গল্পের একুশে

ছেলের স্কুল থেকে ফোন এল সুপ্তির কাছে, যেতে হবে স্কুলে। কারণ ছেলে সমস্যা করছে। চিন্তায় পড়ে গেল সুপ্তি। কী হলো আবার!
মাত্র পাঁচ মাস হল, গল্প স্কুল শুরু করেছে। এর মধ্যে কতবার যে এ রকম ফোন কল পেয়েছে ওরা। সোহাগ সময় দিতে পারেনি, সুপ্তিকেই যেতে হয়েছে। বছরখানেক হলো ওরা মাইগ্রেটেড হয়ে নিউইয়র্কে এসেছে। এখনো খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে। কখনো কখনো মনে হয় দেশে ফিরে যেতে। কেন যে এসেছিল! কিন্তু সোহাগ ফিরতে চাচ্ছে না। ওর ভাই-বোনেরা সবাই এ দেশে। ও একাই ছিল এত দিন দেশে। সবার ছোট ভাই, তাই ভাই-বোনদের কাছাকাছি থাকতে চায়। তাই বলে দেশের জন্য টান নেই, তা নয়।
সোহাগ একটা কাজ পেয়েছে নিউজার্সিতে। প্রতিদিন ট্রেনে যায়, কষ্ট হচ্ছে ওর। তবে ওখানে ভালো করতে পারলে ওরা নিউজার্সিতেই চলে যাবে। সুপ্তি ঢাকায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াত। এখানেও স্কুলে চেষ্টা করেছে, তবে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, তাতে সময় লাগবে। তাই আপাতত একটা ফাস্ট ফুডের দোকানে কাজ নিয়েছে।
ওর পাশের বাড়িতে শ্রীলঙ্কার একটি পরিবার থাকে। পরিবারের বউটির নাম দীঘা, ওর সঙ্গে সুপ্তির বেশ ভাব হয়ে গেছে। ওর স্বামী ওই ফাস্ট ফুড দোকানের ম্যানেজার, তিনিই সুপ্তিকে কাজটা দিয়েছেন। পাঁচ বছরের গল্পকে নিয়ে এখন ওর ফুলটাইম কাজ করারও জো নেই। তাই এটাই মেনে নিয়েছে। মনকে কষ্ট করে শাসন করে রাখে। প্রথম প্রথম কষ্ট হতো, এখন কিছুটা ঠিক হয়েছে।
সোহাগের কাজটা স্থায়ী হয়ে গেলে তখন ধীরে-সুস্থে সব ব্যবস্থা করা যাবে। সকালে গল্পকে স্কুলে দিয়ে সে কাজে যায়। গল্প স্কুল থেকে ফিরে আসে দীঘার বাচ্চাদের সঙ্গে, সুপ্তি তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কাজ থেকে ফিরে গল্পকে নিয়ে ঘরে চলে আসে। এভাবেই চলছে। গল্প এখনো পুরোপুরি আমেরিকান কায়দাকানুন রপ্ত করতে পারেনি। শুধু গল্প কেন, ওরাই কি পেরেছে?
ম্যানেজারকে গিয়ে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে বললে, ‘এক্ষুনি যাও’। এদিক থেকে সুপ্তির ভাগ্য ভালো বলতে হবে। ম্যানেজার প্রতিবেশী ও বেশ বুঝদার। সে জানে, ছোট বাচ্চা স্কুলে দিলে এ রকম যখন-তখন কল আসতে পারে। ছেলের স্কুল ছয় ব্লক দূরেই। স্কুলে গিয়ে যা শুনল, তাতে ও হাসবে, না কাঁদবে ভেবে পেল না। গল্প আজ সারা দিন বাংলায় কথা বলেছে। ইংলিশ বলতেই চাচ্ছে না। ওর কথা কেউ বুঝতে পারছে না। শুধু বাংলাতেই যে কথা বলছে তা নয়, ইশারায়ও কথা বোঝাতে চাইছে। সুপ্তির ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেই গল্প নার্সারিতে পড়ত, এখানে তাকে কেজিতে ভর্তি করা হয়েছে।
এই পাঁচ মাসের মধ্যে অনেকবারই কল পেয়েছে স্কুল থেকে, একেকবার একেক রকম সমস্যা। একবার কল এল, গল্প নাকি সারা দিন ক্লাসের এক কোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কারণ ওর পাশে বসা মেয়েটি ওকে বলেছিল, ‘আই লাইক ইউ’। সে কিছুতেই আর কারও পাশে বসবে না। তবে আজকের সমস্যাটি নিয়ে ওর টিচার চিন্তিত। তাঁর বক্তব্য, গল্প অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না। আসলে ভাষার সমস্যা তো থাকবেই, সুপ্তি ভাবে। কিন্তু গল্প তো ইএসএল ক্লাসেও যাচ্ছে। কিছু কিছু ইংলিশ তো ও জানেই। একটু সময় তো লাগবেই। কিন্তু এদের সেটা কীভাবে বোঝায়! বিষয়টি নিয়ে আগেও স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ওদের কথা হয়েছিল।
সুপ্তি জিজ্ঞেস করল গল্পকে, ‘কেন বাংলা কথা বলছ বাবা? তুমি কি বুঝতে পারছ না টিচারের কথা?’
