নিউইয়র্কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না

কে বলবে এটিই পর্যটকদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় ব্রুকলিন ব্রিজ। ছবি: রয়টার্স
কে বলবে এটিই পর্যটকদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় ব্রুকলিন ব্রিজ। ছবি: রয়টার্স

বেরসিক করোনাভাইরাস বিষাদময় করে তুলেছে নিউইয়র্কের জনজীবন। গোটা নিউইয়র্ক যেন এখন মৃত্যু উপত্যকা। মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে এখানে। প্রতি এক মিনিটে তিনজন মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। মৃত্যুহার যেভাবে বাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে আমেরিকা ইতালিকে অতিক্রম করতে আর বেশি দেরি নেই।

চারদিকে সুনসান নীরবতা। ব্রঙ্কসের যে স্টার্লিং অ্যাভিনিউ দিয়ে একসময় হাজারো মানুষের ভিড়ের কারণে গাড়ি চালিয়ে যাওয়া যেত না, এখন তা জনমানবশূন্য। ম্যানহাটনের যে টাইমস স্কয়ার মানুষের কোলাহলে সারা রাত জেগে থাকত, এখন তা খাঁ খাঁ বিরানভূমি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আদেশে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দীত্ব বরণ করতে হয়েছে আমাকে। প্রতিদিন একের পর এক খারাপ খবরের সঙ্গে রয়েছে বউ-বাচ্চার নজরদারি। ঘরে ঘরে মানুষের বোবা কান্না বুঝিয়ে দিচ্ছে মানুষ হিসেবে আমরা এখন কতটা অসহায়।

গত কয়েক দিনে বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন এই ব্যাধিতে। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে (এনওয়াইপিডি) কর্মরত থাকা অবস্থায় এক বাংলাদেশি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হওয়ায় খবর পাওয়া গেছে। আবার একজন লিমোজিন ট্যাক্সি ড্রাইভারের খোঁজ পাওয়া গেছে, যিনি যাত্রী নামাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন এই ভাইরাসে। একইভাবে আক্রান্ত হয়েছেন চেনা জানা বেশ কয়েকজন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কিছু কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্টও। সমাজ ও দেশের জন্য যারা কাজ করতেন, এখন তারা নিজেরাই আক্রান্ত ও শয্যাশায়ী। আক্রান্ত হয়েছেন পরিচিত এক চিকিৎসকও। অসুস্থ মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, এই রোগে আক্রান্ত হলে কেউ যে সুস্থ হবেন না, এমনটি নয়। কেবলমাত্র বিভিন্ন জটিল রোগে যারা অসুস্থ, তাদের ক্ষেত্রে এই রোগ মৃত্যুঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তাই এই মুহূর্তে আমাদের কাজ হচ্ছে ব্যাধিটির ব্যাপক সংক্রমণ রোধের লক্ষ্যে সেলফ কোয়ারেন্টিনে থাকা। রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেই কিংবা তাদের থুতু বা কাশি সেই লোকের গায়ে লাগলে এই রোগ সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই চিকিৎসক ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেলফ কোয়ারেন্টিনের প্রতি খুব জোর দেওয়া হচ্ছে। এখন এটাই হচ্ছে এই ভাইরাস নিরোধের একমাত্র ব্যবস্থা। কিন্তু বিদেশি ও সচেতন মানুষ এই নিয়ম মেনে চললেও বাংলাদেশি কমিউনিটি এ ব্যাপারে এখনো পুরোপুরি সচেতন নয়।

নিউইয়র্কের কিছু সুপারমার্কেট ঘুরে দেখা যায়, তারা এখন আর কাউকে একসঙ্গে স্টোরে ঢোকার সুযোগ দিচ্ছে না। একজন একজন করে স্টোরে ঢোকার নতুন নিয়ম চালু করেছে তারা। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু আমাদের বাংলাদেশি স্টোরগুলোতে। বারবার বলা সত্ত্বেও কেউ নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার আবেদন কিংবা উপদেশ আমলে নিচ্ছেন না।

জরুরি অবস্থার মধ্যে একেবারে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে নিউইয়র্ক নগরীর বার ও রেস্তোরাঁগুলো। ছবি: রয়টার্স
জরুরি অবস্থার মধ্যে একেবারে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়েছে নিউইয়র্ক নগরীর বার ও রেস্তোরাঁগুলো। ছবি: রয়টার্স

আমার এক বন্ধু ইংল্যান্ড থেকে ফোন করে জানালেন, পাবলিক পার্কগুলোতে বাংলাদেশি মানুষের ভিড় এখন বেড়ে গেছে। অনেকেই পার্কে এসে বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা করছেন। একই অবস্থা শুনেছি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। অপ্রয়োজনে রাস্তায় গাড়ি বের করায় সৌদি পুলিশ অনেক লোককে দশ হাজার সৌদি রিয়াল পর্যন্ত জরিমানা করেছে। দেশে এক প্রবাসী কমিউনিটি নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানলাম, তিনি মসজিদে দোয়া মাহফিলে অংশ নিয়ে ফিরেছেন। তিনি জানালেন, দেশে এখন চলছে মসজিদে মসজিদে দোয়ার আয়োজন। সৌদি আরবের হারাম শরিফ, মদিনার মসজিদে নববী থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্বের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ সব উপাসনালয় যেখানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের মসজিদে মসজিদে এই মুহূর্তে দোয়া কিংবা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এখন যেসব এলাকায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, তারা যদি নিজ দায়িত্বে লোকসমাগম এড়িয়ে না চলেন, তাহলে কোনোভাবে মৃত্যুর হার কিংবা মহামারি রোধ করা যাবে না।

ভাবতে অবাক লাগে আমেরিকার মতো উন্নত দেশে মানুষ এখন ঝাঁকে ঝাঁকে মৃত্যুবরণ করছে চিকিৎসা ছাড়াই। চিকিৎসা সামগ্রী প্রচুর পরিমাণে হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে এই মৃত্যুর সংখ্যা যে আমেরিকায় আরও বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।

এ জন্য বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ও অন্যান্য দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনকে দোষারোপ করছেন। কারণ, এ ধরনের মহামারি রোধে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য কিংবা সিটিগুলোতে যেসব আধুনিক হাসপাতাল রয়েছে, তার ৮০ শতাংশ আগে থেকেই দখল করে আছে অন্য রোগীরা। ফলে সব হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ বেড, চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান কিংবা চিকিৎসা সরঞ্জাম কাজে লাগানো হচ্ছে। এ জন্য নিউইয়র্ক, নিউজার্সি ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো জনবহুল দেশগুলোতে মানুষ মৃত্যুহার কমানো যাচ্ছে না।

আমেরিকায় এখন এমনিতেই ঋতু পরিবর্তনের সময়। এ সময় মানুষ কমবেশি অ্যালার্জিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনাভাইরাস বা কোভিড -১৯। ফলে সীমাহীন উদ্বেগে দিন গুনছে মানুষ। আবার হাসপাতাল থেকেও এই রোগ ছড়াচ্ছে বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। কারণ, হাসপাতালগুলোতে এখন পর্যন্ত এসব রোগীর জন্য পৃথক কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা সংগত কারণেই চালু করা সম্ভব হয়নি। সাধারণ রোগীদের সঙ্গে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীও একই হাসপাতালে থাকছে। অন্যদিকে নিউইয়র্ক, নিউজার্সিসহ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল সরঞ্জামাদির সমস্যা গোটা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।