বসন্তের আবিরে বিষাদের ছোপ

করিম চাচা বিপত্নীক হওয়ার পর আর দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। ঘর-সংসার ও একমাত্র ছেলে এহসানুল করিম ওরফে বিল্লু ভাইয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব নিজেই পালন করে গেছেন। এভাবে প্রায় এক যুগ পার হয়ে গেল। করিম চাচা এখন চাকরি থেকে অবসরে নিয়েছেন। এদিকে বিল্লু ভাই লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করছে। এবার বিল্লু ভাইয়ের বিয়ে করে সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার পালা। তার বন্ধুরা একে একে বিয়ে করে সংসারী হয়ে যাচ্ছে। করিম চাচাও বিল্লু ভাইকে বিয়ে করাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ঘরে নতুন বউ এনে তার হাতে সংসারের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে তিনি অবসরে যেতে চান।
বিয়ে করতে বিল্লু ভাইয়ের কোনো আপত্তি নেই। এই পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। তবে কোনো মেয়েকেই বিল্লু ভাইয়ের পছন্দ হয়নি। তার আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুরা ইতিমধ্যে বিরক্ত হয়ে গেছে। এমনকি পরিচিত ঘটকেরাও বিল্লু ভাইয়ের জন্য পাত্রীর খোঁজ নিয়ে আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। সবাই একটাই কথা বলছে, বিল্লু ভাইয়ের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে এই জীবনে আর বিয়ে করতে পারবে না। এতেও বিল্লু ভাইয়ের কোনো বিকার নেই। তিনি সেই একই অবস্থানে অনড়। নিজের পছন্দমতো মেয়ে না পেলে কখনো বিয়ে করবেন না। করিম চাচাও নাছোড়বান্দা, যেভাবেই হোক এ বছরের মধ্যেই ঘরে নতুন বউ তুলবেন। তিনি রীতিমতো একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েই বিল্লু ভাইয়ের ‘বিবাহ অভিযানে’ নামেন।
করিম চাচা তাঁর পুরোনো কলিগ ও দূরের বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়ে বেশ কিছু পাত্রীর সন্ধান পান। সবার ছবি সংগ্রহ করে বিল্লু ভাইকে দেখানো হয়। অধিকাংশ মেয়ে বিল্লু ভাইয়ের পছন্দ হয়নি। যে কয়েকজন পছন্দ হয়েছে, তাদের সঙ্গে দেখা করে ভালো লাগেনি। এতে করে করিম চাচা বিল্লু ভাইয়ের ওপর ভীষণ ক্ষেপে যান। তিনি বিভিন্ন রকম আলটিমেটাম দিলেন। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হয়নি। করিম চাচা বিল্লু ভাইয়ের আচরণে খুব কষ্ট পান। মৃত স্ত্রীর কথা স্মরণ করে চোখের পানি ফেলেন। তিনি আজ বেঁচে থাকলে হয়তো বিল্লু ভাই এমন করত না।
চাকরি থেকে অবসরে নিয়ে করিম চাচার সময় কাটে না। শরীর-স্বাস্থ্যও সব সময় ভালো থাকে না। এসব বোঝার মানসিকতা বিল্লু ভাইয়ের নেই। তার মা বেঁচে থাকলে এসব কথা বুঝিয়ে বলতে পারতেন। করিম চাচা নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ অনুভব করছেন। তাঁর মনের কষ্ট বোঝার মতো এই পৃথিবীতে কেউ নেই। অভিমানে বিল্লু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। তবে মোটেও দমে যাননি। এখনো তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে ছেলের বিয়ের জন্য পাত্রীর সন্ধান করে যাচ্ছেন। ঘটনাক্রমে এক পাত্রী দেখতে গিয়ে করিম চাচার সঙ্গে দেখা হয় তাঁর এক ছাত্রীর। সেই ছাত্রী ছিল ওই পাত্রীর মা।
