ভাইরাল ঘটনা

নীলা বিছানায় শুয়ে জানালার দিকে ফিরে ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ততা দেখছিল। সন্ধ্যা নেমেছে বেশ আগেই। এই শহরে ঘড়ির কাটা বলে দেয় এখন সন্ধ্যা, রাত, গভীর রাত। মানুষের কোলাহলে সন্ধ্যা, রাত, রাতের নিস্তব্ধতার কিছুই উপলব্ধি করা যায় না। নাসিমা বেগম নিঃশব্দে কখন যে নীলার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন কে জানে! ষাটোর্ধ্ব বয়স্ক নারীর চলাফেরা কিছুটা অদ্ভুত। এই ঘুমে অসাড়, আবার কিছুক্ষণ পরে দেখা যাবে কিচেনে চা গরম করছেন। রাতে শামীম ফিরতে দেরি করলে গভীর রাতেও নীলাকে চা খেতে ডাকবেন। ছোট ছোট পায়ে হেঁটে নিলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেন, শামীম ফেরেনি?
—না।
—ফোন করেছিস? রাত তো অনেক হলো।
—না। এই শহরে রাত আছে নাকি?
প্রতিদিনের মতো আজও নীলাকে চায়ের আমন্ত্রণ জানান, চল দুজনে মিলে চা খাই।
—এত রাতে চা খাবেন!
‘এই শহরে রাত আছে নাকি?’ নাসিমা বেগম নীলার কথাটা ফিরিয়ে দিয়ে একগাল হাসেন। খুব মজা পাওয়া ভাব। বিয়ের প্রথম দিকেই নীলাকে কাছে বসিয়ে নাসিমা বেগম বলেছিলেন, নীলা আমি কিন্তু তোকে তুই করে বলব। কিছু মনে করবি না। আমার তো মেয়ে নেই। তুই আমার মেয়ে। আমাকে শাশুড়ি না ভেবে মা ভাববি, মা।
নীলা রাগ করেনি। বেসুরে গলার সুরেও যদি মমত্ব থাকে সেখানে রাগের বদলে ভালোবাসা ভিড় করে। নীলা নাসিমা বেগমকে মায়ের মতোই ভেবেছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর নাসিমা বেগম কিছুটা একাকিত্ব অনুভব করেন, বোঝা যায়। তাঁর গল্পের মানুষ যেন সুদূর মগ্ন প্রসাদে বসে তাকিয়ে দেখেন শুধু। কথা বলেন না।
শামীমের সঙ্গে পরিচয় বসন্তের কোনো এক সকালে। বসন্তের কোকিলা সুর এই ঢাকা শহরে শোনা যায় না। কাকের অনবরত কা কা শব্দের ভেতর কর্মব্যস্ত মানুষ ভুলে যায় বসন্ত আর কোকিলের কথা। সাড়ে ছয়টায় কোচিং। বাড়ি ফিরে সকালের নাশতা সেরে আবার কলেজ। রাস্তায় বেরিয়ে উবার লেখা একটা বাইক দেখে ডাক দেয়, এই উবার যাবে? উবারে যাওয়ার নিয়ম যদিও এমন নয়। তারপরও নিয়ম মেনে আমরা কী করছি!
একেবারে গা ঘেঁষে বাইক দাঁড় করায় বছর পঁচিশের যুবক। একগাল হেসে জবাব দেয়, আমি উবার না।
—সে তো দেখতেই পাচ্ছি।
—ওই যে বললেন এই উবার...
নীলার রাগ হয়। একটু কড়া সুরেই বলে, জীবনে শোনেননি এই রিকশা, এই ট্যাক্সি, এই গাড়ি।
যুবক ঘাড় নাড়ে, হু, শুনেছি।
—তো!
—কোনোদিন রিকশা, ট্যাক্সি, গাড়িকে তো বলতে শুনিনি-হ্যাঁ, যাব। দেখুন মুখহীন উবার কিছু বলে কিনা।
নীলা কিছুক্ষণ যুবকের দিকে তাকিয়ে থাকে। উজ্জ্বল শ্যামলা রং আর মায়াবী একটা মুখ। চেহারায় সরলতা। নীলার রাগ পড়ে যায়। মুচকি হেসে বলে, ওরা কী কথা বলতে পারে নাকি?
—তাহলে গাড়িকে আর ডাকবেন না। এই গাড়ি। বলবেন এই যে ড্রাইভার।
নীলা সায় দেয়, হু।
—তা কোথায় যাবেন?
