ক্যাবচালক, রেস্তোরাঁ কর্মীদের দিন কাটছে যেভাবে

হলুদ ট্যাক্সিক্যাব, উবার, লিফট চালিয়ে এবং হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। নিউইয়র্ক অবরুদ্ধ করায় তাদের হাতে কাজ নেই। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা নাজুক অবস্থা আরও শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায় ২০ মার্চ থেকে। ওই দিন নিউইয়র্কের গভর্নর জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার নির্দেশ দেন। ২২ মার্চ সন্ধ্যা ৮টা থেকে বিশেষ এই নির্বাহী আদেশ কার্যকর হয়। এ কারণে শুধু নিউইয়র্ক নগর নয়, আশপাশের সব নগরের প্রবাসীরাও স্বেচ্ছায় গৃহবন্দীত্ব গ্রহণ করছেন।

নিউইয়র্কের ট্যাক্সিক্যাব চালকেরা আর্থিক সংকটের কারণে চরম হতাশার মধ্য জীবনযাপন করছেন। ডিএমভির হিসাব মতে, নিউইয়র্কে পেশাদার ড্রাইভার আছেন ৮০ হাজার। এই চালকদের বেশির ভাগই হলুদ ক্যাবচালক। নিউইয়র্ক শহরে হলুদ ট্যাক্সির সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি। উবারের মতো ভাড়াটে গাড়ি অসংখ্য। ২০১২ সালে এটি শুরুর পর এখন পর্যন্ত নগরে এই সংখ্যা ৮০ হাজারে পৌঁছেছে। এসব চালকের কেউ কেউ উবার, লিফ্টসহ অন্যান্য রাইডশেয়ার কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।

নিউইয়র্কে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার আগেই তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক মেডেলিয়ান আগেই তাদের গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়েছেন। কারণ চিনের উহানে করোনা ধরা পড়ার পর যখন ইতালির মৃত্যুর মিছিল বড় হচ্ছিল, তখনই এয়ারপোর্টে যাত্রী কমে যাওয়া শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই মূলত চালকেরা বেকার হতে শুরু করেছে। যাত্রী সংকটে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে উড়োজাহাজ চলাচল কমে গেছে। একের পর এক ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে। এতে ধাক্কা লেগেছে ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর ব্যবসায়। যাত্রী না থাকায় চালকদের অলস সময় কাটাতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন চালকদের অনেকে।
কথা হয় ইয়েলো ক্যাবচালক রেজাউলের সঙ্গে। তিনি বারো বছর ধরে ইয়েলো ক্যাব চালাচ্ছেন। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ঘরে বসা, আয়–রোজগার নেই। জমানো টাকা খরচ করে চলছেন। মাসের বাড়ি ভাড়া অর্ধেক দিয়েছেন। বাকিটা এখন দিতে পারবেন না বলে বাড়িওয়ালাকে জানিয়েছেন। সবুজ ট্যাক্সি চালকেরা আরও খারাপ অবস্থায় আছেন। লিমোজিন চালকেরা পেশা ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টায় আছেন। নিয়মিত যারা গাড়ি চালান, তারা আর কোন কাজ করেননি বা অন্য কাজের অভিজ্ঞতাও নেই। তারা এই সময়ে কোথায় যাবেন, কী করবেন, সেই চিন্তায় আছেন।

