তোপের মুখে স্যান্ডার্স

একের পর এক প্রাইমারিতে চমক সৃষ্টি করে চলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। এখন পর্যন্ত হওয়া কোনো প্রাইমারিতেই তাঁকে কেউ পরাজিত করতে পারেননি। ফলে অন্য প্রার্থীদের সুস্পষ্ট লক্ষ্যে পরিণত হয়েছেন তিনি। এরই প্রমাণ দেখা গেল ডেমোক্রেটিক দলের সর্বশেষ প্রাইমারি বিতর্কে।
আমেরিকায় প্রগতিশীল ধারণাগুলো জনপ্রিয় হলেও একে ঘিরে যথেষ্ট সংশয় এখনো বিদ্যমান। ফলে নিজেকে সরাসরি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা করা স্যান্ডার্সকে ঘিরে ডেমোক্রেটিক দলের বয়সী সমর্থকদের মধ্যে এক ধরনের দোনোমনা রয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হলেও স্যান্ডার্স এখনো সব বয়সী ভোটারদের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। এই সুযোগটিই নিচ্ছেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা। বিশেষত পিট বুটিজেজ, মাইকেল ব্লুমবার্গ, জো বাইডেনের মতো প্রার্থী স্যান্ডার্সকে প্রতিহত করাকেই নিজেদের নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম লক্ষ্যে পরিণত করেছেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক প্রাইমারি বিতর্কে তাঁরা এক জোট হয়েই আক্রমণ করেছেন স্যান্ডার্সকে। সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে থাকা স্যান্ডার্স সম্পর্কে তাঁদের অবস্থান একটাই। আর তা হলো, স্যান্ডার্স অনেক ভালো ভালো কথা বলছেন, কিন্তু এর কিছুই তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। কারণ, তাঁর পক্ষে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ স্যান্ডার্সের প্রতি সমর্থনকে বড় ধরনের অপচয় হিসেবে চিত্রিত করতে চাইছেন তাঁরা।
২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে সাউথ ক্যারোলাইনার মঞ্চে ডেমোক্রেটিক দলের সাতজন প্রার্থী নির্বাচনে জয়ের জন্য এবং সরকার গঠন করতে পারলে কী করবেন সেসব পরিকল্পনা তুলে ধরেন। এ দিন প্রায় সব প্রার্থীই ভারমন্ট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সকে আক্রমণ করেন।
বিতর্কে স্যান্ডার্সের প্রতি তুলনামূলক নমনীয় এলিজাবেথ ওয়ারেন বলেন, ‘স্যান্ডার্সের প্রগতিশীল ধারণাগুলো আমাদের উৎসাহিত করে। তবে তিনি আমাদের বর্তমান প্রশাসনের মতো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি না দিয়েই কাজটি করতে সক্ষম হবেন কি না, তা তাঁর বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হচ্ছে না।’
নিউইয়র্ক নগরীর সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ বলেন, ‘স্যান্ডার্স জনগণকে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে গিয়ে অনেক কিছু বলছেন। এগুলো কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। একই সঙ্গে এসব প্রতিশ্রুতি কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পরাজিত করার জন্য যথেষ্ট, তাও ভাবতে হবে।’
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান দলে বহিরাগত। তাঁকে থামাতে ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে রিপাবলিকান দলের শীর্ষ নেতৃত্ব অনেক চেষ্টা করেছিল। সবাই ভেবেছিল, প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প দলের ধারা ও প্রেসিডেন্সি দুই ক্ষেত্রেই একটি স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করবেন। অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবেন। কিন্তু তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর আরও একলা চলো নীতি নিয়েছেন। মতের বিরুদ্ধে যে কারও বিরুদ্ধেই খড়্গহস্ত হয়েছেন। রিপাবলিকান দলের সমর্থকদের বদলে নিজ সমর্থকদের তুষ্ট রাখতেই বেশি মনোযোগী হয়েছেন। এই একই প্রবণতা স্যান্ডার্সেরও থাকতে পারে বলে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এখন ডেমোক্রেটিক দলের সমর্থকদের সতর্ক করছেন।