ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা

আমাদের বয়সী যাঁদের ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের আগের জন্ম, তাদের স্কুল, কলেজের পাঠ্যপুস্তকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যক্ষেত্রে মুসলমানদের অনেক ভূমিকা ও উপস্থিতি পরিলক্ষিত হতো। ধীরে ধীরে সিলেবাস বদল হতে হতে, বিশেষত ইতিহাস বারবার পুনর্লিখিত হওয়ার ফলে, ভারতের নানা ক্ষেত্রে মুসলমানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদানের কথা একরকম ধামাচাপা পড়ে গেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে তা অজানা আর চোখে না পড়ার ফলে বয়স্কদের কাছেও সেসব স্মৃতিও আর বেঁচে নেই। ভারতের স্বাধীনতাপূর্ব, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রেই মুসলমানদেরও যে অনেক মূল্যবান অবদান আছে, সে সম্পর্কে পাঠকদের জানাতে এই ধারাবাহিক লেখা
মোজাফফর আহমেদ
মোজাফফর আহমেদ

মোজাফফর আহমেদ ছিলেন একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ। তিনি কাকাবাবু নামেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর জন্ম হয় ১৮৮৯ সালের ৫ আগস্ট, মৃত্যু ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর। তিনি ছিলেন একাধারে একজন ভারতীয়, বাঙালি রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা ও কমিউনিস্ট নেতা।
প্রাথমিক জীবন: মোজাফফর আহমেদের জন্ম তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের (বর্তমান বাংলাদেশের) নোয়াখালী জেলার সন্দ্বীপ থানার মুঁয়াপুর নামক গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ছিল মনসুর আলী ও মায়ের নাম ছগুনা বিবি। তিনি নোয়াখালী জেলা স্কুলে ও কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯১৮ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির যুগ্মসচিব নিযুক্ত হন। ১৯২০ সালে তিনি ও কাজী নজরুল ইসলাম মিলে ‘নবযুগ’ নামে একটি নতুন সাহিত্য পত্রিকা চালু করেন। এটি ১৯২০-২১ সালে কৃষক ও শ্রমিকদের অবস্থা ও জীবনযাপনের কথা সমাজের কাছে তুলে ধরে। তিনি ‘লাঙল’ ও ‘গণবাণী’ পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। ‘গণবাণী’ পত্রিকার নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম হয় গণশক্তি। পরে ১৯২২ সালে কাজী নজরুল যখন ‘ধূমকেতু’ নামে অন্য একটি পত্রিকা বের করেন, তখন ‘দ্বৈপায়ন’ ছদ্মনামে তিনি ওই পত্রিকায়ও লেখালেখি করেছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন: মোজাফফর আহমেদ ১৯২৬-২৭ সালে ও ১৯৩৭ সালে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন। ইতিমধ্যে রাশিয়ান রেভ্যুলিউশনের সাফল্য দেখে ও তাতে প্রভাবিত হয়ে তিনি এম এন রায়ের মারফত মস্কোর থার্ড ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন এবং ভারতে একটি কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অফিশিয়ালি চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবে তিনিই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২২ সালে যখন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা হয়, তিনি তার প্রথম সেক্রেটারি নিযুক্ত হয়েছিলেন। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই), কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একটি শাখা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিল। তিনি খেটে খাওয়া গরিব মানুষের আন্দোলনের কাজে পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেছিলেন এবং ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের কার্যকলাপের মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন।
১৯২৪ সালে কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলায় মা ঘনিষ্ঠ ভূমিকার জন্য তাঁকে এস এ ডাঙ্গে, নলিনী গুপ্ত ও শওকত উসমানীর সঙ্গে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯২৫ সালে অসুস্থতার কারণে তিনি মুক্তি পান। মুক্তির পর তিনি খেটে খাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের সঙ্গে আরও গভীরভাবে মিশে যান ও সারা ভারতে তাদের অর্গানাইজ করেন ও সব ধরনের ধর্মঘটে শামিল হন। ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে তিনি, কাজী নজরুল ইসলাম, হেমন্ত কুমার সরকারসহ অন্যরা মিলে বাংলায় শ্রমিক স্বরাজ পার্টির আয়োজন করেন। ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে কানপুরে যখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সর্বপ্রথম উন্মুক্ত কনফারেন্স হয়, তখন তিনি ‘সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটি অব দি কমিউনিস্ট গ্রুপস’–এর সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯২৯ সালের ২০ মার্চ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ৩১ জন শ্রমিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করে বিচারের জন্য মিরাটে চালান দেয়। এই তথাকথিত মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় মোজাফফর আহমদকে প্রধান আসামি বানানো হয়। অন্যদের মধ্যে ছিলেন এস এ ডাঙ্গে, শওকত উসমানি, পি সি জোশী সহ আরও অনেকে। ১৯৩৬ সালে তিনি মুক্তি পান। প্রধান আসামি হিসেবে তাঁকে সর্বোচ্চ সময় জেলে কাটাতে হয়। মুক্তির পর চাষিদের হিতকর কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন ও ‘অল বেঙ্গল কিষান’ সভা প্রতিষ্ঠার কাজে লাগেন। তিনি সব রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির জন্যও আন্দোলন শুরু করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মোজাফফর আহমেদ আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান ও সেখান থেকে সুনিপুণভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। রাশিয়া এই যুদ্ধে যুক্ত হওয়ার পর সরকারকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং সে জন্য কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।

