সিরিয়ালে নারীর আত্মপরিচয়

টিআরপি রেটিংয়ে স্টার জলসার বিভিন্ন সিরিয়ালের মধ্যে ‘শ্রীময়ী’–এর অবস্থান এখন শীর্ষে। স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত। লেখাপড়া কম জানা কিংবা তেমন ঝকঝকে স্মার্ট না বলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন, এমনকি নিজের সন্তানেরাও পাত্তা দেয় না, এমন একজন সর্বংসহা শ্রীময়ী অবশেষে নিজেকে বদলাতে শুরু করে। যেটা সচরাচর স্টার প্লাস কিংবা স্টার জলসা ঘরানার সিরিয়ালে দেখা যায় না। কারণ এসব সিরিয়ালে ভালো চরিত্রগুলো শুধু পড়ে পড়ে মার খেয়ে যায়। বারে বারে অপমান সহ্য করে। কিন্তু, ঘুরে দাঁড়ানোর কথা ভাবে না।
শ্রীময়ী এখন নিত্য সংসারের কাজকে অবহেলায় ছুড়ে ফেলে স্কুলের চাকরিতে চলে যায়। রাঁধুনির ছোটখাটো চাকরি। তবু এই যেন শ্রীময়ীর আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়া। সিরিয়ালের এই বাঁকে এমনকি শ্রীময়ীর জীবনে নতুন কোনো সঙ্গীর আগমনের ইঙ্গিতও দেওয়া হচ্ছে। টেলিভিশন সিরিয়ালে একজন মধ্যবয়সী নারীর জীবনে যেটা প্রায় সপ্তম আশ্চর্যের মতো ঘটনা।
শোনা যাক আরেক সিরিয়ালের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘মোহর’–এর কথা। ছোট মফস্বল শহরের মেয়ে সে। বাবা লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে জোর করে তার বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ের আসর থেকে পালায় মোহর। কলকাতায় গিয়ে মোহরকে পড়াশোনার জন্য সাহায্য করে ওর কলেজের শিক্ষক ড. অদিতি রায় চৌধুরী, শুধু নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন বলে যাকে স্বামী-সন্তান-সংসার ছাড়তে হয়েছিল। অদিতি ও মোহর দুজনেই প্রচণ্ড সৎ, মানবিক, নির্ভীক ও প্রতিবাদী। তাদের এই প্রতিবাদের ভাষা পছন্দ হয় না আপনজনদের কারও কারও। আবার কেউ কেউ নীরবে সমর্থন করে যায়। মোহরের মা, দিদি, অদিতির জা, ভাইপোর স্ত্রী—যারা ওদের মতো নির্যাতিত, নিরন্তর অপমানিত, তারা যখন ওদের মনের সুপ্ত প্রতিবাদের ভাষা মোহর কিংবা অদিতির মুখে শুনতে পায় আনন্দে উজ্জ্বল হয় ওদের অবয়ব।
আজকাল অনেক ভালো নারী স্ক্রিপ্ট রাইটারের কারণেই কিনা স্টার জলসা কিংবা জি বাংলার সিরিজগুলো জীবনের কথা বলে, নারীর উঠে আসার কথা বলে। সেই উঠে আসার পেছনে সংগ্রামের-অপমানের-বেদনার কথা বলে। একজন শ্রীময়ী যেন বহু মধ্যবয়সী নারীর বঞ্চনার ইতিহাস। তেমনি মোহর, বিরুদ্ধ পরিবেশে একজন তরুণীর উঠে আসার লড়াই। শ্রীময়ী ও মোহরের গল্পের প্রধান মিল—দুটোই তাদের একার লড়াই। যে লড়াইয়ে মাথা উঁচু করে লড়তে হয় শুধু নিজেকে। এমন দুটি সিরিয়ালসহ স্টার জলসার বহু জনপ্রিয় সিরিয়ালের লেখকের নাম লীনা গঙ্গোপাধ্যায়, যাঁর হাত ধরেই যেন নতুন দিনের গান এখন টিভি সিরিয়ালগুলোতে।
বিকেল চারটার দিকে সাধারণত কাজ থেকে বাসায় ফিরি। ওই সময়েই পর পর স্টার জলসায় শ্রীময়ী ও মোহর সিরিয়াল দেখানো হয়। আমার ছোট ছেলের হোম অ্যাটেন্টডেন্ট
দেখে। তার সঙ্গে আমিও দেখি। প্রথমে তেমন মনোযোগী ছিলাম না। এখন হোম অ্যাটেন্টডেন্ট না আসলেও দেখি। আমি অনেকটা অ্যামেচার দর্শক। তবে কেউ কেউ আছে পেশাদার। কোনো সিরিয়াল বাদ দেয় না। প্রত্যেকটি ধারাবাহিকের পরিবারগুলোর ড্রয়িংরুম যেন তাদের ড্রয়িংরুম হয়ে যায়। চরিত্রগুলো পরিবারের সদস্য হয়ে যায়। এটি বহুকাল আগে আমারও খুব হতো। এখনো যে কারণে বহু আগে দেখা সাদাকালো বিটিভির যুগের ধারাবাহিকের চরিত্রের নামগুলো ভুলতে পারি না।
