কী জবাব দেবেন এসব অন্যায়ের?

আইন মানার অনুরোধ করে পুলিশ চড় খেল সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরের। ঘটনাস্থল গাজিপুরের বাসন থানা এলাকা। খবরটি শুনে সারা দিন নানা ভাবনায় মন আচ্ছন্ন। কারণ বিবিধ।
আমি নিজে একজন পুলিশ কর্মকর্তার সন্তান, যিনি প্রায় অর্ধশত বছর আগে ব্যক্তিগত কারণে পুলিশ বাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। পরে নিজেকে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করেন। পঞ্চাশ দশকের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি, তথা বঙ্গবন্ধুকে একক নেতা মেনে ৮৮ বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজ বিশ্বাসে বলীয়ান ছিলেন এবং শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে দলের সঙ্গে শতভাগ সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ বাহিনীর প্রতি আমার আলাদা একটি দুর্বলতা থাকবে। বাহিনীর সুনামে যেমন খুশি হই, তেমনি খারাপ খবরে মন ভারী হয়।
ইদানীং চেনাজানা এক জেলার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হলে বুঝলাম তিনি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল, জনবান্ধব ও সংস্কৃতিমান ব্যক্তিত্ব। পরিচিত হতে গিয়ে আরও জানলাম তিনি একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। শুধু কি উল্লেখিত সরকারি কর্মকর্তা বা আমি নিজে? সারা দেশের নানা বাহিনী ও অধিদপ্তর এবং শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নানা স্তরে ভালো-মন্দ মিলিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন সাবেক-বর্তমান পুলিশ সদস্যদের হাজারো সন্তান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পুলিশ বাহিনী ও বর্তমানে দেশের এলিট ফোর্স বলে পরিচিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্মকর্তা দুজনই যৌথভাবে বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের সম্মান রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। বাহিনীর প্রতিটি সদস্য যেমন নিজেদের শতভাগ কর্মদক্ষ ও সৎ রাখতে শপথ করে এসেছেন, তেমনি আমাদের জনগণেরও কিছুটা হলেও দায়িত্ব বর্তায় দেশের সব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা। তবে যারা নিজেদের করা শপথ লঙ্ঘন করবেন, তাঁদের কথা আলাদা। সেই সব অসৎ সদস্য আমার আলোচনার বাইরে।
প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশের দুটো উদাহরণ সংক্ষেপে আনতে চাই। উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের সঞ্চালক কপিল শর্মা বোম্বের সাবেক এক পুলিশ সদস্যের সন্তান। কয়েক বছর ধরে কপিল শর্মা ভারত বা বিশ্বের যেকোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিলে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক নেন তিনি। একমাত্র ব্যতিক্রম পুলিশ বাহিনীর অনুষ্ঠান। ভারতের যেকোনো স্থানে পুলিশ বাহিনী আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানের জন্য তিনি কোনো পারিশ্রমিক নেন না। এমনকি ফিরিয়ে দেন যাতায়াত খরচও। কপিল শর্মা বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকদের সামনে গর্ব করে বলেন, ‘আমি বোম্বে পুলিশ বাহিনীর একজন প্রাক্তন সদস্যের সন্তান, যিনি কোনো দিন কোনো উৎসবে ছুটি পাননি। তিনি ঝড়, বৃষ্টি, প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে বোম্বের রাস্তায় ডিউটি করেছেন।’
প্রতিটি অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলেই কপিল শর্মা তাঁর বাবাসহ সব সৎ ও কর্মনিষ্ঠ পুলিশের প্রতি অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। বর্তমান পুলিশ বাহিনীর প্রধান একজন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এবং ব্যক্তিত্ববান বটে। পাশাপাশি অন্য আরেকটি এলিট বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা শুনেছি অনেক চৌকস ও বাহিনীর শতভাগ সফলতা আদায়ে আপসহীন।