‘বুঝেছিলাম তো’ গল্প বলে।
‘তাহলে? দেখত, আমাকে কাজ বাদ দিয়ে তোমার স্কুলে আসতে হল। বুঝেছিলে তো, বাংলায় কেন কথা বলছিলে?’ সুপ্তি একটু গম্ভীর হয়ে বলল।
গল্প চুপ করে আছে, ওর দুঠোঁট ফুলে ফুলে উঠছে, চোখের জলের পূর্বাভাস সুপ্তি বুঝতে পারল।
সুপ্তি ফিসফিস করে বলল, ‘কাঁদে না, এটা স্কুল, তোমার বাসা নয়।’
সামলে নিল নিজেকে গল্প। তারপর বলল, ‘মা, আজকে ২১ ফেব্রুয়ারি, আজকে আমি কিছুতেই ইংলিশ কথা বলতে চাচ্ছি না।’
এতক্ষণে সুপ্তি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, তাই তো? আজ তো ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখ। নতুন দেশে, নতুনভাবে বাঁচতে গিয়ে তো ভুলেই গিয়েছিল আজকের দিনটির কথা। গর্বে ওর বুক ভরে গেল। গল্প সেই ছোট থাকতেই ওরা দুজনেই দেশের কথা, দেশের ইতিহাস অল্প–অল্প করে বলেছে। গল্প সেগুলো নিজের ছোট্ট বুকের মধ্যে ধারণ করে আছে, মনটা ভালো হয়ে গেল ওর।
‘এই কথা?’ সুপ্তি বলল, ‘কিন্তু বাবা, স্কুলে তো কেউ বাংলা বলে না। ওরা কী করে বুঝবে, তুমি কি বলছ?’
‘আমি কি করব তাহলে? ওদের বুঝতে হবে, আজকের দিনটায় আমি কিছুতেই বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে পারব না।’
অতঃপর সুপ্তি টিচারকে সবিস্তারে ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের কথা বলল। ওরা আমেরিকায় চলে আসবে, তাই গল্পকে ছোট বেলা থেকেই বাংলাদেশের কথা, ভাষা আন্দোলনের কথা গল্পের ছলে বলেছে। যাতে বড় হয়ে গল্প দেশের কথা ভুলে না যায়। গল্প জানে, এই ভাষার জন্য কত কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে গিয়ে কত কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে।
সব শুনে গল্পের টিচার চোখ মুছলেন, গল্পকে কাছে টেনে নিলেন। তারপর সুপ্তিকে বললেন, ‘আমি মুগ্ধ! তোমাদের দেশপ্রেম দেখে। এতটুকু বাচ্চাকেও তোমরা তোমাদের দেশ সম্পর্কে, ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে এত সুন্দর করে বুঝিয়েছ, আমি আপ্লুত। তোমাদের দেশাত্মবোধ অনেক গভীর।‘
গল্পকে জড়িয়ে ধরে টিচার বললেন, ‘ঠিক আছে, আজকে আমরা সবাই তোমার ইশারা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করব, তবে তোমার কাছে আমার একটি প্রশ্ন আছে।’
গল্প ইশারায় জানতে চাইল, কী সেই প্রশ্ন। টিচার বললেন, ‘তোমার সামনে তোমার সারাটি জীবন রয়েছে, তুমি কি পারবে তোমার এই সংকল্পটি ধরে রাখতে? কারণ তুমি তো এখন অন্য একটি দেশে বাস করছ, যেখানে ইংলিশ হলো প্রধান ভাষা।’
গল্প বাংলাতে বলল, ‘অবশ্যই পারব’। সুপ্তি বুঝিয়ে বলল, গল্প কী বলেছে।
টিচার বলে উঠলেন, ‘সত্যি আমি মুগ্ধ এবং সেই সঙ্গে গর্বিত তোমার মতো বাংলাদেশের একজন ছাত্রকে পেয়ে। তোমার দেশ ও দেশের পুরো জাতির জন্য আমার অফুরন্ত শ্রদ্ধা।’