নীলা ঠিকানা বলে বাইকে উঠে পড়ে। ১৫-২০ মিনিটের পথে টুকটাক কথা হয়। কোথায় থাকে, কী নাম...। বাইক থেকে নেমে ভাড়া দিতে গেলে টাকাটা নীলার হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, থাক না অন্য আরেকদিন দেবেন।
—সে কী! সাত সকালে বাকি? সারা দিন কিন্তু কাস্টমার পাবেন না।
শামীম নীলার চোখে চোখ রেখে বলে, আপনি তো আমার সারা দিনের কাস্টমার, হয়তো সারা জীবনের। কথা শেষ করেই বাইক টেনে চলে যায়। নীলা কী জানত চলে যাওয়াটা শেষ নয় শুরু।
দুদিন পরে কলেজের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়ানো শামীমকে দেখে এগিয়ে যায় নীলা। কাছাকাছি পৌঁছে বলে, এই যে ড্রাইভার এভাবে বাইক নিয়ে ঘুমালে সংসার যে লাটে উঠবে।
শামীমের মুখে স্বভাবসুলভ হাসি, যাবেন নাকি?
—ভাড়া না নিলে যাব না।
সেদিন জেনেছিল, শামীম ড্রাইভার নয়। এক বন্ধু দুষ্টুমি করে বাইকে উবারের স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছে। বছর গড়াতে না গড়াতেই ওদের বিয়ে হয়ে যায়।
—আজ শরীর কেমন? পেছন থেকে নাসিমা বেগমের মায়া ভরা কণ্ঠে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে নীলা।—জ্বি...! কিছু বললেন মা?
—শরীরটা কেমন যাচ্ছে?
—অস্থির লাগছে। মাঝে মধ্যে ব্যথা।
—ঠিক হয়ে যাবে। একদম দুশ্চিন্তা করবি না।
ডোরবেল বেজে ওঠে। নীলা উঠতে গেলে নাসিমা বেগম বাধা দেন। শুয়ে থাক। নড়াচড়া করার দরকার নেই। তিনিই এগিয়ে যান। নীলা জানে শামীম এসেছে। কে যেন ওর আগমন বার্তা নীলার কানে কানে বলে দেয়।
একটা বড় ব্যাগ হাতে শামীম। নিশ্চয়ই বিভিন্ন প্রকার ফল, নীলার কিছু ভিটামিন ওষুধ ব্যাগের ভেতর। এটা কয়েক মাসের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাগ রেখে মা আর নীলাকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
শামীমের চেহারায় খুশির ঝিলিক। তার অনাগত সন্তান আসছে। পৃথিবীতে। এইতো আর কয়েকটা দিন। নীলা বাথরুমের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ বাইরে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। কয়েক সেকেন্ড পর আবার। আবার। শামীম দ্রুত ছুটে আসে। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কাপা কাপা গলায় বলে, আগুন লেগেছে। মা তুমি দ্রুত নিচে নেমে যাও। আমি নীলাকে নিয়ে আসছি। নাসিমা বেগম হতবিহ্বল। কান্না আর চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে বলেন, তোদের রেখে আমি যাব না।
শামীম চিৎকার করে, আগুন ধেয়ে আসছে। প্লিজ পাগলামি করো না।
একটুও নড়েন না নাসিমা বেগম। অগত্যা বাধ্য হয়ে মায়ের হাত ধরে টানাটানি করে নিচতলার গেটে পৌঁছে দিয়ে শামীম দ্রুত বলে, মা তুমি সামনে নিরাপদ স্থানে চলে যাও আমি নীলাকে নিয়ে আসছি।
কথা শেষ করে শামীম দ্রুত ওপরে উঠে যায়। নাসিমা বেগম স্তব্ধ। ছেলের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
নীলা বিছানায় শুয়ে জানালার দিয়ে দেখে, নিচ থেকে উঠে আসা আগুনের লাল আভার ক্ষিপ্রতা। শামীম এসেই হাঁসফাঁস করে বলে, নীলা চলো।
উঠতে গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে নীলা। পেটের ভেতর তীব্র ব্যথার কামড়। ধোঁয়া আর আগুনের ভ্যাপসা গরম। কেমন অস্থির করে তোলে নীলাকে।
—তুমি চলে যাও শামীম। আমি যে নড়তে পারছি না।
আবার বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আগুনের তীব্রতা যেন বেড়ে যায় বহুগুণ। নীলাকে কোলে নিয়ে দরজা পর্যন্ত আসতেই প্রচণ্ড ধোঁয়া আর তীব্র তাপে ক্লান্ত নীলা কাতর কণ্ঠে বলে, আমার গর্ভে তোমার সন্তান। খুব ইচ্ছা হচ্ছে সন্তানকে তোমার হাতে তুলে দিতে। কী করে দিই! আমাকে বিছানায় শুয়ে দাও প্লিজ। আমি যে পারছি না। অগত্যা নীলাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দেয়। নীলা একনাগাড়ে বলতে থাকে, শামীম তুমি চলে যাও। পালাও। যেদিন দেখা হবে সেদিন তুমি তোমার সন্তান আর নীলাকে তোমারই পাবে।
শামীম নড়ে না, বাকরুদ্ধ। মোবাইল বেজে ওঠে, হ্যালো।
ও প্রান্তে হারুনের কণ্ঠ। ছোট ভাই।
—কী অবস্থা তোমাদের?