এই সুযোগে একটু পেছন ফিরে যেতে চাই। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি সুনামগঞ্জ থাকাকালে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। জেলা ক্রীড়া সংস্থার কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শহরের একমাত্র লন টেনিস ক্লাবের দায়িত্বে ছিলাম। শহরের পুরোনো ডাকবাংলোর সামনে জেলা প্রশাসন ও শহরের কয়েকজন লন টেনিসপ্রেমীদের যৌথ উদ্যোগ ও আগ্রহে ফ্লাড লাইটের আলোয় টেনিস খেলা চলত। লন টেনিস একটি ব্যয়সাপেক্ষ খেলা হওয়ায় মফস্বল শহরে তা চালিয়ে যাওয়ার প্রথম শর্ত ছিল প্রশাসনের নেকনজর ও সহযোগিতা। একসময় কিন্তু প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের লন টেনিস খেলা জানাটাও ছিল চৌকস ব্যক্তিত্বের অন্যতম মাপকাঠি। সে যা-ই হোক, সে সময় এলিট বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তার প্রথম পোস্টিং শহর সুনামগঞ্জ এসে আমাকে ক্রীড়াঙ্গনসহ নানা সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত দেখে জানতে চেয়েছিলেন, আমি কোন বিভাগে কর্মরত। পরে শুনেছি সে প্রশ্নের উত্তর জেলার সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তা দিয়েছিলেন। যা নাকি আজও তিনি মনে রেখেছেন।
এবার বর্তমানে আসি। একজন নিরীহ ট্রাফিক পুলিশ ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তীব্র গরমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডিউটি করেন। যারা কখনো চিকনগুনিয়া বা করোনাভাইরাসের দোহাই দিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারেন না। বেশির ভাগ সদস্য থাকেন পরিবারবিহীন। অথচ তাদের ওপর কেন সবার এ ধরনের অমানবিক আচরণ। নেতা, পাতি নেতা, হাফ নেতা থেকে শুরু করে সবার প্রথম চোখ রাঙানিসহ শারীরিক অত্যাচারও সইতে হয় নিরীহ ও সৎ (অনেক ক্ষেত্রে) ট্রাফিক পুলিশদের। আমি অবশ্য সব পুলিশ সদস্যকে এক কাতারে আনতে পারছি না বলে দুঃখিত। তবে কোনো ব্যক্তি শতভাগ পচে গেছেন বলেও আমি বিশ্বাস করি না।
যা হোক শুরুতে উল্লেখিত পুলিশ সদস্য তো কোনো অন্যায় করেননি। তিনি বরং নারী কাউন্সিলরকে আইন মোতাবেক আটকে ছিলেন। কিন্তু ওই কাউন্সিলর পুলিশের ওপর হাত তুলেছেন? এমনটি কেন হবে? কোন শক্তিবলে এসব হচ্ছে? তুচ্ছ বিষয় নিয়ে যেভাবে যে কেউ পুলিশ তথা আইনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, শারীরিক ভাষায় কথা বলে, সেখানে এত কোটি কোটি টাকা খরচ করে নানা বাহিনীসহ এলিট বাহিনী রাখার প্রয়োজন কী? এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকে হয়তো বলবেন, ‘ভাই বিদেশে থাকেন তো। তাই এসব লিখছেন।’ প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কি কোনো অন্যায় প্রশ্ন তুললাম?
শেষ কথাটি বলে যাই। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু সুনামগঞ্জ সফরকালে খুঁজে বের করেছিলেন তাঁর প্রিয় এক বোন-জামাইকে, যিনি সে সময় সুনামগঞ্জ সদর থানার ওসি ছিলেন। তাঁদের দু সন্তান বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করছেন, আর এক মেয়ে থাকেন ঢাকায়। সেই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী ছিলেন আত্মীয় সূত্রে প্রয়াত যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণির আম্মার বান্ধবী। আমার পুলিশ বাবার মাধ্যমে যখন শুনলেন তাঁর প্রিয় বুজি সুনামগঞ্জে আছেন, তখন শত ব্যস্ততার মধ্যেও সদর থানার পেছনে কাঠের পাটাতনের তিন রুমের বাড়িতে ঝটিকা সফরে ঢুকে বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রিয় বোনের (শেখ মণির আম্মা) প্রিয় বান্ধবীর গলা জড়িয়ে ধরে অশ্রুসজল চোখে, কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বুজি তুমি এখানে আছ, আমি জানতাম না। আজ জেনেই তোমারে দেখতে ছুটে এসেছি।’ প্রিয় বুজি বঙ্গবন্ধুর সামনে তুলে ধরেছিলেন নেতার প্রিয় নিজ হাতে তৈরি নানা জাতের মোয়া ও পিঠা। ১৯৭১ সালের সুনামগঞ্জের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে বিরাট ভূমিকা রাখা সেই পুলিশ সদস্যের নাম মোখলেসুর রহমান। এসব অন্যায়ের বিয়ে প্রশ্ন তুললে এমন অকুতোভয় সাহসী সন্তানদের আপনারা কী জবাব দেবেন?