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ডেমোক্রেটিক দলে বহিরাগত স্যান্ডার্সও মূলত তাঁর সমর্থক তরুণ প্রজন্মের ওপর বেশি আস্থাবান। এই ভিতে দাঁড়িয়েই তিনি লড়ছেন। তাঁর অবস্থানের কারণে পুরো দলের অবস্থান অনেকটা বামপন্থার দিকে সরে গেছে। এ অবস্থায় অন্য প্রার্থীরা প্রশ্ন তুলছেন, নির্বাচনী লড়াইয়ের মাঠের বিতর্ক মতবাদের দিকে সরে যাওয়াটা আগামী নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের সাফল্যের জন্য ক্ষতিকর। তাঁদের মতে, আগামী নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের লক্ষ্য একটাই হওয়া উচিত, আর তা হলো ট্রাম্পকে পরাজিত করা। কিন্তু স্যান্ডার্সের কারণে এ লক্ষ্য থেকে দল অনেকটাই বিচ্যুত।
সর্বশেষ জানুয়ারিতে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন পরিচালিত জরিপের তথ্যমতে, ডেমোক্র্যাটদের ৪৫ শতাংশ মেন করেন জো বাইডেনের পক্ষে ট্রাম্পকে পরাজিত করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে স্যান্ডার্সের ওপর আস্থা রেখেছেন ২৪ শতাংশ ভোটার। বাকি প্রার্থীদের সবার অবস্থান এ দুজনের পর।
কিন্তু প্রাইমারি নির্বাচন শুরুর পর দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। একের পর এক নির্বাচনে অন্য প্রার্থীদের বলা যায় ধরাশায়ী করে স্যান্ডার্স চমকে দিলেন সবাইকে। আর এই চমকই অন্য প্রার্থীদের মধ্যে স্যান্ডার্সবিরোধী এক ধরনের জোট তৈরিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করল, যার প্রমাণ সর্বশেষ নির্বাচনী বিতর্ক।
এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমেরিকার রাজনীতিতে বার্নি স্যান্ডার্স এই মুহূর্তে একজন রাজনৈতিক তারকা। দলের সমর্থনের বাইরে তাঁর এই তারকাখ্যাতিও ভীষণভাবে মূল্যবান। সবচেয়ে বড় কথা হলো, নিজের রাজনৈতিক দর্শন খোলাখুলিভাবে তুলে ধরার মধ্য দিয়েই তিনি এ তারকাখ্যাতি অর্জন করেছেন। তাই অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে, স্যান্ডার্সই বরং ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্টের জন্য বেশি চ্যালেঞ্জিং হবেন। যদিও আরেক দল মনে করছেন, ডেমোক্রেটিক দলের ভেতরে প্রাইমারি জয়ের জন্য স্যান্ডার্সের তারকাখ্যাতি বিশেষ সুফল দিলেও তা জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে অতটা সফল হবে না।
ডেমোক্রেটিক পার্টি যেহেতু বর্তমানে সবচেয়ে বেশি বিভাজিত অবস্থায় রয়েছে, সেহেতু দলটিতে স্যান্ডার্স ও তাঁর অনুসারীরা শক্ত অবস্থান গড়তে পেরেছেন বলে মনে করছেন অনেকে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক হিসাবে দেখা গেছে, ডেমোক্র্যাটদের ১৫ শতাংশ নিজেদের অতি-উদার হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। এর বাইরে ৩২ শতাংশ নিজেদের উদার, ৩৮ শতাংশ মধ্যপন্থী এবং ১৪ শতাংশ নিজেদের কিছুটা রক্ষণশীল হিসেবে মনে করেন। কিন্তু এই হিসাব প্রাইমারিগুলোতে স্যান্ডার্সের বিজয়ের কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারে না।
একই সংস্থার আরেক হিসাবমতে, আমেরিকান ভোটারদের ২৭ শতাংশ ডেমোক্র্যাট। গ্যালাপের তথ্যমতে, আমেরিকান ভোটারদের ৩০ শতাংশ রিপাবলিকান। আর ৪২ শতাংশ কোনো দলের নয়, অর্থাৎ স্বাধীন। ফলে জাতীয় পর্যায়েও যে, ডেমোক্র্যাটরা খুব শক্ত অবস্থানে আছে, তেমনটি নয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিততে হলে তাদের স্বাধীন ভোটারদের কাছে টানতে হবেই, যারা মূলত পরিবর্তনকামী। আর এই পরিবর্তনকামীদেরই আকৃষ্ট করছেন স্যান্ডার্স। শেষ পর্যন্ত তিনি কত দূর যেতে পারেন, তা দেখতে অবশ্য অনেকটা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই আপাতত।