নিউইয়র্কে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে, ২ ট্রিলিয়ন ডলারের নাগরিক সহযোগিতায় সমঝোতা সই

নিউইয়র্কে মানুষের বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ছবি: ভায়লা সালিনা
নিউইয়র্কে মানুষের বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ছবি: ভায়লা সালিনা

কোনো নগরীতে এক দিনে ৬১ জনের মৃত্যু, নিজের কমিউনিটির চারজনের মৃত্যু, বহুজনের মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে বিলাপ করা যায়। সংবাদ লেখা যায় কি না, জানি না। যুদ্ধের মাঠে সাংবাদিকতা করিনি। খরা–মহামারি আর দুর্ভিক্ষের সংবাদ করেছি। এবারে এক ভিন্ন নাজুকতা।

মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) এক দিনে নিউইয়র্ক নগরীতে ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নগরীতে করোনাভাইরাসে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছুঁতে পারে এ রিপোর্ট ছাপা হতে হতে। সন্ধ্যায় জানানো হয়েছে সংখ্যাটি ১৯২। মঙ্গলবার চারজন বাংলাদেশি মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন নারী ও দুজন পুরুষ। এ নিয়ে নিউইয়র্কে করোনাভাইরাসে মোট আটজন বাংলাদেশি মারা গেলেন। আরও অন্তত ২০ জন চেনা স্বদেশির এ মহামারি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার নিশ্চিত তথ্য আছে আমাদের হাতে। নিউইয়র্ক বাংলা সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন এমন অন্তত চারজনের শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। নিউইয়র্ক পুলিশ ও ট্রাফিকে কর্মরত অন্তত চারজন স্বদেশির আক্রান্ত হওয়ার খবর আমরা জানি। নিউইয়র্ক নগরীর দুর্যোগ তথ্যকেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে নগরীর হাসপাতালগুলোতে ৭০০ জনের বেশি আক্রান্তের অবস্থা সংকটাপন্ন।

নিউইয়র্কের নিরুপায় লোকজন কেউ প্রার্থনা করছেন। কেউ প্রকৃতি কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তা দেখার বিষণ্ণ অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। মঙ্গলবার দুপুরে বেশ লোকজনকে নিউইয়র্কের ব্রংকস এলাকার স্টার্লিং অ্যাভিনউয়ের সড়কপথে ‘আজান’ দিতে ও দোয়া করতে দেখা গেছে।

প্রাপ্ত তথ্যে কুইন্সে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৬৭ জন। ম্যানহাটনে ৩ হাজার ১৩, ব্রংকসে ২ হাজার ৫০৫ জন, ব্রুকলিনে ৪ হাজার ৪০৭ এবং স্টেটেন আইল্যান্ডে ৯৯৯ জন। এসব সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। আক্রান্ত লোকজনের জন্য এখনো পর্যাপ্ত পরীক্ষা কেন্দ্র নেই। কেবল লক্ষণ নাজুক হলেই পরীক্ষা করানোর সুযোগ পাচ্ছেন লোকজন।

নগরীর মেয়র বিল ডি ব্লাজিও বলেছেন, আমরা সংকটের অতল গহ্বরে। কেউ এমন চায় না, কিন্তু এটাই বাস্তব। নিউইয়র্কের রাজ্য গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমো মঙ্গলবার ক্ষোভ আর হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, নিউইয়র্কে বুলেট ট্রেনের মতো করোনা ছাড়াচ্ছে। ভাইরাসটি ঠেকানো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এটি তার নিজস্ব গতিতে মানুষকে সংক্রমণ করছে। রাজ্য গভর্নর আগে বলেছিলেন, তাঁর ১ লাখ ১০ হাজার হাসপাতাল বেডের প্রয়োজন হবে। নাজুক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মঙ্গলবার বলেছেন, হাসপাতালে বেডের সংখ্যা এখন লাগবে ১ লাখ ৪০ হাজার। তিনি আশঙ্কা করছেন, দ্রুতই নিউইয়র্কের অন্তত ৪০ হাজার ভাইরাস–আক্রান্ত সংকটজনক লোকের জন্য হাসপাতাল বেড প্রস্তুত রাখতে হবে।

এসব পণ্য কিনছেন মানুষ। ছবি: ভায়লা সালিনা
এসব পণ্য কিনছেন মানুষ। ছবি: ভায়লা সালিনা

