'ভেজা রোদের বসন্তে'র দিকে

বই: ভেজা রোদের বসন্তে, লেখক: আবদুস শহীদ, প্রকাশক: নাগরী, পৃষ্ঠা: ১২০, মূল্য: ২৪০ টাকা
বই: ভেজা রোদের বসন্তে, লেখক: আবদুস শহীদ, প্রকাশক: নাগরী, পৃষ্ঠা: ১২০, মূল্য: ২৪০ টাকা

আবদুস শহীদ মূলত কবি। কিন্তু তাঁর ‘ভেজা রোদের বসন্তে’ কবিতার বই নয়। আমেরিকাপ্রবাসী লেখক আবদুস শহীদ এটি দ্বিতীয় প্রকাশনা। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে সুনামগঞ্জ কলেজে পড়ার সময় তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয়। আশির দশকের শেষের দিকে পাড়ি দেন বিদেশে। এ কারণে লেখালেখিতে ছেদ পড়ে। দীর্ঘ ৩৫ বছর কবিতা আর কবিতাঙ্গন থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখলেও পুরোপুরি আসন ছেড়ে তিনি পালাতে পারেননি।
কয়েক বছর ধরে আগের সেই তেজ নিয়ে যেন ফিরে এসেছেন নীড়ে। লিখছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা। প্রকাশিত লেখার সংগ্রহ গ্রন্থ হচ্ছে এই ‘ভেজা রোদের বসন্তে’।
‘ভেজা রোদের বসন্তে’ কাব্যগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ বা প্রবন্ধগ্রন্থ নয়। এটি মিশ্র গ্রন্থ। এতে আছে আমাদের গৌরবের স্বাধীনতার কথা। আছে গল্প, স্মৃতিকথা কিংবা ভ্রমণ কাহিনি। পাঁচ অধ্যায়ের বইয়ে প্রথম অধ্যায়ে আছে ১৪টি গল্প। দ্বিতীয় অধ্যায়ে কৈশোরের স্মৃতিকথায় নৌকাবাইচ নিয়ে সুন্দর বর্ণনা। গ্রাম বাংলার সংস্কৃতি নিয়ে লিখেছেন, ঐতিহ্যের মালজোড়া গান, ঘাটুগান ও বেতশিল্পের শীতলপাটি ওপর তথ্যবহুল লেখায় সাজিয়েছেন তৃতীয় অধ্যায়। চতুর্থ অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে তিনটি ভ্রমণ কাহিনি এবং পঞ্চম অধ্যায়ে স্থান দিয়েছেন গৌরবের মুক্তিযুদ্ধকে।
তাঁর ‘ভেজা রোদের বসন্তে’ পড়তে সময় নিইনি। গোগ্রাসে শেষ করেছি। পরিচিতজনের লেখা পড়তে ভালো লাগে। নিজেকে লেখার বিষয়বস্তুর সঙ্গে খুব পরিচিত মনে হয়। বিশেষ করে স্মৃতিকথা কিংবা ভ্রমণ কাহিনি ভালো লাগে। চিত্রপট নিজের মনে হয়। প্রতিক্ষণে উপলব্ধি হয় নিজের কথা যেন অন্যজন বলে যাচ্ছেন।
বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে নাতিদীর্ঘ একটি গল্প। গল্পের নামেই মূলত গ্রন্থের নামকরণ। সায়লা নামের মফস্বলের একটি মেয়ে। ডিবি লটারি পেয়ে আমেরিকা আসে। অজানা, অচেনা পরিবেশে একা একটি মেয়ে। বাংলার আটপৌঢ়ে তরুণী জীবনের প্রথম প্রবাস। জীবনের বাস্তবতা কোথায় তাঁকে নিয়ে গেল?—এসব নিয়ে তিনি সাজিয়েছেন সায়লার অভিবাসী জীবনের শুরুর কাহিনি। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সায়লা। অর্থ ও সমাজের কাছে পরাজিত হলো। ভালোবাসা, ভালো লাগা কঠিন বাস্তবতায় হারিয়ে গেল। ফরিদ মিয়া। দুর্দিনে যিনি সায়লাকে আগলে ধরেছিলেন। বটবৃক্ষের ছাতা উঁচু করে ধরে মাথায় রেখেছিলেন। সায়লাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন। বাস্তবতার কাছে সায়লার পরাজয়। ফরিদ আর সায়লার কাছে সব একাকার হয়ে গেল।
এই কাহিনি খুব পরিচিত। পড়তে গিয়ে যে কারও মনে হবে খুব পরিচিত কাহিনি লেখক বলছেন। তিন খণ্ডে বিভক্ত না করে গল্পটিকে একবারে শেষ করলে পারতেন। আমার কাছে কিছুটা খটকা লেগেছে।
দ্বিতীয় গল্প ডুপ্লিকেট চশমা। গল্প হলেও আমার কাছে কাহিনির বাস্তবতা স্মৃতিকথা মনে হয়েছে। এটাও ভেজা রোদের বসন্তের মতো একজন অভিবাসীর গল্প। আসাদ যিনি প্রতারিত হয়েছেন ভিসা বিড়ম্বনায়। দালালের খপ্পরে পড়ে যারা বিদেশ আসেন তাঁদের চিত্রপট ভেসে উঠেছে কাহিনিতে। আছে কুসুম কুসুম ভালোবাসা। কাহিনিতে লেখকের মুনশিয়ানার ছাপ মেলে। কলেজ পড়ুয়া আসিফ আর সুজানার অব্যক্ত ভালোবাসা অব্যক্ত থেকে গেল কিন্তু রেখে গেল হাজারো প্রশ্ন।
হুলিয়া, শেকড়ের সন্ধানে, আরেক ছুটির ঘণ্টা, মহারানির ঘোড়সওয়ার, লুঙ্গি বিড়ম্বনা, ডাকাত দেখতে এসে ডাকাত গ্রেপ্তার, আমাদের স্বাধীনতা ও একজন মি. মার্টিন—বিভিন্ন নামে এ সব প্রতিটি গল্পে প্রাণ আছে। মাটির কাছাকাছি নিয়ে যায়। চোখের সামনে ঘটছে তাই মনে হয়। ‘হিরালি শাহ কালাচান্দ’ গল্পটি বেশ মজার।
লেখকের কৈশোরের স্মৃতি নৌকাবাইচ। মালজোড়া গান। ঘাটুগান। বাংলার সংস্কৃতি শীতলপাটি নিয়ে লেখাগুলো বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকের পাতায় পড়েছি। তথ্যবহুল লেখাগুলো পড়লে হারিয়ে যাওয়া বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। ভ্রমণ কাহিনিতে আছে-ফিরে দেখা ইউনিভার্সেল স্টুডিও। ক্যারাবিয়ান দ্বীপের দিনগুলো। পুয়ের্তোরিকোর বিখ্যাত দুর্গ। ফ্লোরিডা দর্শন-এক ও দুই। ফিরে দেখা স্ট্যাচু অব লিবার্টি। দর্শনীয় স্থান নিয়ে লেখকের লেখা পড়লে নিঃসন্দেহে পাঠক অনেকে দেখার স্বাদ না দেখায় পেয়ে যাবেন।
শেষ এবং পঞ্চম অধ্যায়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। কাছ থেকে দেখা একজন সূর্য সৈনিক মুক্তিযোদ্ধার কথা বর্ণনা করেছেন। নতুন প্রজন্ম এ থেকে কিছু জানতে পারবে। পূর্ব পুরুষদের অবদানের কথা হেলা করার নয়। ১২০ পৃষ্ঠার ‘ভেজা রোদের বসন্তে’ প্রকাশ করেছে সিলেটের নাগরী প্রকাশনা সংস্থা। মূল্য ২৪০ টাকা। প্রচ্ছদ করেছেন আল নোমান।