁদত, এখন ভাবে কেঁদে কী হবে! যতই এদের জন্য করছে তারা ততই তানিয়ার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। দরকার হলে সংসার ছাড়বে। এভাবে চলা যায় না। আমেরিকার মতো দেশে থেকে এদের মন মানসিকতা একটুও বদলায়নি।
আর বিয়ের সময় তো কী মিথ্যাই না বলেছিল উফ...
এভাবেই দিন যায় আর রোহান ভাবে, মা, আর তানিয়া দুজন মানুষ মিলেমিশে থাকতে পারে না! তানিয়ার কাছে তার কাজ বড় হয়ে গেল! না এমন বউ দরকার নেই। আর এখন তো প্রতিদিন বলতে গেলে ঝগড়া হচ্ছে। আজ রোহান শার্ট খুঁজে পাচ্ছিল না, দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে তানিয়াকে বলে। কিন্তু তানিয়া জবাব দিয়েছে, খুঁজে নাও, আমাকেও যেতে হবে। না হয় দেরি হয়ে যাবে। তানিয়া বেরিয়ে যায়, রোহান তার পথের দিকে চেয়ে থাকে।
রোহান মনে মনে ভাবে, এর একটা বিহিত করতে হবে। তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যায় আয়রন ছাড়া শার্ট পরে। রোহান বেরিয়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পরেই বাসায় ফোন আসে, সে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। তানিয়ার শাশুড়ি তানিয়াকে ফোন করে জানায়। তানিয়া বাসায় ফিরে শাশুড়িকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। গিয়ে দেখে রোহানের পায়ে ব্যান্ডেজ চলছে।
রোহানের এক বন্ধু তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। খুব বেশি কিছু হয়নি। পায়ে আঘাত পেয়েছে। ডাক্তার বলেছে দুই সপ্তাহ রেস্টে থাকতে। ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। পায়ের গোড়ালিতে আর হাড়ে একটু চোট লেগেছে এই যা। সব ফরমালিটিজ শেষে বাসায় ফেরে সবাই। কিন্তু কেমন যেন চুপচাপ। কেউ কারও সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না।
রাতে রোহান কিছুই খায় না। বিছানায় শুয়ে ভাবে কী থেকে কী হয়ে গেল। এখন ইনস্যুরেন্স বেড়ে যাবে। (অ্যাক্সিডেন্ট করলে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ইনস্যুরেন্স বাড়িয়ে দেয়)। কাজেও একটা স্পট পড়ে গেল। ভাগ্য ভালো যে কোনো লোক মারা যায়নি বা তেমন ক্ষতি হয়নি। তাহলে কী হতো! ভাবতেই পারছে না।
নাহ, বাথরুমে যেতে হবে। তানিয়া হেল্প করতে চাইলে লাগবে না বলে মাকে ডাকতে থাকে। তানিয়া বলে মা নামাজ পড়ছে। আমি নিয়ে গেলে সমস্যা কি! অগত্যা তানিয়ার কাঁধে ভর করে বাথরুমে যায়, ফিরে আসে। রাত প্রায় গভীর, তানিয়া ঘুমিয়ে পরেছে। জেগে আছে রোহান। ওর ঘুম আসছে না। কী করবে? বই পড়বে, না ভাল্লাগছে না। লাইট জ্বালানো। তানিয়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মায়া লাগছে। তানিয়ার চাকরি নেওয়ার পর থেকে কেউ কারও সঙ্গে ভালোভাবে কথাও বলছে না। বরং দিন দিন দূরত্ব বেড়ে চলেছে। শেষ রাতের দিকে অনেক চেষ্টার পর ঘুমিয়ে পরে রোহান।
সকালে তানিয়া কাজে ফোন করে জানিয়েছে, আজ অসুস্থ আসতে পারব না। এত অল্প সময়ে ছুটি পাবে না জানে। তাই একদিন অন্তত থাকি বাসায়, এই ভেবে কল আউট করে তানিয়া।
রোহানের ঘুম ভাঙে প্রায় ১০টার দিকে। দেখে তানিয়া বাসায়।
—কাজে গেলে না?
—না, আজ থাকি তোমার ওষুধগুলো নিয়ে আসি। দেখি বাজার কী আছে, লাগলে নিয়ে আসব। আচ্ছা নাশতা কি এখানে দেব?