একের পর এক মারা যাচ্ছে মানুষ। বয়স্কজন নয়। মারা যাচ্ছে সর্ববয়সের মানুষ। নিউইয়র্ক, নিউ জার্সিসহ আশপাশের রাজ্যে চলছে লকডাউন। ঘরে আটকা পড়া মানুষ প্রয়োজন ছাড়া বেরোচ্ছেন না। নগর, রাজপথ, জনপদে খাঁ খাঁ শূন্যতা। ঘরে ঘরে ফোন বেজে উঠলেই নতুন কোনো মৃত্যু সংবাদের অপেক্ষায় যেন নগরীর লোকজন।

কাজকর্মহীন মানুষ তাকিয়ে আছেন সরকারি সাহায্যের আশায়। ‘লকডাউন’ ঘোষণার পর অনেকেই চাকরি হারিয়ে ঘরে গৃহবন্দীর মতো জীবন কাটাচ্ছেন। চাকরি হারানো বেশির ভাগ এবং ছোট ব্যবসায়ীরা যাঁরা বাসা ভাড়ায় থাকেন, তাঁদের মধ্যে প্রচণ্ড আর্থিক চাপ অনুভব হচ্ছে। অনেকের বাড়িতেই এর মধ্যে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে পাশে রেখে নিউইয়র্কের কিছু মানুষ বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। গ্রোসারি পৌঁছে দিচ্ছেন। অনেকই সরকারি সাহায্যের বাইরে আছেন। যাঁদের অভিবাসনের কাগজপত্র নেই, তাঁদের সংকট আরও বেশি। তাঁদের কোনো সরকারি সাহায্যের আশাও নেই। এর মধ্যে ভাইরাস–আতঙ্কে কাটছে প্রতিটি প্রহর।

নিউইয়র্কের রাজ্য সিনেটর মাইকেল গিয়ানারিস করানোর কারণে যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন, সেই সব ভাড়াটেদের অস্থায়ীভাবে বাসা ভাড়া স্থগিত করার জন্য রাজ্য গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমোর প্রতি আহ্বান জানান। সিনেটর মাইকেল বলেন, ‘এই মুহূর্তে ব্যবস্থা না নিলে আপনি এর পেছনে একটি বিশাল আবাসন সংহট তৈরি করতে যাচ্ছেন।’ সিনেটর মাইকেল বলেছেন, রাজ্য গভর্নর ক্যুমো নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে এটি জারি করতে পারেন। আর ক্যুমো যদি না করেন সে ক্ষেত্রে আমি নিজে আইনি প্রক্রিয়ায় ভাড়াটেদের পক্ষে কাজ শুরু করব।

মঙ্গলবার নিউইয়র্কের ব্রংকস এলাকার স্টার্লিং অ্যাভিনিউয়ের সড়কপথে ‘আজান’ দিতে ও দোয়া করতে দেখা গেছে। ছবি: এম বি তুষার
মঙ্গলবার নিউইয়র্কের ব্রংকস এলাকার স্টার্লিং অ্যাভিনিউয়ের সড়কপথে ‘আজান’ দিতে ও দোয়া করতে দেখা গেছে। ছবি: এম বি তুষার

ফেডারেল সরকার ত্বরিত গতিতে পর্যাপ্ত সাহায্য করছে না বলে অভিযোগ করে গভর্নর এন্ড্রু ক্যুমো বলেন, আমরা বলছি না, একটি জীবনের মূল্য কত। গভর্নর বলেন, আমাদের জন্য নয়। আপনাদের জন্যই আমাদের বাঁচিয়ে রাখুন!

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল মঙ্গলবার বলেছেন, তিনি শিগগিরই আমেরিকার সবকিছু আবার সচল করতে চান। প্রেসিডেন্ট জানেন, মৃতের সংখ্যা বাড়বে। অর্থনৈতিক চাঞ্চল্যের জন্য মধ্য এপ্রিলের মধ্যেই সবকিছু আবার সচল করার কথা বলছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যদিও পরিস্থিতি মোটেই তেমন মনে হচ্ছে না। গভর্নর ক্যুমো বলেছেন, কোনো আমেরিকানই একটি জীবনের মূল্য কত—তার হিসাব করছেন না।

হোয়াইট হাউস এবং সিনেট মিলে মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নাগরিক সহযোগিতার সমঝোতা হয়েছে। ২ ট্রিলিয়ন ডলারের এ নাগরিক সহযোগিতায় ৭৫ হাজার ডলারের নিচে বার্ষিক আয়ের লোকজনকে ১ হাজার ২০০ ডলারের এককালীন চেক দেওয়া হবে। চার মাসের জন্য বেকার ভাতা দেওয়া হবে সব কর্মহীনদের জন্য, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সাহায্য করা হবে। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানেও অর্থ সাহায্য যাবে। এ অর্থের নানামুখী প্রবাহ নিয়ে আমেরিকার অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে—এমন প্রত্যাশা করছেন আইনপ্রণেতারা।