এই ভদ্রমহিলার নাম রাহেলা খাতুন। তিনিও করিম চাচার মতোই একা; মানে বিধবা। সাত বছর হলো স্বামী মারা গেছে। তাঁর দু মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে নীলার বিয়ে হয়ে গেছে, শ্বশুরবাড়িতে থাকে। ছোট মেয়ে লিজাকে নিয়ে তাঁর সংসার। সেই মেয়েকে বিল্লু ভাইয়ের জন্য দেখতে গিয়েছিলেন করিম চাচা। রাহেলা আন্টির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কথায় কথায় দুজন দুজনকে চিনতে পারেন। কোনো এক সময় দুজনের মধ্যে ছিল প্রেমের সম্পর্ক। সবকিছুই মুহূর্তের মধ্যে দুজনের স্মৃতির আঙিনায় ভেসে ওঠে।
তখন করিম চাচা লেখাপড়া শেষ করে চাকরির চেষ্টার পাশাপাশি টিউশনি করতেন। রাহেলা আন্টি তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী ছিলেন। করিম চাচা তাঁদের বাসায় গিয়ে আন্টিকে অঙ্ক ও ইংরেজি পড়াতেন। অঙ্ক ও ইংরেজির মতো দুটি কঠিন সাবজেক্ট পড়াতে পড়াতে একসময় তাদের দুটি মন কখন যে এক হয়ে যায়, কেউ টের পাননি। যখন টের পেয়েছিলেন, তখন রাহেলা আন্টির বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তখনো করিম চাচার চাকরি হয়নি, পুরোদস্তুর বেকার। তাই দুজনের চোখের পানি ফেলা ছাড়া তখন আর কিছুই করার ছিল না। ক্লাস টেনে পড়া অবস্থায় রাহেলা আন্টির বিয়ে হয়ে গেল। তার ঠিক ছয় মাস পরই করিম চাচাও একটা ভালো চাকরি পেয়ে যান। তিনি খুব আফসোস করেছিলেন—যদি ছয় মাস আগে এই চাকরিটা পেতেন, তাহলে রাহেলাকে বিয়ে করতে পারতেন।
করিম চাচা আন্টিকে বিয়ে করতে না পারলেও আন্টির মেয়েকে ছেলের বউ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। তাই তিনি রাহেলা আন্টির কাছে বিল্লু ভাইয়ের জন্য তাঁর ছোট মেয়েকে চাইলেন। আন্টিও তখন দ্বিমত করলেন না। দুজনের মধ্যে একটা পাকা কথা হয়ে গেল। এখন বিয়ের পাত্র-পাত্রী দুজন দুজনকে পছন্দ করলেই বিয়ের দিন-তারিখ ধার্য করে নেবেন। করিম চাচা মনের আনন্দে বাসায় ফিরে বিল্লু ভাইকে বিস্তারিত খুলে বলেন। বিল্লু ভাইয়ের সেই এক কথা, মেয়ে পছন্দ না হলে সে বিয়ে করবে না। তখন করিম চাচা জানালেন, এবারের মেয়েটি তার পছন্দ হবেই হবে।
যা হোক, একদিন এক রেস্টুরেন্টে বিল্লু ভাইকে নিয়ে করিম চাচা যান। ওদিকে রাহেলা আন্টি আসেন তাঁর ছোট মেয়ে লিজাকে নিয়ে। বিল্লু ভাই ও লিজা এক টেবিলে বসে, আর করিম চাচা ও রাহেলা আন্টি একটু দূরে অন্য একটি টেবিলে বসে গল্প করছেন। করিম চাচা রাহেলা আন্টিকে বলেন, আমাদের চার হাত এক করতে না পারলেও আমাদের সন্তানদের চার হাত এক করতে পারলে মরেও শান্তি পাব। তখন রাহেলা আন্টিও মুচকি হেসে নিজের সম্মতি প্রকাশ করেন। বিধি বাম থাকলে যা হওয়ার, তাই হয়ে গেল। হঠাৎ করেই বিল্লু ভাই ও লিজার মধ্যে কথা-কাটাকাটি শুরু হয়। তখন লিজা টেবিল থেকে উঠে রাহেলা আন্টির হাত ধরে প্রায় জোর করে টেনে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যায়।