রোহান মনে মনে হাসে, কী দরদ। আচ্ছা দাও। রোহানকে নাশতা দিয়ে তানিয়া বেরিয়ে যায়। রোহান নাশতা সেরে টিভি দেখে। কিন্তু বসে থাকতে ভালো লাগছে না। উপায়ও তো নাই। মাকে বলে মা, আমাকে একটু বেডরুমে দিয়ে আসো। মায়ের কাঁধে ভর করে রোহান বেডরুমে যায়। ভাবে দুই সপ্তাহ এভাবে থাকতে হবে!

>তানিয়া রোহানকে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা, রাতে কী রান্না করব? রোহান বুঝতে পারে তানিয়া অনেক ক্লান্ত। তাই ইচ্ছা করেই বলে, ডাল-ভাজি হলেই হবে, বেশি কিছু লাগবে না। তানিয়ার শাশুড়ি বলে, কিছুই রান্না করতে হবে না, কালকের অনেক তরকারি রয়ে গেছে। সেগুলো শেষ হোক।


তানিয়ার ওপর কাজের প্রেশার একটু বেড়ে যায়। ঘরের কাজ, বাইরের কাজে হাঁপিয়ে ওঠে। এখন তো রোহানের টেক কেয়ার করতে হয়। তবুও ভালো লাগছে দুই কামরার মধ্যে আটকে নেই জীবন। বাইরে বেরিয়ে নিশ্বাস নিতে পারে।
রোহান আস্তে আস্তে সেরে ওঠে। কিন্তু এই কয়েক দিনে সে একটা ব্যাপার খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করেছে যে, বাসায় বসে থাকা অনেক কষ্টের। যতই কাজ থাকুক ঘরে, কিন্তু কতক্ষণ! রোহানের নিজের কাছেই মনে হয়েছে খাঁচার মধ্যে যেন বাঁচা। তানিয়ার অভিযোগ আসলে মিথ্যা নয়। মাও কীভাবে থাকে। অথচ রোহান সব সময় ভেবেছে বউয়ের বাইরে কাজের দরকার নেই। কী ভুল চিন্তা। নিজেই নিজের এমন ভাবনার জন্য হো হো করে হেসে ওঠে।
আচ্ছা মা, এই যে সারা দিন বাসায় থাকো খারাপ লাগে না? এমন প্রশ্ন শুনে রোহানের মা একটু অবাক হয়। বলে, খারাপ লাগলে কী করব। এই জন্য তো তোরে বলি আমি দেশে যাই, কয়দিন থেকে আসি। দেশে তো সবাই আছে, কথা বলি, সবার বাসায় যাই, বাগান করি, সময় কেটে যায়। এখানে কেমন বন্দী বন্দী লাগে। রোহান বলে ঠিক আছে মা, কিছুদিন আমারে সময় দাও আমি ঠিক হয়ে নিই। তুমি দেশ থেকে ঘুরে আসতে পারবে।
তানিয়া কাজ থেকে ফিরে দেখে রোহান ওর জন্য অপেক্ষা করছে খাবার টেবিলে। মনে মনে তানিয়া ভাবে ঘটনা কী? যাই হোক। তানিয়ার কাছে ভালো লাগছে বিষয়টি। কী ব্যাপার কিছু বলবে—প্রশ্ন করে তানিয়া।
—না, তেমন কিছু না। ভাবছি আর ট্যাক্সি চালাব না। আজ ফরহাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, ওর একটা দোকানে ম্যানেজার হিসেবে আমাকে নেবে বলেছে। ওর তো তিন-চারটা দোকান।
—কোন ফরহাদ? ওই বেঁটে মোটা করে বন্ধুটা?
