বাংলা নেই কেন?

একুশে ফেব্রুয়ারি মাত্র পার হলো। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এই একটি দিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যাপন করার বাইরে আর কীভাবে করা সম্ভব? কি করা উচিত। লাগসই, আর কি হতে পারে? এ বিষয়ে বেশির ভাগ মানুষ এক বাক্যে বলবেন, শুদ্ধ বাংলার চর্চা, সব পর্যায়ে বাংলাকে চালু করা ইত্যাদি। একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক দুদিন পরেই আমি কঠিন দুটি প্রশ্নের মুখে পড়ি। তারপর মনে হলো, এই যে আমাদের ভাষা নিয়ে এত গর্ব, এত উচ্ছ্বাস, এত দিবসভিত্তিক আনুষ্ঠানিকতা—কিন্তু সেই ভাষাকেই উচ্চাসনে কতটুকু বসাতে পারছি?
প্রথম প্রশ্নটি এসেছে দেশ থেকে। একজন আমাজনে একটি বই প্রকাশ করতে চাইছেন। এখন আমাজন ‘নিজেই প্রকাশ করুন’ (সেলফ পাবলিশিং) চালু করে পুরো বিষয়টাকে জলবৎ তরলং করে ফেলেছে। মাত্র ১০ মিনিটে কিন্ডেল বই প্রকাশ হয়ে যাবে। তাঁদের কাগুজে বই প্রকাশের সুবিধাও আছে, তবে সেটা ১০ মিনিটে হবে না। তবে কিন্ডেলের প্রকাশনাটির কোনো দেশ–কাল–পাত্র ভেদ নাই। পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে বসেই আপনি করতে পারছেন। যা হোক, তাঁকে আমি সাহায্য করছিলাম। আমাজন কিন্ডেলে অনেক ভাষায় বই প্রকাশের সুযোগ থাকলেও, বাংলায় সেই সুযোগটি এখনো পূর্ণাঙ্গরূপে নেই। তবে অন্য একটা উপায় এখন অবশ্য আছে। তাঁকে জানালাম, পিডিএফ আকারে বাংলা বইটিকে সহজেই আমাজনে ‘নিজেই প্রকাশ করুন’—সেকশন থেকে প্রকাশ করা যায়। সে ক্ষেত্রে আমাজন কিন্ডেলকে সেই বর্ণমালার ফন্ট সাপোর্ট করতে হচ্ছে না।
সবই ঠিক ছিল। পিডিএফ পেলাম, আপলোড করলাম। একটু এগোতেই দেখা গেল, তারা জানতে চাইছে, পিডিএফের লেখা কোন ভাষার? উনত্রিশটি ভাষার তালিকা থেকে উত্তর দিতে হবে। ভারতের পাঁচটি ভাষা আছে, কিন্তু বাংলা নেই। হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, তামিল ও মালায়ালাম আছে। বাংলা তো একটি প্রধান ভাষা, এমনকি ভারতেও! গোটা পৃথিবীর পঞ্চম (কোনো কোনো মতে অষ্টম) বহুল প্রচলিত ভাষাটি, সেটিকে আমাজনের মতো বিশাল একটি সংস্থা, যার শুরুই হয় বই দিয়ে, স্থান দেয়নি! খুবই অখ্যাত কিছু ভাষাকে স্থান দিয়েছে! তারা বলছে, সেই অখ্যাত ভাষাগুলোর লিপি রোমান লিপি (ইংরেজি), সে কারণে তাদের লোকসংখ্যা বেশি না থাকলেও, সহজে যোগ করা গেছে।
আমাজনের কথা যদি ধরেই নিই, তাহলে মারাঠি? চাইনিজ? রাশিয়ান? তারা তো রোমান লিপির ভাষা নয়? এ নিয়ে একটু খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম, সঠিক কারণ কোথাও দেওয়া নেই। অনেকে বিভিন্ন ফোরামে বাংলার মতো একটি সমৃদ্ধ ভাষা নেই কেন, সে প্রশ্ন তুলেছেন। নানান মানুষ, এমনকি আমাজন কিন্ডেল ডাইরেক্ট পাবলিশিংয়ের (কেডিপি) নিজস্ব উত্তরদাতাও উত্তর দিয়েছেন, সেটাকে সদুত্তর বলা যাবে না। তাদের একটি ‘বট’ আছে, যা ভাষার লিখিত রূপের ধরনটা বোঝে। তারপর খুঁজে দেখে, এই বইটি অন্য কোনো বইয়ের নকল কি না। বাংলায় তাঁরা এখনও সেটা করতে পারছেন না বলে নাকি কিন্ডেলে বাংলা দিতে পারছেন না। তাহলে আমহারিক (ইথিওপিয়ার ভাষা)? তার হরফের সঙ্গে রোমান হরফের কোনোই মিল নেই, তাকে সেই ‘বট’ পড়ছে কীভাবে?
