করোনাভাইরাস পরবর্তী বিশ্ব ও বর্ডারলেস সমাধান

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের কুৎসিত রাক্ষসটি বোতলবন্দী না হলে একসময় আফ্রিকার দশাও হতো আমেরিকারই মতো। সেখানে স্থানীয়দের পরিকল্পিতভাবে মেরে মেরে নিশ্চিহ্ন করে ইউরোপীয়রা হয়তো একসময় আমেরিকা-২ নামের আরেকটি দেশ সৃষ্টি করত। তা হয়নি। আমাদের সবার মাতৃভূমি আফ্রিকা মহাদেশ বেঁচে গেছে। যদিও মাঝখানে দাসপ্রথা ও নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল সেখানকার কোটি কোটি মানুষ। ইতিহাসের সেই পটপরিবর্তনের জন্য রক্তাক্ত যে পথ আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছিল, তার নাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পরিহাসের মতো শোনালেও সমকালীন বিশ্বের ইতিহাস তাই এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছে ঋণী।

ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের পাল্টাপাল্টি লোভ, দম্ভ ও চাপা উত্তেজনা থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধে। অথচ বিশ্ব তখনো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও স্প্যানিশ ফ্লুয়ের ক্লান্তি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠেনি। আমেরিকায়ও চলছে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মহামন্দা। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ কি আর তাতে থেমে থাকে?

সেই অপ্রস্তুত যুদ্ধের মূল্যেই সমকালীন বিশ্বের ইতিহাস অর্জিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ বিলুপ্ত হয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছে। পাশাপাশি উত্থান হয়েছে পুঁজিবাদেরও। আমেরিকা নামের একদা অলস, উদ্দেশ্যহীন, ব্যাকবেঞ্চার, বোকাসোকা দেশটি রাতারাতি এক মহাশক্তিধর দেশ হিসেবে আবির্ভূত হলো। এই বিশ্বযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় স্তালিনের হাত ধরে পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নেরও উদ্ভব হয়েছিল। যদিও ভারতবর্ষের অনেক রোমান্টিক বামপন্থী এই ‘স্তালিনিজমকেই’ ‘সোশ্যালিজম’ ভেবে বহুদিন ধারাবাহিক ঘোল খেয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয় আমেরিকা বনাম সোভিয়েত ইউনিয়ন দীর্ঘ কয়েক দশকের স্নায়ুযুদ্ধ। সোভিয়েত ইউনিয়নের বৈশ্বিক প্রভাব ও কর্তৃত্ব ঠেকাতে আমেরিকা খেলে এক দ্বিমুখী খেলা। একদিকে ক্ষমতার আজ্ঞাবহ পুতুল শাসক বসিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও শাহের ইরানকে নিজের পাশে রাখে। তাতে তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকে। এভাবে তেল-গ্যাসের দাম কম রেখে সে পরোক্ষভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে উপর্যুপরি পর্যুদস্ত ও দুর্বল করতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে পৃথিবীর নানা সীমান্তে চালিয়ে যায় ছদ্ম যুদ্ধ বাধানোর এক ভ্রাতৃঘাতী খেলা।

৯০ দশকের শেষে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলো। তারপর নতুন সহস্রাব্দ দেখল বিশ্বের নব্য পরশক্তি চীনের উত্থান, যে এসে খেলার নিয়মই পাল্টে দিল। কিন্তু এখন ২০২০ সাল দেখছে করোনাভাইরাস নামে এক নতুন বৈশ্বিক ঘটনা! হয়তো নভেল করোনাভাইরাসই সেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাম, যার আশঙ্কা আমরা করছিলাম। পুরো বিশ্ব প্রথমবারের মতো এক সঙ্গে থমকে গেছে। পাল্টে যাচ্ছে জীবনধারা। পাল্টে যাচ্ছে চিন্তাভাবনার ধারা এবং ভবিষ্যতের গতিপ্রকৃতি।

মানবজাতি সম্ভবত এক নতুন ইতিহাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, যে নতুন পৃথিবী নিয়ে আসবে নতুন আশা ও সম্ভাবনা। সেখানে প্রথমত, অস্ত্র, যুদ্ধ ও জুয়ার বোর্ডের চেয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় বিশেষ করে চিকিৎস্যবিজ্ঞানে অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ হবে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশের সুরক্ষা প্রধান বিবেচ্য হবে। তৃতীয়ত, উগ্র জাতীয়তাবাদ বিলুপ্ত হয়ে সত্যিকারের উন্মুক্ত ও সমতাভিত্তিক নতুন এক পৃথিবী সৃষ্টি হবে।

করোনাভাইরাসের মুখোশে এই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেহেতু বর্ডারলেস, এর সমাধানও নিশ্চয়ই এক বর্ডারলেস বিশ্বের ভেতর নিহিত আছে। আমাদের ক্রমশ সে অবধারিত সত্যের দিকেই ধাবিত হতে হবে।