অভিবাসী হওয়ার আগে স্বচ্ছলতার প্রমাণ লাগবে

>
  • ইমিগ্রেশন বিভাগের অবাধ নির্বাহী ক্ষমতা
  • সহজেই ভিসা বা গ্রিনকার্ড প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা
  • অভিবাসী কমিউনিটিতে চরম উৎকণ্ঠা

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ইমিগ্রেশন বা অভিবাসনবিরোধী চাতুর্যপূর্ণ বিধিমালা ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হয়েছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের ইমিগ্রেশন সংকুচিত করার এই উদ্যোগে আমেরিকার মধ্যে ঢালাও ইমিগ্রেশনবিরোধী মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অভিবাসনবিরোধী নানা ইস্যুতে রিপাবলিকান পার্টির বিজয় দেখছে রক্ষণশীলরা। চার দশক আগে ডেমোক্র্যাট প্রণীত পাবলিক চার্জ বিধি কার্যকর করে আমেরিকার ইমিগ্রেশনের চিত্র পাল্টে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
নতুন বিধিবিধানে আটকা পড়বেন নতুন আসা ইমিগ্রান্ট বা অভিবাসীরা। আমেরিকায় আসার আগেই তাদের প্রমাণ করতে হবে, তারা এখানে স্বাবলম্বী জীবনযাপন করতে পারবেন। স্বাবলম্বী বিবেচনার জন্য ইমিগ্রেশন বিভাগের জন্য অবাধ নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ফলে সহজেই ভিসা প্রত্যাখ্যান করা যাবে। গ্রিনকার্ড প্রত্যাখ্যান করা হবে, নাগরিকত্বের আবেদনে পিছিয়ে থাকবে লাখ লাখ ইমিগ্রান্ট। আমেরিকার ইমিগ্রেশনের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন আমূল পরিবর্তনে অভিবাসী কমিউনিটির মধ্যে বিরাজ করছে চরম উৎকণ্ঠা।
মেডিকেইড বা স্বাস্থ্যসেবা, ফুড স্ট্যাম্প বা খাদ্য সহায়তা, হাউজিং বা আবাসনের সরকারি সুবিধার মতো অপরিহার্য সুযোগ–সুবিধা নিলেই খড়্গ নেমে আসবে। পাবলিকে চার্জে পড়বেন যারা, তাদের সংখ্যাটি এখানে ব্যাপক। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার আগে থেকেই সরকারি এসব সুবিধার জন্য আবেদন কমে এসেছে। নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, মিশিগানসহ ইমিগ্রান্টবহুল অঙ্গরাজ্যগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সরকারি সুবিধার অফিসে লোকজনের উপস্থিতি কমে গেছে। তিন মাস আগেও এসব অফিসে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে বসে থাকতে হতো। এখন সরকারি সহযোগিতা অফিসের কর্মীরা অলস বসে আছেন, কখন কেউ সহযোগিতার আবেদন নিয়ে আসেন কিনা, তার অপেক্ষায়।