বিল্লু ভাই ও লিজা—দুজনই জানিয়ে দেয়, ‘এই বিয়ে সম্ভব নয়’। অনেক চেষ্টা করেও কাউকে রাজি করানো যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে করিম চাচা ও রাহেলা আন্টি আশাহত হয়ে বেশ কষ্ট পেলেন। তবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়নি। মোবাইল ফোনে দুজনের মধ্যে প্রায় সময় বিভিন্ন বিষয়ে টুকটাক কথাবার্তা চলতে থাকে। একে অন্যের কষ্টগুলো শেয়ার করতে থাকে। দুজনেই দুজনের নিঃসঙ্গ জীবনে একে অন্যের আপনজন হয়ে ওঠে। একসময় পুরোনো প্রেম আবার নতুন করে উঁকি দেয়। তবে সেদিকে প্রশ্রয় না দিয়ে আরেক দফা চেষ্টা করে বিল্লু ভাই ও লিজার মধ্যে একটা সমঝোতা করতে। এবারেও কোনো লাভ হয়নি। শেষমেশ নিরাশ হয়ে ওদের মধ্যে বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে দেন। তবে তাঁদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কের ছেদ ঘটেনি। বরং দিনে দিনে সেটা আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে এবং একসময় তা চূড়ান্ত প্রেমের রূপ নেয়। একে অন্যের সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারেন না। এমনকি মাঝেমধ্যে লুকিয়ে দেখাও করছেন। এই অবস্থায় করিম চাচা একদিন রাহেলা আন্টিকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। যদিও আন্টি বিয়ের প্রস্তাবে প্রথমে রাজি হননি। তবে তাঁর বড় মেয়ে নীলা তাঁকে আগে থেকেই দ্বিতীয় বিয়ে করার পরামর্শ দিয়ে আসছে। যেহেতু লিজার বিয়ে হয়ে গেলে আন্টি একদম একা হয়ে যাবেন। তবুও সমাজের মানুষ ও লিজার কথা ভেবে আন্টি দ্বিতীয় বিয়ে করতে রাজি নন।
এদিকে করিম চাচা নাছোড়বান্দা, তিনি আন্টির প্রেমে মজনু হয়ে গেছেন। তাই আন্টিকে বিয়ে করে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চান। আন্টিও মনে মনে তাই চাইছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বিল্লু ভাইয়ের সঙ্গে লিজার বিয়ের আলাপ হয়েছিল। এখন যদি তাঁরা বিয়ে করেন, তাহলে পরিবার থেকেই বিষয়টি কেউ মেনে নেবে না। তাই তিনি সাহস করে করিম চাচার কথায় সম্মতি দিতে পারছেন না।
এদিকে আন্টির জন্য করিম চাচার বেহাল দশা। আন্টিও শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলেন, মনের ভয়, লজ্জা ভুলে নিজেদের পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করবেন। যেই ভাবনা, সেই কাজ। করিম চাচা বিল্লু ভাইয়ের সঙ্গে এবং রাহেলা আন্টি লিজার সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তাঁরা যা ভেবেছিলেন, ঠিক তা-ই হলো। বিল্লু ভাই ও লিজা কোনোভাবেই বিষয়টি মেনে নিল না।
করিম চাচা ও রাহেলা আন্টি মনের কষ্টে নীরবে নিভৃতে চোখের পানি ফেলতে থাকেন। কয়েক দিন কেউ কারও সঙ্গে কথাও বলেননি। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত করতে পারছেন না। যেন দুজনেই দুজনের বিরহে কাতর হয়ে গেছেন। তবে তাঁদের জন্য যে বিশাল এক সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে, সেটা তাঁরা কেউ জানতেন না। সপ্তাহখানেক পর বিল্লু ভাই এসে করিম চাচাকে জানায় রাহেলা আন্টিকে মা হিসেবে গ্রহণ করতে তার কোনো আপত্তি নেই। ওদিকে লিজাও রাহেলা আন্টিকে একই কথা জানায়। হঠাৎ করে তাদের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন দেখে করিম চাচা ও রাহেলা আন্টি বিস্মিত হয়ে যান। এদিকে রাহেলা আন্টির বড় মেয়ে নীলা ও তার স্বামী এসে দুই পরিবারের সবাইকে এক করে বিস্তারিত সবকিছুই খুলে বলেন। রাহেলা আন্টি নিজের প্রথম প্রেমের গল্পটা নীলাকে একবার বলেছিলেন। যখন করিম চাচা বিল্লু ভাইয়ের বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে আসেন, তখন রাহেলা আন্টি নীলার সঙ্গে আলোচনা করে। ওই সময়ে আন্টির কিছু কথা থেকে নীলার মনে সন্দেহ জাগে, এই করিম চাচাই তার মায়ের প্রথম প্রেমিক। পরে সে খোঁজ খবর নিয়ে নিশ্চিত হয়ে যায়। তাই সে পরিকল্পনা করে লিজাকে সবকিছু বুঝিয়ে রাজি করায়। লিজাও রাজি হয়ে যায় এবং প্ল্যান মোতাবেক বিল্লু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার সময় করিম চাচা ও রাহেলা আন্টির সম্পর্কের বিষয়টি অবহিত করে। তখন বিল্লু ভাই কিছুটা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। কিন্তু লিজা প্রথমেই শর্ত দিয়েছিল, এসব কথা ভুলেও কাউকে বলা যাবে না।
পরে নীলা ও লিজা বিল্লু ভাইকে মোবাইলে কথা বলে এবং সরাসরি দেখা করে সবকিছু বুঝিয়ে বলে। তখন বিল্লু ভাই বুঝতে পারে এবং কোনো আপত্তি রাখেনি। তবে যখন নিজে থেকে করিম চাচা ও রাহেলা আন্টি বিল্লু ভাই ও লিজার সঙ্গে তাঁদের দুজনের বিয়ের বিষয়ে আলোচনা করতে আসেন, তখন তারা প্ল্যান মোতাবেক অসম্মতি প্রকাশ করে। ওরাও দেখতে চেয়েছিল, তাদের বাবা ও মায়ের মধ্যে ভালোবাসার গভীরতা কতটুকু। যা হোক, শেষ পর্যন্ত জীবনের শেষ প্রান্তে এসে করিম চাচা ও রাহেলা আন্টির ভালোবাসার জয় হয়। ভাগ্য তাদের আবার মিল করে দেয়। মোটামুটি ধুমধাম করেই তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সেকেন্ড ইনিংসের সূচনা করেন।
করিম চাচার এক এবং রাহেলা আন্টির দুই সন্তান মিলে এখন তাঁদের তিনটি প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান। যেহেতু নীলার কারণেই দুই পরিবার এক পরিবারের পরিণত হয়, তাই এই নতুন পরিবারের অভিভাবক হয়ে ওঠে নীলা। করিম চাচা ও রাহেলা আন্টির মধ্যে বিয়ে করিয়েই নীলা থেমে থাকেনি। তাঁদের বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সংসারে এল আরেকটি নতুন বউ। পাত্রী দেখা নিয়ে বিল্লু ভাইয়ের ধানাইপানাই করার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে গিয়ে নীলা জানতে পারে বিল্লু ভাই একটি মেয়েকে ভালোবাসে। কিন্তু সেটা মুখ খুলে বলতে পারছে না। তাই ওই মেয়ের সঙ্গে বিল্লু ভাইকে বিয়ে করিয়ে ঘরে তুলে নিয়ে আসে। লিজাও ফেসবুকে প্রেম করত এক আমেরিকাপ্রবাসী ছেলের সঙ্গে। নীলা এই অনলাইন প্রেমের গল্পটা অনলাইনে থাকতে দেয়নি, বাস্তবে নিয়ে আসে। ওই প্রবাসী ছেলেকে বিয়ে করে লিজা এখন ক্যালিফোর্নিয়াতে থাকে। যার যার পরিবার নিয়ে সবাই বেশ ভালো আছে, সুখে-শান্তিতে আছে। শুধু বেঁচে নেই সবার ভালোবাসার গল্পের হ্যাপি এন্ডিংয়ের রূপকার নীলা। সবার জীবনে বসন্তের আবির রাঙিয়ে একদিন এক সড়ক দুর্ঘটনায় সে অকালে হারিয়ে যায়। এ যেন বসন্তের আবিরে বিষাদের ছোপ।