—হ্যাঁ।
—তো তোমার পা-তো এখনো ঠিক হয়নি।
—হুম, ডাক্তারের সঙ্গেও কথা হয়েছে, বলেছে কাল দেখা করতে। তুমি কী আমাকে একটু নিয়ে যেতে পারবে কাজ থেকে ফেরার পর।
—অবশ্যই পারব।
রোহান অন্যদিন থেকে আজ অনেক নমনীয়। কেন তা তানিয়া বুঝতে পারছে না। তবে কিছুটা যে বদলেছে সেটা বোঝা যায়।
পরদিন তানিয়া কাজ থেকে ফিরেই রোহানকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তার ব্যান্ডেজ খুলে দেখে বলেছেন, প্রায় ঠিক হয়ে গেছেন। তবে এখন কাজে যাবেন না, আরও কয়েক দিন বাসায় থাকেন। আপনি নিজেই উপলব্ধি করতে পারবেন ঠিকভাবে হাঁটতে পারছেন কিনা। যখন দেখবেন পারছেন, তখন না হয় কাজে যাবেন। বাসায় ফিরে রোহান দেখে ফরহাদ ওকে দেখতে এসেছে। কলেজজীবনের বন্ধু, এখন তো বড় ব্যবসায়ী।
—কী দোস্ত, পায়ের কী অবস্থা? তো কবে জয়েন করবি আমার এখানে।
—ভালো। এই তো দোস্ত, এক সপ্তাহ সময় দে। আর ট্যাক্সির ওখানেও কিছু হিসাবনিকাশ আছে, ওগুলো শেষ করতে দে।
—ওকে, দোস্ত। আমি এখন যাই, টায়ার্ড লাগছে। বাসায় গিয়ে রেস্ট নেব।
—আরও কিছুক্ষণ থাক, অন্তত এক কাপ কফি খেয়ে যা।
—নারে আজ যাই বলেই, ফরহাদ বেরিয়ে যায়।
তানিয়া রোহানকে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা, রাতে কী রান্না করব? রোহান বুঝতে পারে তানিয়া অনেক ক্লান্ত। তাই ইচ্ছা করেই বলে, ডাল-ভাজি হলেই হবে, বেশি কিছু লাগবে না। তানিয়ার শাশুড়ি বলে, কিছুই রান্না করতে হবে না, কালকের অনেক তরকারি রয়ে গেছে। সেগুলো শেষ হোক।
তানিয়া বেডরুমে গিয়ে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। রোহান আস্তে আস্তে পাশে এসে বসে। কথা বলে।
—তানিয়া, তোমার কী খারাপ লাগছে।
—না, একটু টায়ার্ড। কিছু বলবে?
—না তেমন কিছু না। আই অ্যাম রিয়েলি স্যরি।
—কেন? তানিয়া উঠে বসে। কী হয়েছে?
—না, আমি যন্ত্রের মতো ছুটছিলাম, কাজ আর কাজ। মাথায় একটা ভাবনা কাজ করত কীভাবে ডলার ইনকাম করব। আর বউ কেন জব করবে? আসলে আমার এ ভাবনা ভুল। আসলে যার যেটা করতে পছন্দ তার তা করা উচিত। এই যে তুমি বলতে বাসায় তোমার দম বন্ধ হয়ে আসে আমি বিশ্বাস করতাম না। এই কয়েক দিন নিজে বাসায় থাকাতে উপলব্ধি করেছি, আসলে তুমিই সত্য ছিলে। প্লিজ আমায় ক্ষমা কর।
তানিয়া কাঁদছে, কিছুই বলতে পারছে না। এই জবের জন্য রোহান কী খারাপ আচরণই না করেছে ওর সঙ্গে।
—তানিয়া?
—হুম।
—তুমি কি কাঁদছ? এবার রোহান তানিয়াকে জড়িয়ে ধরে, প্লিজ। বললাম তো ভুল হয়েছে। আসলে কেউ যদি ঘরে থেকে ভাবে সুখে আছে সে সেভাবেই থাকুক। কেউ যদি জব করতে চায় তার তাই করা উচিত। প্রতিটি মানুষের তার মতো করে বাঁচা উচিত। আমি তোমায় বুঝতে পারিনি এ আমার ব্যর্থতা। তুমি জব চালিয়ে যাও যত দিন ভালো লাগে। এ নিয়ে আমি আর কিছু বলব না, প্রমিজ।
তানিয়া কান্না থামায়। সব ক্লান্তি যেন এক নিমেষেই উধাও হয়ে গেছে। বলে, আমিও যে তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করিনি তা নয়, আমি স্যরি। দুজন দুজনকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে।
যেন বহু দিনের অভিমানের পাহাড়ে ঝরনা বইছে। দুজনের চোখে পানি। এ অশ্রু আনন্দের অশ্রু।