জাহেদ আহমেদ নামে আরেক ক্যাবচালক বলেন, এক সপ্তাহের বেশি ঘরে বসা। সঞ্চয়ের অর্থে বড়জোর আর এক সপ্তাহ চলতে পারবেন। আবদুল কালাম জানালেন, তিনি ৯/১১ এর সময়ও এমন পরিস্থিতি দেখেননি। হাতে যে টাকা আছে, তাতে যদি ঘর বাড়া দিতে না হয়, বড়জোর দুই সপ্তাহ চলতে পারবেন।
ইন্দিরা ভারতীয় নাগরিক। গত ছয় বছর ধরে উবার লিফ্টের কাজ করছেন। তিনি গত বারো দিন ধরে ঘরে বসা। কোন কাজ নেই। তার স্বামী কাজ করতেন ম্যানহাটনের রেস্তোরাঁয়। তাদের রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে।
রেস্তোরাঁয় যারা কাজ করেন, তাদের অবস্থাও একই। বেশির ভাগ বাঙালিই ক্যাবচালক পেশার পরই রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। রেস্টুরেন্টে কাজ করা মানুষের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। দুই সপ্তাই ধরে সব ধরনের রেস্তোরাঁ বন্ধ। কিছু কিছু নাম করা রেস্তোরাঁ তাদের দু–একজন কর্মচারী রেখে কিচেনটা শুধু খোলা রেখেছে তাদের অনলাইনে ডেলিভারির জন্য। অধিকাংশ রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মচারীরা কর্মহীন ঘরে কাটাচ্ছেন। রেস্তোরাঁ বন্ধ হওয়ায় মালিক পক্ষ কাউকে বেতন দেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাদেরও একই কথা, সামনের দিনে পরিবার–পরিজন নিয়ে কীভাবে চলবেন।

সরকার সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছেন। সেটা কবে থেকে কার্যকর হবে বা হলেও কোন পদ্ধতিতে তা সাধারণ মানুষের মাঝে বণ্টন করবেন, তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। নিউইয়র্কের রাস্তার দুপাশে যেসব রেস্তোরাঁ দেখা যায়, তা হলো অধিকাংশ অবৈধ অভিবাসীর কর্ম সহায়ক জায়গা। সেসব রেস্তোরাঁয় যারা কাজ করেন তাদের বেশির ভাগেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। রেস্তোরাঁ মালিকেরা কখনোই এদের ন্যূনতম মজুরি দেন না। বর্তমান করোনাভাইরাসের আতঙ্কে সব ধরনের রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় তাদের অবস্থা বেশি খারাপ। সরকার থেকে কি এই অবৈধ অভিবাসীদের অর্থ দেওয়া হবে?
করোনাভাইরাস মহামারিতে নিউইয়র্কে এলোমেলো প্রবাসীদের জীবনযাত্রা। প্রতিদিনের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের কঠিন হিসাব মিলিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে হঠাৎ নেমে এসেছে হতাশা। করোনা রোধে পুরো শহর লকডাউন করায় ভুতুড়ে নগরে পরিণত হয়েছে নিউইয়র্ক। রাস্তায় মানুষের দেখা নেই বললেই চলে। হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ খাঁ খাঁ করছে। উবারের রাইড শেয়ারিং সার্ভিস বন্ধ রাখা হয়েছে। ইয়েলো ট্যাক্সি চালকদের মধ্যে শুধু মেডেলিয়নের মালিক-চালিকেরা রাস্তায় রয়েছেন, তাও তুলনায় কম। অন্যরা স্বেচ্ছায় ছুটিতে আছেন। কারণ, ১২ ঘণ্টা ট্যাক্সি চালিয়ে ১০ ডলারও পকেটে থাকছে না। যাত্রী নেই এয়ারপোর্টে। পর্যটক নেই সিটিতে। সিটির অধিবাসীরাও কেনাকাটা করতে বাসার বাইরে যাচ্ছেন না। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রবাসীরা।
আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষতি পুষিয়ে দিতে ‘করোনা ভাতা’ দেওয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করলেও বৈধ কাগজপত্র না থাকা অনেক প্রবাসী তা থেকে বঞ্চিত হবেন। স্প্যানিশ, আফ্রিকান, পাকিস্তানিদের পরই বৈধ কাগজপত্র না থাকার দিক থেকে বাংলাদেশিদের অবস্থান। এ শ্রেণির প্রবাসীর বড় একটি অংশ রেস্টুরেন্ট ও গ্রোসারি স্টোরে কাজ করতেন। রেস্টুরেন্ট থেকে এখন শুধু ‘টেক-আউট’ অর্ডার দিয়ে খাবার বাসায় নেওয়া হচ্ছে। রেস্তোরাঁয় বসে খাবার অনুমতি না থাকায় ওই প্রবাসী শ্রমিকেরা বেকার হয়ে পড়ছেন।