হাসির ধমক!

শুক্রবার এ লেখা যখন বের হবে, আমি তখন ঢাকায়। এত লেখা নয়, ব্যক্তিগত প্যাঁচালি।
যাওয়াটা খুব জরুরি, এ জন্য যাওয়া।
এ সময়ে শখের ভ্রমণ কেউ করে?
যাওয়ার জন্য ছোটখাটো পাগলামিও করলাম। কার্ডিওলজিস্টকে দেখানোর কথা ছিল, দেখাইনি। যদি বলে বসেন ‘নো’, আপনি ট্রাভেল করতে পারবেন না। এমনটি ঘটেছিল ২০১৭ সালে। ডাক্তারের বারণে সে বার বাংলাদেশে যেতে পারিনি। এবার তাই ডাক্তারকে এড়িয়ে বিমানে চড়ে বসলাম। এ রকম ঝুঁকি অন্য কেউ নিক, মনে-প্রাণে তা চাই না। আমার পাগলামি আমারই থাক।
দুর্বল মনে হাজারো দুশ্চিন্তা বাসা বাঁধে।
বুধবার ফ্লাইট, মঙ্গলবার সকালে গুঁড়ি গুঁড়ি, ফিনি ফিনি বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় এসে পড়ে। খানিক পর শরীরটা ঝাঁকুনি দেয় বার কয়েক।
সর্বনাশ!
জ্বর?
তা হলে ভারী বিপদ। নিউইয়র্ক, ইস্তাম্বুল বা ঢাকায় স্ক্যানিংয়ে ধরা পড়বে, গায়ে তাপমাত্রা বেশি। আর যায় কোথায়, সোজা কোয়ারেন্টাইন! ১৪ দিনের বন্দিত্ব!
করোনা নামের আতঙ্কে এর বিকল্প কিছু নেই! সাবধানের মার নেই বলে কথা।
আচ্ছা, তাদের বললে কি বুঝবে না, এটা ঠান্ডা জ্বর। করোনা নয়।
আমি বলা আর না বলায় কী আসে যায়। জ্বর নেই তো কিছু নেই। জ্বর আছে তো উটকো অনেক অনেক কিছু আছে!
এই জ্বর ভাবনায়, ভাবনা নয়, দুশ্চিন্তায় শরীর ঘেমে উঠল। আমার স্ত্রী হাসি। আমার সফরসঙ্গী। তার যাওয়ার কথা ছিল না। একা একা আমার ভ্রমণ ঠিক হবে না ভেবে চার সপ্তাহের ছুটি নিয়ে সঙ্গী হয়েছেন। ৪১ বছর ধরে আগলে রাখছেন। তার ঋণ কি করে শোধ করি?
হাসিকে আমার দুর্ভাবনার কথা বলিনি।
বললে অবশ্য ভালো হতো। অনেক সময় এমন এমন উদ্ভট ভাবনা আমাকে পেয়ে বসে, হাসিকে শোনাবার পর নিজেকে হালকা বোধ করি, অবশ্য এ জন্য বাড়তি উপহার জুটে, একটি ধমক!
মনটা হালকা করার জন্য কিছু হালকা খবর পড়তে চাইলাম। কী আছে হালকা খবর!
বাংলাদেশের পাপিয়া!
না, এত হালকা নয়। নির্মম।
নষ্ট রাজনীতির এই প্রোডাক্টকে ভুলে থাকতে চাই।
লাঠি হাতে সোফায় বসা তার ছবিটি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠে। কি ভয়ংকর ছবি!
