এক নবাবজাদা বলছি

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ফাইল ছবি
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ফাইল ছবি

দেশ ছেড়েছি প্রায় তিন দশক আগে। দেশ ছাড়ার আগে অনুরাগী, অনুসারী—সবাই বেশ বিমর্ষ। আমি নিজেও। দেখি, আমার দীর্ঘদিনের কমরেড শ্যামল বিশ্বাস বেশ উৎফুল্ল। শ্যামল আমার গ্রামের ছেলে। গ্রামের একমাত্র খ্রিষ্টান পরিবারের সদস্য শ্যামল। বাল্যকাল থেকে ছায়াসঙ্গী ছিল। নিজে ম্যাট্রিক পাস করতে পারেনি। বাল্যকাল থেকে বোহিমিয়ান সময়ের নিত্যসঙ্গী শ্যামল। একসময় আমাদের সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্নের সহযাত্রী হয়ে উঠেছিল।

অহর্নিশ ভালোবাসার সতীর্থ শ্যামল হাতে হাত রেখে বিদায় জানিয়ে বলেছিল, আপনি বিদেশ যাচ্ছেন। দেশে তো আপনার কেউ নেই! আমাকে অনেক ডলার পাঠাবেন, আমি সাহেবজাদার মতো থাকব। শ্যামলকে আমার ডলার পাঠানো হয়নি। কিছুদিন পরই শ্যামল মারা গেছে ব্রেন স্ট্রোক করে। নবাবজাদা শব্দটি নিয়ে চলমান আলোচনার সময়ে শ্যামলকে মনে পড়ছে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই।

দেশ ছেড়ে এসে টের পেয়েছি, প্রবাসী হলে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। কষ্ট আর পরিশ্রমের জীবনে একটা সরল স্বাভাবিক জীবনও যাপন করা যায়। সব প্রাপ্তির পরও বুকে একটা হাহাকার ওঠে। দেশে জন্ম নেওয়া কোনো প্রবাসীর বেদনার এ তীব্র হাহাকার কেবল ভুক্তভোগী প্রবাসীই বলতে পারবে। পারবে না দেশে নানা আগাছা আর নোংরা গলি পেরিয়ে উঠে আসা লোকজন।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তখন জর্জ বুশ। আফগান-ইরাকে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য দেশে ব্যাপক সমালোচনায় পড়েছেন প্রেসিডেন্ট বুশ। এমনই এক সময়ে কোনো একজনকে নিয়ে গেছি ‘হোয়াইট হাউস’ দেখানোর জন্য। হোয়াইট হাউসের উত্তরের লনে দীর্ঘ তিন দশকের বেশি প্রতিবাদ করছেন কমরেড ফিলিপ। ওয়াশিংটনে গেলেই তাঁর সঙ্গে কথা বলি। নাগরিক আন্দোলনের এ কমরেডের পাশে দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যে বক্তব্য দিই। সেবারও তা–ই করেছিলাম। এর মধ্যে দেখলাম শ্বেতাঙ্গ এক নারী প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের বিরুদ্ধে নানা খিস্তি আওড়াচ্ছেন। এখানে খিস্তি মানে ‘কিং’ দিয়ে শেষ আর ‘ফা’ দিয়ে শুরু। জর্জ বুশকে গালি দিতে দিতেই আমেরিকান নারীটি আমেরিকার পতাকা পায়ের নিচে দলা দিচ্ছেন আর খিস্তি আওড়ে যাচ্ছেন।

অভিবাসন সূত্রে আমি নব্য আমেরিকান। দেশটির সংবিধান নিয়ে আমিও আনুগত্যের শপথ নিয়েছি। কমরেড ফিলিপকে জিজ্ঞেস করলাম, দেশটির পতাকাকে এমন অপমান করা কি ঠিক হচ্ছে? এমন খিস্তি করা কি ঠিক হচ্ছে?

কমরেড ফিলিপ হাসলেন। বললেন, এটাই নাগরিক অধিকার। বললেন, আমেরিকার এ নারী নিজের দেশকে এমন দেখতে চাননি। যে আমেরিকা যুদ্ধ করে, শিশু হত্যা করে, যে আমেরিকা অমানবিক হয়ে ওঠে নিজের স্বার্থের জন্য, সে আমেরিকার বিরুদ্ধে এ দেশের খাঁটি নাগরিক এমন প্রতিবাদ জানিয়েই নিজের চূড়ান্ত প্রতিবাদটাও জানাতে পারেন।

কমরেড ফিলিপকে বলি, আমাদের পক্ষে তা সম্ভব নয়। আমরা আমাদের দেশকে অপমান করে কোনো খিস্তি আওড়াতে পারি না। আমাদের মুখেও আসবে না। যেমন পারি না নিজের মাকে নিয়ে, পারি না মাতৃভূমিকে নিয়েও।