ইমিগ্রান্ট স্বার্থ রক্ষাকারী সংস্থাগুলো মনে করছে, এমন বিধি আরোপের ফলে স্বল্প আয়ের ইমিগ্রান্ট অনাহারে–অর্ধাহারে থাকবে। অসুস্থ হলেও সরকারি স্বাস্থ্যসেবা থেকে নিজেদের দূরে রাখবে। বাড়বে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা। মানবিক দেশ হিসেবে বছরের পর বছর ইমিগ্রান্টদের নানা সুবিধা দিয়ে আসা আমেরিকা এমনি করেই বদলে গেল বলে আক্ষেপ করছে অভিবাসীদের স্বার্থ দেখার লোকজন।
রিপাবলিকানদের প্রকাশ্য সমর্থন থাকলেও ডেমোক্র্যাটরা কোনো রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে এই সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসেনি। ডেমোক্র্যাট দলের অতি উদারনৈতিক নেতারা যেমন আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতের জাতীয় বিতর্কে ইমিগ্রেশনের এই ইস্যুটি স্থান পায়নি।
নতুন ইমিগ্রান্টদের আমেরিকায় আসার আগেই অ্যাম্বাসি বা কনস্যুলেট অফিসে তাদের প্রমাণ করতে হবে নিজেদের সামর্থ্যের কথা। জটিল এই বিবেচনাটি বেশ কিছু বিষয়কে সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। যারা বাইরে থেকে আসবে বা যারা আমেরিকায় তাদের ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাস অ্যাডজাস্ট করবে, তাদের আবেদনে বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করা হবে।
আদেশের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে ইমিগ্রেশন আইনজীবীরা বলছেন, আবেদনকারীর বয়স ১৮ বছরের নিচে বা ৬১ বছরের ওপরে হলে ইমিগ্রেশন বিবেচনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউট (এমপিআই) বলেছে, আবেদনকারীর বার্ষিক আয় ফেডারেল দারিদ্র্যসীমার নিচে হলেও নেতিবাচক হবে। দারিদ্র্যসীমার ১২৫ শতাংশ ওপরে হলে ইমিগ্রেশনের জন্য ইতিবাচক ধরা হবে। আবেদনকারীর স্বাস্থ্য, পরিবারের আকার, আয়, নিজস্ব সম্পদ—সবকিছু এখন গ্রিনকার্ড বা ইমিগ্রেশন ভিসা দেওয়ার আগে বিবেচনা করা হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে এমপিআই। কোনো আবেদনকারীর সাধারণ শারীরিক সমস্যাকে স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে দেখা যেতে পারে। একে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিনকার্ড পাওয়া ব্যক্তিদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৪৩ শতাংশ এমন ইমিগ্রান্ট কোনো ধর্তব্য কাজে নেই, এমনকি স্কুলেও যায়নি। ২৩৯ শতাংশের ইংরেজি জ্ঞান নেই। ৩৩ শতাংশের বার্ষিক আয় দারিদ্র্যসীমার ১২৫ শতাংশের নিচে। ২৫ শতাংশ হাইস্কুল পাশ। দারিদ্র্যসীমায় বসবাস করা ব্যক্তিদের মধ্যে ১২ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের কম বা ৬১ বছরের বেশি। সাম্প্রতিক গ্রিনকার্ডধারীদের মধ্যে ৬৯ শতাংশেরই অন্তত দুইটি পাবলিক চার্জের নেতিবাচক উপাদান রয়েছে। ১৭ শতাংশের রয়েছে অন্তত একটি নেতিবাচক উপাদান।
এমপিআই তাদের বিশ্লেষণে জানিয়েছে, অধিকাংশ আবেদনকারীর মধ্যেই পাবলিক চার্জের বেশ কিছু ইতিবাচক ও নেতিবাচক উপাদান রয়েছে। এর মধ্যেই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা কীভাবে বিবেচনাগুলো প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা দেখতে উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষায় আছেন আতঙ্কিত ইমিগ্রান্টরা।
ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ডেমোক্র্যাট হাবুয়ার বেসেরা ও গভর্নর গাভিন নিউসম বলেছেন, তারা ট্রাম্প প্রশাসনের এমন বিধির বিরুদ্ধে আবার আদালতে যাবেন, মামলা করবেন। যদিও ২২ ফেব্রুয়ারি ইমিগ্রেশন বিভাগ থেকে পাবলিক চার্জ বিধি কার্যকর করাকে ট্রাম্প প্রশাসনের আইনগত বিজয় বলে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
বিধিটি আরোপের উদ্যোগ নিলে গত আগস্ট থেকে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলায় এই বিধি আরোপের কার্যকারিতা সাময়িক স্থগিত রেখে নিম্ন আদালত থেকে আদেশ আসতে থাকে। প্রশাসনের পক্ষে থেকে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে সুপ্রিম কোর্টের রক্ষণশীল বিচারকদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিধিটি কার্যকর করার পক্ষে রায় দেওয়া হয়।
রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী, গর্ভবতীসহ বেশ কিছু অভিবাসীর জন্য পাবলিক চার্জ বিধি কার্যকর নয়। ফ্লোরিডা, নিউইয়র্ক, অ্যারিজোনাসহ বেশ কিছু এলাকায় ইমিগ্রান্টদের সহযোগিতা করতে সেমিনার করা হচ্ছে। কারা পাবলিক চার্জে পড়বেন, এ নিয়ে প্রতি ইমিগ্রান্টের অবস্থান ভিন্ন। শুধু ভয়ের কারণে চুপসে না গিয়ে ইমিগ্রেশন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। ইমিগ্রেশন আইনজীবীরা বিনা মূল্যেই এসব পরামর্শ দিচ্ছে। পাশাপাশি ইমিগ্রেশন নিয়ে কাজ করে এমন সব নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের অবস্থান জেনে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। শুধু আতঙ্কিত হয়ে নিজেকে স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন বা খাদ্য সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত না করার জন্য ইমিগ্রান্টদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।