দেখলাম, একজন দুবছর আগে চেঞ্জ ডট অর্গ–এ ‘আমাজন কিন্ডেলে সত্ত্বর বাংলা ভাষা যোগ করতে হবে’ এই দাবি নিয়ে একটি পিটিশন খুলেছিলেন। সেখানে মাত্র ৬৯৯টি ভোট পড়েছিল। পিটিশনের পক্ষে লাখ লাখ ভোট পড়লে তবে কর্মকর্তাদের চোখে পড়তে পারে। সেই পিটিশনটি মাঠে মারা গেছে। যার বই আমাজনে প্রকাশ করার জন্য আমি সাহায্য করছিলাম, তাকে পরিস্থিতি জানাতে তিনি বললেন, ওই পিটিশন তিনিই নাকি খুলেছিলেন। কোনো কাজ হয়নি। তিনি পিডিএফটি হিন্দি ভাষার বলে টিক চিহ্ন দিলেই বোধকরি সেটি আমাজন বেশি ঘাঁটাঘাঁটি না করে প্রকাশ করে ফেলবে। কিন্তু তিনি তা করবেন না। বরং জানতে চাইছেন, বাংলা নেই কেন? কীভাবে যোগ করা যায়? তিনি একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুল দিতে গিয়েছেন কি না আমার জানা নেই। কিন্তু ভাষার জন্য ভালোবাসা ফুল দেওয়ার মধ্যে থাকে না, থাকে মানুষের বুকে।
ধরে নিলাম, আমাজন কিন্ডেল বাংলাদেশে ব্যবহার হয় না। কিন্তু এত লাখ বাঙালি বিদেশে থাকে, আমরা ভাষার জন্য এত ভালোবাসা দেখাই, যেখানে গুজরাটি/মারাঠি ঢুকে গেল, বাংলা ঢুকল না কেন?
পরের খবরটিও ঠিক একুশে ফেব্রুয়ারির পর পর জানতে পেলাম। আমেরিকায় অনেক অঙ্গরাজ্যেই নাকি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা ইংরেজি ছাড়াও অন্য ভাষায় দেওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ইংরেজির বাইরেও বহু ভাষায় এই পরীক্ষাটি দেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। তাদের ভাষার তালিকা এক নয়। তবে এই বিপুল তালিকার কোথাও, কোনো অঙ্গরাজ্যেই বাংলা নেই। যেমন আলাবামায় ১৩টি, নিউইয়র্কে ১৪টি, ভার্জিনিয়ায় ২১টি ভাষার তালিকায় রয়েছে। সবচেয়ে বেশি রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়, ৩৩টি। সেই ভাষাগুলোর কিছু কিছুর নামও শুনিনি। তালিকাটি নিচে দিলাম।
আমহারিক, আরবি, আর্মেনিয়ান, কম্বোডিয়ান, ক্যান্টোনিজ, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, গ্রিক, হিব্রু, হিন্দি, হমং, হাঙ্গেরিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান, ইতালিয়ান, জাপানিজ, কোরীয়, লাওশিয়ান, মান্দারিন চাইনিজ, ফারসি, পোলিশ, পর্তুগিজ, পাঞ্জাবি, রোমানিয়ান, রাশিয়ান, সামোয়ান, স্প্যানিশ, তাগালোগ, টোঙ্গান, টার্কিশ ও ভিয়েতনামিজ।
বাংলা কই? আমেরিকায় নিউইয়র্ক ছাড়া প্রায় সব অঙ্গরাজ্যে গাড়ি চালানো একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার কারণে, গাড়ি চালাতে না পারার কারণে, জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। সে কারণে ভালো চাকরি হচ্ছে না, অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেকটাই বন্দী জীবন। শুধু ইংরেজি না বোঝার কারণে এই পরীক্ষায় পাস করতে পারছেন না, এমন নজির কম নেই। বাংলায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকলে হাজার হাজার মানুষের জীবনের দুঃখ কিছুটা হলেও ঘুচে যেতে পারত।
এসব নিয়ে এগিয়ে আসবে কে? ঝোঁক তো আনুষ্ঠানিকতা আর উৎসবের দিকে। তাঁর কিয়দংশ যদি এসব ভাষাভিত্তিক ব্যবহারিক কাজে লাগানো যেত, তাহলে বোধকরি ভাষার প্রতি আরও সম্মান দেখানো হতো, বাংলা ভাষাভাষীর জন্য সামান্য হলেও কল্যাণকর কিছু হতে পারত।