রাশিয়ান রেভ্যুলিউশনের সাফল্য দেখে ও তাতে প্রভাবিত হয়ে তিনি এম এন রায়ের মারফত মস্কোর থার্ড ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা করেন এবং ভারতে একটি কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অফিশিয়ালি চিহ্নিত করা হলেও বাস্তবে তিনিই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২২ সালে যখন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা হয়, তিনি তার প্রথম সেক্রেটারি নিযুক্ত হয়েছিলেন। সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই), কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একটি শাখা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিল। তিনি খেটে খাওয়া গরিব মানুষের আন্দোলনের কাজে পূর্ণ আত্মনিয়োগ করেছিলেন এবং ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের কার্যকলাপের মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন।


দেশ ভাগের পর: ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মোজাফফর আহমেদ নিজ জন্মভূমি সন্দ্বীপ, যেটি তখন পূর্ব পাকিস্তানে পড়ে গিয়েছিল, সেখানে না থেকে তিনি বরাবরের মতো ভারতের কলকাতায় বসবাস করেন। তাঁর মামলাটি অনেকটা নেতাজির ডানহাত, জেনারেল শাহ নাওয়াজের মতো, যিনি পশ্চিম পাকিস্তানে পড়ে যাওয়া জন্মভূমি পেশোয়ার ও নিজ স্ত্রী, পুত্রকন্যা ত্যাগ করে ভারতে চলে এসেছিলেন। তফাত হলো, তিনি কংগ্রেস পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন আর মোজাফফর আহমেদ কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করে সেই পার্টিতেই লেগে ছিলেন। কংগ্রেস পার্টি তাঁকে বারবার জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। ১৯৪৮ সালের ২৫ মার্চ ভারত সরকার কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়াকে আবার বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। সে জন্য অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে মোজাফফর আহমদকে জেলে অন্তরীণ করা হয়। ১৯৫১ সালে তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত—এই দুই বছরের জন্য জেলে ঢোকানো হয়। ১৯৬৫ সালে আবার তাঁকে দুই বছরের জন্য জেলে পাঠানো হয়। ১৯৬৪ সালে যখন কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়াপন্থী ও চীনপন্থী—এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, তখন তিনি বামপন্থী গ্রুপ, মার্ক্সিস্ট গ্রুপের প্রতি তাঁর সমর্থন দিয়েছিলেন ও সিপিআইয়ের (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি আদর্শগতভাবে গণতন্ত্র, নারী অধিকার, খেটে খাওয়া গরিব মানুষ, আন্তর্জাতিকতা, বাক স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার একজন মুখপাত্র ছিলেন।
পারিবারিক জীবন: মোজাফফর আহমেদের নার্গিস নামে একটি কন্যা সন্তান ছিল। কবি আবদুল কাদিরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
মৃত্যু ও স্মরণীয়: ১৯৭৩ সালে ৮৪ বছর বয়সে কলকাতায় মোজাফফর আহমেদ দেহত্যাগ করেন।
পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সিস্ট) হেড হেডকোয়ার্টার মোজাফফর আহমেদের নামে নামকরণ করা হয়। কলকাতার বিখ্যাত রিপন স্ট্রিটের নাম পাল্টিয়ে সেটিকে মোজাফফর আহমেদ স্ট্রিট করা হয়।
মোজাফফর আহমেদের বই: তিনি বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের বছরগুলি’ (১৯২১ থেকে ১৯৩৩), ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ (স্মৃতিকথা), ‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’।