—নীলা নামতে পারছে না। আমি নীলার সঙ্গে আছি। মাকে নামিয়ে দিয়েছি নিরাপদে। তুই মায়ের খোঁজ নে।
অল্প কথায় ফোনটা কেটে দেয়। ফোনে কথার সময় বহু কষ্টে নীলা শামীমের পাশে এসে দাঁড়ায়। কিছু সময়, কিছু সেকেন্ড। হাত দুটো ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। অশ্রু ভেজা নয়নে মিনতি জানায়, শামীম তুমি যদি আমাকে সত্যি ভালোবেসে থাকো তাহলে চলে যাও।
শামীম হাসে। হয়তো রাজ্যের কান্না, ব্যথা সে হাসির ভেতর লুকানো থাকে। বলে, নীলা এত দিন পরও কী আমাকে নতুন করে বোঝাতে হবে! চেনাতে হবে!
নীলা ডুকরে কাঁদে। ব্যথায়, কষ্টে, ভালোবাসা, মুগ্ধতায়।
আগুন ধেয়ে আসে। জানালা ভেদ করে রুমে। পুড়তে থাকে সব। একটা সময় নীলা আর শামীম। জামা কাপড় থেকে থেকে হাত পা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। শামীমের বুকের ভেতর মুখ গুঁজে নীলা বিড়বিড় করে বলে, ড্রাইভার গেলে না তুমি! কীভাবে যাবে? আমিই যে তোমার সারা জীবনের কাস্টমার...।
শামীম নীলাকে শক্ত হাতে চেপে ধরে। নীলা...শামীম কিছু বলতে গিয়েও পারে না। আগুন এসে চোখ মুখ ঝলসে দেয়।
হারুন যখন পৌঁছেছে তখন চারদিকে আর্তনাদ, চিৎকার, আগুন। খুব একটা সময় লাগেনি। গভীর রাতে হাজারো মানুষের আহাজারি, ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের দৌড়াদৌড়ি, পুলিশের হুইসিল। আগুন। দাউ দাউ করে জ্বলছে। আগুনের লেলিহান শিখা যেন হার না মানা সুউচ্চ পর্বতমালার আগ্নেয়গিরি। মুহূর্তে পুড়ে ছাই হচ্ছে। সব মিলিয়ে নরকের তাণ্ডব যেন নিচে নেমে এসেছে। কে জানত! কীভাবে জানবে নরক নেমে আসার কথা!
রাতের টিউশনি শেষ করে রুমে এসে টেলিভিশনের সুইচ অন করেই ঘটনা দেখে থ। ওখানে তার ভাই ভাবি আর বৃদ্ধ মা থাকে। বড় ভাইয়ের মোবাইলে ফোন করে। কথা শেষ করেই বাইরে দৌড়ে বের হয়। মিরপুর থেকে পুরান ঢাকা বেশ কিছুটা পথ। তাকে যেতেই হবে। এসেছে, কিন্তু সে যে শুধুই এক নিষ্ঠুর, নির্মমতার সাক্ষী।
রাত চলে যায়। পরদিন সকালে যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। হাজার মানুষের সঙ্গে হারুন বড় ভাইয়ের ফ্ল্যাটের দিকে ছোটে। গেটের সামনে পড়ে আছে মানুষ আকৃতির এক মহিলার কয়লা। মাকে বুঝতে সময় লাগে না। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে হারুন। একটা বুকফাটা আর্তনাদ। মা...
লোকজন ঘিরে ধরে। সাংবাদিক, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস সবাই। কেউ একজন প্রশ্ন করে, আপনার মা?
—হ্যাঁ।
—কীভাবে বুঝলেন? ছাই হয়ে গেছে। সবকিছু বিকৃত।
—মা যে। মা ছাই হলেও চেনা যায়।
—আপনার আর কেউ আছে এখানে?
—তিনতলায় আমার ভাই ভাবি। কথা হয়েছিল। ভাবি অসুস্থ নামতে পারেনি। ভাইও নামেনি।
হারুনের আহাজারির সঙ্গে যোগ হয় আর কিছু মানুষের শব্দ ইশ্‌...
তৃতীয় তলায় দেখা যায় ছাইভস্ম। ফ্লোরে পড়ে আছে কঙ্কাল সাদৃশ্য দুটি মানুষ। একসঙ্গে।
মিডিয়ায় ঘটনাটি ভাইরাল হয়ে যায়। নগরসভ্যতার যুগে এ নতুন কোনো ঘটনা নয়। মাঝে মধ্যে মানুষ মরছে। কিছুদিন আলোচনা সমালোচনা পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে সব। মানুষের মুখে মুখে শামীম আর নীলার ভালোবাসার কাহিনি। উৎসুক, ব্যথাতুর মানুষ। খুব দ্রুত হয়তো আরেকটি ট্র্যাজেডি মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হবে। সেখানে অন্য কোনো শামীম-নীলা হবে নতুন আরেক ভাইরাল ঘটনা।