শ্রীময়ী সম্প্রতি বাংলা সিরিয়ালে নতুন আলোড়ন তৈরি করেছে। শ্রীময়ীর কাহিনি অনেক আগে দেখা অপর্ণা সেনের ‘পরমা’ সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে পরমা যে গন্তব্যে পৌঁছেছিল সিনেমার একদম শেষে, শ্রীময়ী সেটা আগেই পেরেছে। একটি অসুখী ও অসম্মানজনক দাম্পত্য জীবন থেকে সে বেরিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার অঙ্গীকার করেছে। শ্রীময়ী আরও কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেটা সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। সে তাঁর স্ত্রীধন তুলে দিয়েছে তার স্বামীর বর্তমান স্ত্রী জুনের হাতে। বিয়ের সময় নারীদের যে গয়না উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হয়, তাকেই বলা হয় স্ত্রীধন। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলেও কোনো নারীর কাছ থেকে সেই স্ত্রীধন কেউ কেড়ে নিতে পারে না, যদি না স্বেচ্ছায় দান কিংবা উপহার হিসেবে না দেয়। শ্রীময়ী স্ত্রীধনের অধিকার ছেড়ে দিয়ে আত্মসম্মানের পরিচয় দিয়েছে। তদুপরি কারও তদবিরে নয়, নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী একটা চাকরিতে ঢুকে সে নিজেকে আরও মহান করেছে।
সব মেয়ের পড়াশোনা করা উচিত। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। যাতে একটা সামান্য টিপের পাতা কিনতে গেলেও স্বামীর কাছে হাত পাততে না হয়, এটিই যেন মোহর সিরিয়ালের মূল কথা। সিরিয়ালের কেন্দ্রীয় চরিত্রে মোহর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিয়ের আসর থেকে পালায়। কলকাতার কলেজে ভর্তি হতে আসে সে। যেখানে তার থাকার কোনো জায়গা নেই। কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য টাকা দরকার, আগের কলেজের টিসি দরকার, তদুপরি কলেজ ম্যানেজমেন্টের বিরোধিতা, সহপাঠীদের নির্মম আচরণ—সবকিছুর সঙ্গে লড়াই করে কীভাবে মোহর তাঁর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস, মেধা আর আত্মসম্মানবোধের জোরে টিকে থাকে, সেটা সত্যিই অনুসরণীয়।
মোহর চরিত্রের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, সে কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করে না। নিজের স্বার্থের কথা, নিজের লাভের কথা না ভেবে সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। কাউকে ছাড় দিয়ে সে কথা বলে না। মোহর তাঁর আইডল ড. অদিতি রায় চৌধুরীর অপমানের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আন্দোলন করে। যেটা করতে গিয়ে সে যেমন অনেকের বিরাগভাজন হয়, তেমনিভাবে তাঁর অসামান্য নেতৃত্বগুণ ও সততা বহু ছেলেমেয়েকে আন্দোলনে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করে। ছাত্রজীবন যে শুধু চোখ–কান বন্ধ করে বইয়ের পাতায় ডুবে থাকা নয়, সেটা সে প্রমাণ করে। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গিয়ে অনিশ্চিত জীবন সে বেছে নেয়, কারণ সে নিজের আত্মপরিচয় খুঁজতে চেয়েছে।
মোহর যেটি নাটকের শুরুতেই করেছে, শ্রীময়ী সেটা আরম্ভ করেছে মাঝ বয়সে এসে। তারা এখন বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, নিউইয়র্কসহ বিশ্বময় বাঙালির বহু ঘরে লড়াকু ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নারীর অনুপ্রেরণা। সাধারণ মানুষ যেমন ভালোবাসে শ্রীময়ী কিংবা মোহরকে, তেমনি ঘৃণা করে তাদের, যারা ওদের চলার পথকে করেছে কণ্টকময়। শ্রীময়ীর স্বামী যাকে বিয়ে করেছেন সেই জুন আন্টি এখন বাংলার ঘরে ঘরে এতই ঘৃণিত যে, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানেও যেতে পারেন না। এটা শ্রীময়ী সিরিয়ালের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার কারণ। সেদিন এক মিছিলে পোস্টারে একজন লিখে এনেছে—
‘ছি: ছি: অমিত শাহ! তুমি জুন আন্টির চেয়েও খারাপ।’