কমরেড ফিলিপ শান্ত থেকেই আমাকে বোঝালেন, তোমার আবেগের চেয়েও এ ক্ষুব্ধ নারীর আবেগ আর দেশপ্রেমের গভীরতা অনেক বেশি।

আমি বোঝার চেষ্টা করি। শ্বেতাঙ্গ নারীটি তখন খিস্তি আওড়ে যাচ্ছেন। পাশে দাঁড়িয়ে একদল লোক আগ্রহভরে এ নারীর ক্ষোভকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে। পাশেই হোয়াইট হাউসের ওপরে আমেরিকার পতাকা উড়ছে পতপত করে।

কমরেড ফিলিপ, শ্বেতাঙ্গ ক্ষুব্ধ নারী আর হোয়াইট হাইসের ওপরে উড্ডীন পতাকা একসঙ্গে দেখার চেষ্টা করছিলাম। রাজনীতি, সমাজ, সভ্যতা আর সংস্কৃতিতে দেশটি অনেক এগিয়ে থাকার কারণেই কি নিজেদের তারা শ্রেষ্ঠ দাবি করে? বুকপকেটে লাগিয়ে রাখা বাংলাদেশের পতাকাখচিত কোটপিনে চাপ দিয়ে আমি শূন্যে তাকিয়ে থাকি।

আমাদের ইতালিফেরত এক প্রবাসীর এমনই এক উক্তি নিয়ে নানাজনের প্রতিক্রিয়ায় বেশ আগের এ ঘটনা মনে পড়ে গেল। ক্ষুব্ধ এক প্রবাসীর ভুল শব্দচয়ন বা চূড়ান্ত ক্ষোভের উচ্চারণ সীমাহীন মনে হলেও প্রবাসীদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস আমার নেই। তেমনি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে বলেছেন, প্রবাসী দেশে এসে ‘নবাবজাদা’ বনে যান—তাতেও তাঁর ওপর হামলে পড়তে পারি না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগে এ কে আব্দুল মোমেন নিজে প্রবাসীই ছিলেন। একসময় সৌদি আরবে থাকলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন আমেরিকায়। আমেরিকায় আওয়ামী লীগের দুর্দিনে যে কয়েকজন অগ্রসর লোক দলটির নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলেন, আব্দুল মোমেন তাঁদের মধ্যে একজন। দল ক্ষমতায় এলে তাঁকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী দূত নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্বসভায় তাঁর সংযোগটি সে সময় আমরা টের পেয়েছি। দলীয় প্রধান আমাদের সামনেই তাঁকে দেশে গিয়ে অন্য দায়িত্বে নেওয়ার কথা যখন বলছিলেন, আমরা খুশি হয়েছি।

আমাদের সৌজন্যের নগরী সিলেটের এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সদা বিনয়ী মানুষ এ কে আব্দুল মোমেন। সব সময় পরিপাটি থাকেন। গুছিয়ে কথা বলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে কোনো দিন খেই হারাতে দেখিনি।

দেশ ছেড়ে আসার গ্লানিবোধ সব সময় প্রবাসীদের তাড়া করে। জীবন–যৌবন প্রবাসে কাটালেও প্রতিটি প্রবাসী মনে করেন, কোনো মা যেমন সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে পারে না, তেমনি জন্মের দেশটিও তাঁকে কখনো ফিরিয়ে দেবে না।

প্রবাসীদের অবদান, তাঁদের প্রতি অবহেলা আর অবজ্ঞার সাতকাহন এখানে নতুন করে তুলতে চাই না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই আব্দুল মোমেন প্রবাসীদের সমস্যা, আবেগ–অনুভূতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। মন্ত্রী হওয়ার পরও প্রবাসীদের সমস্যা ও কল্যাণ নিয়ে তাঁকে ভাবিত বলে আমরা দেখেছি। চেষ্টাও করছেন নানাভাবে। হঠাৎ তাঁর মুখে প্রবাসীদের তাচ্ছিল্য করে বলা ‘নবাবজাদা’ শব্দটি অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। কথার ফাঁকে ভুল শব্দচয়নের কারণে এমন হয়ে থাকতে পারে। প্রবাসীদের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্কের দাবিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে থেকেই তাঁর এ ‘নবাবজাদা’ শব্দটি প্রত্যাহার করে নেবেন, তাঁর সুহৃদরা এমনটাই চান।

ইব্রাহীম চৌধুরী: আবাসিক সম্পাদক, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা।
[email protected]