একুশের আত্মাহুতি শুধু ভাষার জন্যই ছিল না

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা আয়োজিত অনুষ্ঠান।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা আয়োজিত অনুষ্ঠান।

বাঙালি বায়ান্নতে মাতৃভাষার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছিল। এই আত্মাহুতি শুধু বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্যই ছিল না। বায়ান্নর একুশের দাবি আরও ব্যাপক। বাঙালির আজকের প্রতিটি অর্জনের পেছনে একুশের চেতনা জাজ্বল্যমান। একুশের চেতনা সমুন্নত রাখতে বাঙালির প্রতিটি অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য আমাদের প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা আয়োজিত অনুষ্ঠানে আলোচকেরা এসব কথা বলেন।

গানে, আলোচনায়, কবিতায় ও প্রকাশনার মধ্য দিয়ে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ভিন্নধর্মী এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ২০ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশ প্লাজায় এই অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কের লেখক, কবি ও সুধীজনের প্রাঞ্জল উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।

বাচিক শিল্পী লাভলু আনোয়ারের কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধায় নীরবতা পালনের পর প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার পাঠকপ্রিয় ‘কবিতার এক পাতার’ সম্পাদক কবি-লেখক ফারুক ফয়সল তাঁর সূচনা বক্তব্য দেন। তিনি একুশের প্রেক্ষাপট ও বাঙালি জনজীবনে তার ব্যাপ্তি নিয়ে আলোচনা করেন।

লেখক-সাংবাদিক রওশন হকের উপস্থাপনায় আলোচনা পর্বে যোগ দেন হাসান ফেরদৌস। তিনি বলেন, কোনো ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য সেই ভাষাভাষীদের প্রাণ দিতে হয়েছে, এ রকম ঘটনা পৃথিবীতে খুবই বিরল। বাংলাই খুব সম্ভবত একমাত্র ভাষা, যে ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছে এই ভাষায় কথা বলা মানুষেরা।

লেখিকা রানু ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা মায়েরা যদি চেষ্টা করি তাহলে দেশের আগামী প্রজন্মের মুখে ও কলমে বাংলা ভাষা তুলে ধরা সম্ভব।’

সাংবাদিক নিনি ওয়াহেদ বলেন, বাংলাভাষীরা প্রথমবার প্রাণ দিয়েছে ঢাকায়। উর্দিওয়ালাদের ভাষা উর্দুর আগ্রাসন থেকে বাংলাকে রক্ষা করাই ছিল তার মূল কারণ। ৫৬ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছিল মানুষ। এই ধরনের আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব, অত্যন্ত বিস্ময়কর। তবে বর্তমানে চেতনার কথা বলে ভাষার মর্যাদাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস তাঁর আলোচনায় বলেন, অসংখ্য বিষয় নিয়ে অসংখ্য ধরনের আন্দোলন দেখেছে পৃথিবীর মানুষ। কিন্তু মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এমন আন্দোলন কখনো দেখেনি তারা। বায়ান্নতেই প্রথম সেই ঘটনা ঘটে। এই আন্দোলন পরে আর শুধু ভাষার আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর থেকে জন্ম নিয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। একটি জাতির নবজন্মের সূচনা হয়েছিল এই আন্দোলন থেকেই। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে জীবন দানের কারণেই এত দ্রুত মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল আমাদের। জন্ম হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে একুশের চেতনা ও আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের আহ্বান জানান তিনি।

প্রথম আলো বন্ধুসভা নিউইয়র্কের সভাপতি ফাহিম রেজা নূর নতুন প্রজন্মের মধ্য দিয়ে একুশ ও বাঙালি চেতনার উন্মেষ ঘটবে বলে তাঁর আলোচনায় উল্লেখ করেন।

কবি ফকির ইলিয়াস বলেন, অসংখ্য মানুষের মাতৃভাষা বাংলা ভাষা অত্যন্ত শক্তিশালী একটা ভাষা। সাহিত্য ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত বনিয়াদ থাকার পরও সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, সবচেয়ে বেশি নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে ভাষাটাকেই। এই নিগ্রহে শুধু যে বাইরের লোকই শামিল ছিল, তা কিন্তু নয়। বাংলায় বসবাসকারী কিছু লোকও ভিনদেশিদের পক্ষ নিয়ে বাংলা ভাষার ক্ষতি সাধন করার চেষ্টা কম করেনি, এখনো করছে। এই অবহেলা, নিগ্রহ আর ক্ষতি সাধনের প্রচেষ্টা অবশ্য আজকের নয়। সেই প্রাচীন যুগে বা মধ্যযুগেও বাংলাকে একই ধরনের অত্যাচার সইতে হয়েছে।