পাপিয়ার চেয়ে ভালো ট্রাম্পের খবর। তাঁর ভারত সফরের মজার মজার খবর আছে।
গুজরাটে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের উদ্বোধনী বক্তৃতায় ট্রাম্প দুজন ক্রিকেটারের নাম উচ্চারণ করেছেন, শচীন টেন্ডুলকার ও বিরাট কোহলি। কিন্তু নাম দুটি ঠিকভাবে বলতে পারেননি। আর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসির খোরাক হয়েছেন। শচীনকে বলেছেন ‘শু চিন’, কোহলিকে বলেছেন ‘কুহলি’। এর চেয়ে গুবলেট হয়েছে যখন স্বামী বিবেকানন্দের নাম নিয়েছেন, বলেছেন ‘বিবেকা-মু-নান্ড’।
এটা হাসির ব্যাপার নয়, ক্ষোভ ও বেদনার। গান্ধী আশ্রমে গিয়ে পরিদর্শক বইয়ে গান্ধীর পরিবর্তে মোদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। এমনকি গান্ধীর নামটি পর্যন্ত নেননি।
গুজরাটের বক্তৃতায় বহু ধর্ম ও জাতি-গোষ্ঠীর ভারতীয় সমাজের প্রশংসা যখন করছিলেন, তখন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের পক্ষ-বিপক্ষের সংঘর্ষে রাজধানী দিল্লি হচ্ছিল রক্তাক্ত।
ছবি আসল তাজমহলের সামনে ট্রাম্প ও ম্যালেনিয়া। মুগ্ধ ট্রাম্প। বলেছেন, বিস্ময়কর।
মনে পড়ে তিন দশক আগের কথা। নিউজার্সির আটলান্টিক সিটিতে ট্রাম্পের ‘তাজমহল’ ক্যাসিনোর উদ্বোধন হলো। অনেকের কণ্ঠেই উচ্চারিত হলো আপত্তি। জুয়ার আসরের নাম ভালোবাসার নিদর্শন ঐতিহাসিক স্থাপনার নামে হবে, এটা অনেকেই মানতে পারছিলেন না। তখন কে শুনে কার কথা।
আশা করি, ট্রাম্প আসল তাজমহল ও ক্যাসিনো তাজমহলের ফারাকটা বুঝতে সক্ষম হবেন।
হালকা খবরের কথা বলে বলে সব ভারী খবরের দিকেই এগোচ্ছি।
কাল আল–জাজিরার খবর শুনছিলাম। ‘করোনা’ এখন প্রায় সব চ্যানেলেই হেডলাইন। একপর্যায়ে এল ওয়ালস্ট্রিটের খবর। অস্থির স্টক মার্কেট। ঘন ঘন দরপতন। করোনা আতঙ্ককে দায়ী করলেও একপর্যায়ে রিপোর্টার বললেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারিতে বার্নি স্যান্ডার্সের একটানা তিনটি বিজয়ও স্টক মার্কেটে প্রভাব ফেলেছে। ‘সমাজতন্ত্রী’ বার্নির অগ্রযাত্রায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে।
বার্নির বিরুদ্ধে খবর আরও আছে।
অভিযোগ ছিল, ২০১৬ নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ে সহায়তা করেছিল রাশিয়া। একই অভিযোগ এবারও উঠেছে, যদিও ট্রাম্প অস্বীকার করেছেন। এবার যুক্ত হয়েছে নতুন নাম, বার্নি। বলা হচ্ছে, রাশিয়া চাচ্ছে প্রাইমারিতে বার্নির জয় হোক। এ লক্ষ্যে তারা কাজ করছে। এতে ট্রাম্পের সুবিধা হবে। নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সহজেই ‘সমাজতন্ত্রী’ বার্নিকে পরাস্ত করতে পারবেন।
পুঁজিবাদের তীর্থভূমিতে কি করে সমাজতন্ত্রের জয় সম্ভব?
শুরুতে ধারণা ছিল, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হবেন। কিন্তু বিরাট ব্যবধানে তিনি পিছিয়ে পড়েছেন। অবশ্য হাল ছাড়েননি বাইডেন। বলেছেন ঘুরে দাঁড়াবেন। ২৯ ফেব্রুয়ারি সাউথ ক্যারোলিনায় প্রাইমারি। ওখানে এগিয়ে আছেন বাইডেন। এরপর ৩ মার্চ সুপার টুইস ডে। একসঙ্গে ১৪ স্টেটে হবে প্রাইমারি। ওই দিনের ফলাফলে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে, কে হতে যাচ্ছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী। ঢাকায় বসে তাকিয়ে থাকব সে দিনের প্রতি।
বার্নির বিরুদ্ধে যতই অপপ্রচার হোক, একটি বিষয় মানতে হবে, বহুজাতিক আমেরিকান সমাজের তৃণমূলে যে নাড়া তিনি দিয়েছেন, তার একটা ইতিবাচক পরিণতি ঘটতে পারে। সম্পদের সুষম বণ্টন, বিনা মূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার যে স্লোগান দিয়েছেন, তার প্রতিধ্বনি হচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হাজারো কণ্ঠে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যে ধারণা দিয়েছেন, তা আকৃষ্ট করছে মানবাধিকার সংগঠনকে।
বার্নি যখন বলেন, ওরা ১ ভাগ আর আমরা ৯৯, তখন সাধারণ মানুষকে আন্দোলিত করে। তাঁর উত্থান, বলা যায় নীরব ‘বিপ্লব’। ২০১৬ সালে স্বয়ং ট্রাম্পই ভাবতেন, তিনি পাস করবেন না। নির্বাচনের রাতে শত শত সাংবাদিকের ভিড় হিলারির ক্যাম্পে, ট্রাম্পের ক্যাম্প শূন্য প্রায়। সবাই ধরে নিয়েছিলেন, হিলারিই বিজয়ী হবেন। মধ্যরাতের পর দেখা গেল, ব্লু স্টেটগুলো রেড হয়ে যাচ্ছে। সাংবাদিকেরা তখন হিলারি ক্যাম্প থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন ট্রাম্প ক্যাম্পের দিকে। তাই বলা যায়, আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে আগাম কিছু বলা অত্যন্ত দুরূহ।
না, হাসিকে আর আমার দুশ্চিন্তার কথা বলা হলো না।
অলীক কিছু বলে ধমক খেয়ে লাভ নেই।

লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক।