আসল সৌন্দর্য

লিমা ও তিথি দুই বোন। লিমা ছিল অপূর্ব সুন্দরী আর তিথি ছিল একদম আলাদা। কালো ও কুৎসিত। জন্মের পর তিথির মুখটি দেখে মা কষ্টে কেঁদে উঠেছিল। হাসপাতালের নার্স ও ডাক্তার তাদের মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তিথিকে কোন আশ্রমে রেখে আসবে কিনা। মা বোধ করি দশ মাস দশ দিন পেটে রেখে সহজে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সেদিন।
ছোট বেলা থেকে লিমাকে সবাই খুব আদর করত। তিথি তা অবলীলায় মেনে নিত। তিথি বুঝে নিত, ওকে কেউ ভালোবাসে না। কারণ, ও দেখতে অসুন্দর। ওর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে মানুষ কথা বলতে পারত না। শুধু কালো বলে নয়, জন্মগতভাবে অদ্ভুত, অন্যরকম এক চেহারা নিয়ে জন্মেছিল সে। এক কথায় যাকে স্পেশাল বলে। বাহ্যিক দেখার কারণে অনেক অবহেলা সহ্য করতে হতো। দেখতে তিথি আলাদা, কিন্তু বুদ্ধিতে তিথি ছিল লিমার চেয়ে থেকে অনেক বেশি চৌকস। তারপরও যেন স্কুল সহপাঠী আর আশপাশের মানুষের কটু কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছে তিথি। কখনো নিজেকে অবহেলিত মনে করেনি। সহপাঠীরা বলত, তিথি পড়াশোনায় ভালো হলে কী হবে, যে চেহারা-জীবনে কী হবে ওর!
তিথি মাথা নিচু করে দুফোঁটা চোখের জল ফেলত। সৃষ্টিকর্তা কেন সবার থেকে অন্যরকম করে বানিয়েছে ওকে। তিথির ছোট বেলায় বন্ধু ছিল না বটে। তিথির বাবা সব সময় তিথিকে সাপোর্ট দিত। ওর সঙ্গে খেলা করত, ভরসা দিত। তিথি ভাবত, এই বাবাটা না থাকলে আজ আমি তিথিকে অন্য গ্রহের ভাবত। আমি এমনভাবে জন্ম নিয়েছি, সেটা তো আমি তিথির দোষ নয়। বাবা বলত, দেখবে তুমি একদিন আলাদাভাবে সবার থেকে ওপরে উঠবে। সবার মুখে মুখে তোমার নাম থাকবে। ছোট বেলায় ক্লাসের পড়া করার সময় তিথির মা লিমাকে তার পড়া নিয়ে রাত অবধি পার করত। আর তিথি পড়তে বসেই পড়া দ্রুত শেষ করে ঘুমাতে যেত।
তিথির মায়া হতো লিমার জন্য। লিমা ওর সঙ্গে ঘুমাতে পারছে না। এত রাত পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে পড়া শেষ করার জন্য বসে থাকতে হতো। মা বলতেন, পড়া শেষ না হলে ঘুমাতে যেতে পারবে না। তাতেও যেন তিথি ভালোবাসা পেত না মায়ের কাছ থেকে। মানুষের সব ধরনের ভালোবাসা লিমা যেন ছোট বেলা থেকে পেয়ে বড় হয়েছে, কিন্তু তিথি কোন দিনও কারও দৃষ্টিগোছর হয়নি। ভালোবাসা পাওয়া তো দুরে থাক। একই বাড়িতে দুই বোন বড় হয়েছে দুই ভাবে। লিমা ভাবে, আচ্ছা তিথি কেন এত ভালো। ওর কোন প্রতিক্রিয়া নেই কেন। কেউ ওকে ভালোবাসে না। ও কোন ড্রেস পরলে কেউ কোনো দিন বলেনি, ওয়াও!! তোমাকে লাগছে ভারী সুন্দর।
কিন্তু লিমাকে সবাই বলে, দেখতে লাগে পরির মতো। সবাই বলত লিমা রাজকন্যার মতো। তিথি নিজেকে আড়াল করে রাখে সব সময়। লিমাকে দেখে তিথি ভাবে, ইশ্ আমি যদি আপু লিমার মতো রাজ কন্যা হতে পারতাম! মনে আছে, মা সুন্দর জামাটি লিমাকে দিতেন। লিমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। মনে মনে ভাবতেন, তিথি যে অন্যরকম, তাকে পরিচয় করিয়ে দিলে সে সবার কাছে ছোট হয়ে যাবে। সবার জিজ্ঞাসার উত্তর থেকে বাঁচার জন্য মা খানিকটা লুকিয়ে রাখত তিথিকে। প্রিয় মাকে বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচানোর জন্য তিথি যেন সাহায্য করত মাকে আর বোনকে।
তিথির খুব ছোটবেলা থেকে বুঝবার ক্ষমতা ছিল। মাকে কোন দোষ দিত না। মা বোধ করি তিথিকে ছোট না করার জন্য ই মা লিমাকে সামনে আনত। লিমাকে গুরুত্ব দিত। অন্যদের কাছে তার কোন গুরুত্ব ছিল না, তাই তিথি নিজেই যেন সবকিছু করতে শিখেছে। নিজের বোনকে নিয়ে গর্ব করে খুশি হতো তিথি। ভালোবাসত নিজের বোনের ভালোবাসার মানুষগুলোকে। স্কুলে পড়ার সময় ক্লাসের শেষের দিকে সবার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে তিথি বসত। প্রশ্নের উত্তর দিলে বন্ধুরা সব সময় হাসাহাসি করত। বলত, যার চেহারা এত কুৎসিত, সে কী করে স্কুলে আসে পড়ালেখা করতে। শখ কত! এই চেহারায়, তাজেলের পাঠ করতে চায়। সব সময় অবাঞ্ছিত কথার সম্মুখীন হতে হতো।
তিথি কুৎসিত, সৃষ্টি কর্তার দান। এ তো তিথির কোন দোষ নয়। কেন তাহলে মেনে নিতে পরছে না কেউ তিথিকে। শুধু বাবা তিথিকে বুঝতে পারত। যখনই তিথি সবার সমনে অবাঞ্ছিত ব্যবহারের সম্মুখীন হতো, বাবা তিথিকে পাশে থেকে হাতটি ধরতেন। বোঁচা নাক, ছোট চোখ। গায়ের রং কালো। বামন, পাট ফেসার মতো চুল। মাথাটা ছিল অনেক বড়। আলাদা চেহারা। মানুষের অবহেলায় তিথি ভাবত, কেন বাবা-মা ছোটবেলায় আমাকে মেরে ফেলনি। বাবা ছায়ার মতো সব সময় তিথির পাশে থাকত। বলত, একদিন ওরা সবাই তোমাকে বুঝতে পারবে, তুমি ওদের থেকে ভিন্ন কিছু নও। তুমি আলাদা নও। তোমার ওদের মতো হাত পা, তোমার বুদ্ধি আছে। তুমিও অনেক কিছু করতে পার।
সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে মা প্রতিদিন চুল বেঁধে দিত লিমার, কোনভাবে মা যেন তিথির চুলকে বাঁধতে পারতে না। এখানেও তিথি যেন অনুভব করত মায়ের কষ্ট। লিমার ছিল খুব সুন্দর চোখ নাক। চুল ছিল কালো ঘন মেঘের মতো। এখানে কোন না কোন উদ্দেশ্য সৃষ্টিকর্তার বোধ করি ছিল।
একদিন তিথি ক্লাস শেষ করে বাইরে বসে বই পড়ছিল। একদল মেয়ে এসে নানাভাবে তিথিকে আজেবাজে কথা বলছিল। এসব শুনে তিথির দুচোখে পানি গড়িয়ে পড়ে। তিথি ভাবে, সবার কত বন্ধু থাকে। আমার কেন একটি বন্ধু নেই। নিজের বোনও কিছুটা এড়িয়ে চলে। ওর তো দোষ নেই, বন্ধুদের কারণে বোনকে এড়িয়ে যায়।
একদিন তিথির কান্না ভরা চোখ দেখে ওদের মধ্যে রুবি নামে একজন এসে পাশে ডেকে বলল, তুমি সব সময় একা কেন থাকো? আমি আজ থেকে তোমার বন্ধু। এখন থেকে তোমার আর কোন কষ্ট থাকবে না। সেই থেকে যখনই কেউ তিথিকে কুৎসিত বলত, রুবি পাশে দাঁড়াত, রুবি প্রতিবাদ করত। তিথি মহা খুশি রুবিকে বন্ধু হিসেবে পেয়ে। রুবি সব সময় তিথির বোন লিমাকে বোঝাতে চেষ্টা করত। তিথিকে সাহস দিত, বলত নিজেকে লিমার মতো একই সমান ভাবতে। লিমার অহংকার ছিল সুন্দরের।
সবার মনোযোগ লিমাকে অহংকারী করে তুলেছিল আকাশচুম্বী। তিথিকে লিমা তাই ভালোবাসতে পারে না তার মতো করে। লিমার ধারণা, তিথি অন্য মানুষ। রুবি তিথির পাশে থাকার জন্য লিমাকে বোঝাতে চেষ্টা করে। যেখানে সবাই তিথিকে বাঁকা চোখে দেখে, রুবির অনেক কষ্ট হয় তিথির জন্য। রুবি লিমাকে বলে, তিথি অদ্ভুত দেখতে। তিথি আমাদের সবার থেকে আলাদা। কিন্তু ওরও হৃদয় আছে, অনুভূতি আছে। আমাদের ওকে সাহায্য করতে হবে। আজ থেকে আমরা এক হয়ে তিথির সঙ্গে থাকব।
লিমা ধীরে ধীরে নিজেকে পরিবর্তন করে। রুবি লিমাকে বোঝাতে চায়, আজ তোমাকে সৃষ্টিকর্তা এমন করে তৈরি করলে কী করতে। আজ তিথিদের মতো মানুষেরা আছে বলে আমরা আমাদের চিনতে পারি। এরপর তিথি, লিমা, রুবি তিনজন এক হয়ে স্কুলে যায়, বাইরে যায় বেড়াতে। লিমা একসময় ধীরে ধীরে বুঝতে পারে তিথির কষ্ট। যারা লিমার বন্ধু, তারা তিথির পাশে না দাঁড়ালে লিমা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব শেষ করে দেয়। যেসব বন্ধুদের খারাপ উক্তি তিথিকে নিচু করত, লিমা তাদের কাছে গিয়ে বোঝাত তিথি তার বোন। একসময় স্কুলে লিমার মতো তিথির বন্ধু হয়। দেখতে দেখতে লিমা আর তিথি অনেক বড় হয়ে যায়।
লিমাকে স্কুল ছেড়ে কলেজে যেতে হয়। তিথির এখনো দুবছর বাকি আছে কলেজে যাওয়ার। কলেজে যাওয়ার পর লিমার এক সময় প্রেম হয় রনির সঙ্গে। অনেক গভীর প্রেম। কিন্তু লিমা রনিকে আগেই বলে দেয়, বোন তিথিকে মেনে নিয়ে গড়তে হবে আমাদের এই ভালোবাসা। আমার বোন শুধু বোন নয়, ও আমার বন্ধু। একই রকম সাজতে পছন্দ করত লিমা আর তিথি। কোথাও গেলে তিথিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে লিমা উপস্থাপন করার চেষ্টা করত।
এদিকে তিথি লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়ায় একটার পর একটা পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে লাগল। লিমা কলেজ ছাড়ার পর তিথির এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলো। রেজাল্ট বের হলো, বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করে জিপিএ ফাইভ নিয়ে এসএসসি পাস করেছে। পেপার, ম্যাগাজিন, টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা তিথিদের বাড়িতে। তাকে নিয়ে খবর বেরোল। যারা একদিন তিথির বাবা-মাকে দেখে হাসত, নিজেদের সন্তানকে আলাদা করে রাখত তিথির ছায়া থেকে, তাঁরাই আজ তিথিকে একটু সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলতে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তিথি যেন এ এক অন্য তিথি। একের পর এক পাস করে সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ স্কোর করেছে।
আজ সব বন্ধ দরজা তিথির জন্য খোলা। তিথির জন্য বহু অভিজাত পরিবারের ছেলেরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছে। তিথি আজ সত্যিকারের রাজরানি। এরই মধ্যে লিমার পরিবর্তন শুরু হয়। দেশ-বিদেশে তিথির এত সুখ্যাতি দেখে লিমার খুশির চেয়ে যেন হিংসা এসে ভর করতে থাকে। বন্ধু, আত্মীয়-পরিজন সব জায়গায় তিথিকে নিয়ে যেন জয়গান। আজ তার রূপ-গুণের কদর অনেকের কাছে বিষময়! ধীরে ধীরে তিথিকে যেন সহ্য করতে কষ্ট হয় লিমার। লিমা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না তিথির জয়গান।
তবে কী লিমা ভুল করেছে! যারা একদিন লিমাকে নিয়ে হইচই করত, আজ তিথিকে সবাই ভালোবাসে। একদিন লিমার রূপ-গুণ সবার কাছে ছিল প্রাধান্য। লিমা ছিল সবার চোখের মধ্যমণি। কিন্তু এখন আর কেউ লিমাকে নিয়ে কথা বলে না। তিথিকে নিয়ে হইচই সবার আনন্দের বার্তা। লিমা যেন ধীরে ধীরে অসহ্য এক বেদনায় সিক্ত হতে থাকে। একদিন সে তিথিকে অনেক বিষাক্তভাবে আক্রমণ করে। তিথিকে বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। তোর অদ্ভুত চেহারার কারণে আমি অনেক ভালো বন্ধু হারিয়েছি। তোর মতো আগলি বোনকে আমি পাশে না রাখলে তুই কোন দিন এত বড় হতে পারতি না।
কিন্তু তিথি উল্টো লিমার উপকারের কথা ভুলতে পারেনি। বলে, আপু ছোট বেলায় তোমার আনন্দই ছিল আমার সব আনন্দ। তোমার সব প্রাপ্তিতে ছিল আমার প্রাপ্তি। আজ তোমার কষ্ট আমার কষ্ট। তুমি নিজেকে অবহেলিত ভাববে না। সবাই যে উৎসব করছে, ভাববে আমার বোন আজ আমার গর্ব। তুমিই তো আমার আদর্শ ছিলে। আমাকে যারা ঘৃণা করত, তাদের সবাইকে তুমি পরিবর্তন করে তাদের ভালোবাসতে শিখিয়েছ আমাকে। তোমার ভালোবাসার শক্তিতে তারা নিজেদের পরিবর্তন করে আজ শুধরেছে। আজ আমি তিথি সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়, তোমারই সব অবদান। তুমি কী তোমার মাঝে, তোমার ভালোবাসার সৃষ্টিকে ধ্বংস করে দিতে চাও।
লিমা যেন আজ তিথির কথায় বুঝতে পেরেছে, ও ভ্রান্তপথ দিয়ে হেঁটে চলেছে। বাহ্যিক সুন্দরের চেয়ে অন্তরের সুন্দরের অনেক শক্তি। তিথি আমার বোন ও সব হিংসা-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ছিল। যখন আমাকে সবাই ভালোবাসত অথচ দেখতে অন্যদের থেকে অনেক আলাদা কুৎসিত ছিল। হৃদয় ছিল স্বচ্ছ কাচের মতো। আর আমি অনেক সুন্দর হয়েও অন্তরে লালন করছি ভয়ানক হিংসা-বিদ্বেষ, যা আমার সৌন্দর্যকে করেছে ম্লান, আর কুৎসিত। যা আপন বোনকে হিংসার দাবানলে পিসে ফেলতে দ্বিধা করছে না। যার বিষ আমার উদারতাকে দিয়েছে ছানি। আজ তিথি লিমাকে বুঝিয়েছে, বাহ্যিক সৌন্দর্য ক্ষণিকের আর তা সত্যিকারের সুন্দর মানুষ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। চামড়ার নিচে কেউ ভিন্ন নয়, সবাই এক অভিন্ন। সেখানে যার হৃদয় সুন্দর, পরের তরে নিজেকে বিলীন করতে সাহস থাকে, সেই সৌন্দর্যই আসল সুন্দর।