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা আয়োজিত অনুষ্ঠান।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা আয়োজিত অনুষ্ঠান।

যুক্তরাজ্য থেকে আসা অতিথি লেখক, সমাজ সংগঠক ইমরান আহমেদ চৌধুরী পশ্চিমের দেশে বাঙালির আত্মপরিচয়ের সঙ্গে একুশের চেতনার যোগসূত্রের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, একুশের চেতনাই বলে দেয় আমরা আজ যারা ব্রিটেনে বা আমেরিকায় আছি, তাদের আত্মপরিচয় ব্রিটিশ বাঙালি বা আমেরিকান বাঙালি ছাড়া অন্য কিছু নয়।

প্রথমবারের মতো নিউইয়র্কে প্রথম আলো নিজদের ছাপা পত্রিকায় একুশের আয়োজন ছাড়াও আলাদা করে অমর একুশে স্মরণে একুশের সংকলন বের করেছে। এটি যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন ইব্রাহিম চৌধুরী ও ফারুক ফয়সল। একুশে সংকলনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন মনজুরুল হক। এতে যথাক্রমে বাংলা ভাষার ওপর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের লেখা প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণামূলক কবিতা ও ছোটগল্পের আয়োজন রয়েছে। নিউইয়র্ক নগরীতে প্রথমবারের মতো নিখুঁত পরিচ্ছন্ন একুশের সংকলনটি সুধীজনের প্রশংসা কুড়িয়েছে।

একুশের আলাপনের পরই শুরু হয় লেখক ফরিদা ইয়াসমিনের উপস্থাপনায় একুশের কবিতা পাঠ। প্রথমেই স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন মনিজা রহমান। আবৃত্তিশিল্পী গোপন সাহা পড়ে শোনান শহীদ কাদরীর কবিতা, আবৃত্তিশিল্পী লুবনা কাইজার শোনান আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতা। তারপর একে একে কবিতা আবৃত্তি করে শোনান রুপা খানম, আইরীন রহমান, শাবানা, শিমু আফরোজ, নিশাত ফারজানা, জাহিদা আলম, কবি ফারহানা ইয়াসমিন তুলি, শাম্মী আক্তার হ্যাপী, নীরু নীরা, স্বপ্ন কুমার, স্বপন বিশ্বাস ও আবদুশ শহীদ। ভাষা শহীদদের স্মরনে গান করেন সংগীতশিল্পী পাপী মনা। গান, স্বরচিত কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও ভাষা আন্দোলনের পটভূমি নিয়ে জমজমাট আলোচনার পাশাপাশি তাপমাত্রা শূন্যের নিচের শীত সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিমু আফরোজ, রুপা খানম, রওশন আরা খান, লুবনা কাইজার, কাইজার আহমেদ, রানু ফেরদৌস, হাসান ফেরদৌস, গোপন সাহা, জুয়েল খাজা, ফারুক ফয়সল, সুব্রত বিশ্বাস, ইমরান চৌধুরী, মামুন রশিদ চৌধুরী, স্বপ্ন কুমার, সুয়েব মাহমুদ, লায়লা চৌধুরী, সালমা চৌধুরী, সুতপা সাহা, নিশাত ফারজানা, রাজিনা চৌধুরী, ফরিদা ইয়াসমিন, জাহিদা আলম, আনোয়ারুল লাভলু, আকবর হায়দার কিরণ, নিহার সিদ্দিকি, মুনিজা রহমান, পাপীমনা, মাধবী চৌধুরী, সানজীদা উর্মি, রওশন হক, ফাহিম রেজা সূর, স্বপন বিশ্বাস, লিটন, নিনি ওয়াহেদ, শাহীন বাবু, ফকির ইলিয়াস, তৃষা, নীরু নীরা, রেহানা আক্তার, লিপি আহমেদ, নাজনীন ফাতেমা, আবেদীন কাদের, শাম্মী আক্তার হ্যাপি, আল মাসুদ জীবন, কামাল আহমেদ, ফরিদা ইয়াসমিন, মোহাম্মদ আলী, আশরাফুজ্জামান, খাদিজা পারভীন, শাবানা, আব্দুস শহীদ, তোফাজ্জল লিটন, সানজিদা উর্মি, সৈয়দা শাহানা জেসমিন প্রমুখ।

অনুষ্ঠানটি সফল করার জন্য এসেনশিয়াল ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসহ প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার বিজ্ঞাপনদাতা–পৃষ্ঠপোষকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। সমবেত কণ্ঠে একুশের গান, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...’ গাওয়ার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।