অসহায় মানুষ জানতে চায়, সাহায্য কোথায়?

নিউইয়র্কের সাবওয়ে বৃহস্পতিবার। ছবি: মনীষা তৃষা
নিউইয়র্কের সাবওয়ে বৃহস্পতিবার। ছবি: মনীষা তৃষা

করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আমেরিকার অধিকাংশ মানুষের অসহায় দৃষ্টি এখন সরকারি সহযোগিতার দিকে। সরকারের রাজস্ব বিভাগ ‘আইআরএস’ জানিয়েছে নাগরিকেরা ঘরে বসেই সাহায্যের অর্থ পাবেন। হাজার হাজার ভয়ার্ত ফোন কল যাচ্ছে কর বিভাগে।

২৬ মার্চ বৃহস্পতিবার আইআরএস থেকে জানানো হয়েছে, নাগরিকদের এ অর্থ পাওয়ার জন্য কিছুই করতে হবে না। যাঁরা চলতি বছর ট্যাক্স রিটার্ন করেননি বা করতে পারেননি, তাঁদের আগের বছরের বিবরণী দেখে অর্থ প্রেরণ করা হবে। নিউইয়র্কে হাসপাতালে হিমায়িত ট্রাক রেখে একের পর এক মরদেহ ওঠানো হচ্ছে। করোনাভাইরাস আক্রান্ত কেউ মারা গেলেই এলমাহার্স্ট হাসপাতালের বেড খালি হচ্ছে। নিউইয়র্কে একদিনে ৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

লকডাউনের কারণে অবরুদ্ধ মানুষের একদিকে ভীতি আরেক দিকে জীবন চালানোর কঠিন বাস্তবতা। ৩৩ লাখের বেশি লোক বেকার ভাতার আবেদন করেছে। নিউইয়র্কে রাজ্য আইন প্রণেতারা সাবই জানিয়েছেন, বাড়ির মর্টগেজ তিন মাসের জন্য স্থগিত নয়, বাতিল করার উদ্যোগ নিতে হবে।

নিউইয়র্কের বিমর্ষ মেয়র বিল ডি ব্লাজিও বৃহস্পতিবার বলেছেন, ‘একের পর এক আমরা মূল্যবান জীবন হারাচ্ছি। এ অবস্থা আগামী দিনগুলোতে আরও নাজুক হতে পারে। নিউইয়র্কসহ উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য থেকে করোনাভাইরাসের তাণ্ডব মধ্য আমেরিকার রাজ্যগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। শিকাগো, ওহাইও, মিশিগানে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মার্কিন সেনাবাহিনী সব ধরনের প্রশিক্ষণ, মহড়া, জরুরি নয় এমন সমাবেশ— স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।

আগেই জানানো হয়েছে, আমেরিকার যারা এককভাবে বছরে ৭৫ হাজার ডলার এবং স্বামী-স্ত্রী বা ডোমেস্টিক পার্টনার মিলে যৌথভাবে এক লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেন তারা জনপ্রতি ১২০০ ডলার পাবেন। দম্পতি পাবেন ২৪০০ ডলার। যাদের কর্ম অনুমতিসহ সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর আছে তারাই এ অর্থ পাবেন। ১৭ বছরের নিচে প্রতি সন্তানের জন্য পাবেন আরও ৫০০ ডলার।

ব্রংকসের অভিবাসীবহুল স্টার্লিং অ্যাভিনিউ এলাকা। ছবি: মনীষা তৃষা
ব্রংকসের অভিবাসীবহুল স্টার্লিং অ্যাভিনিউ এলাকা। ছবি: মনীষা তৃষা

যাদের কোনো আয় নেই অর্থাৎ অবসরভাতা বা সামাজিক নিরাপত্তায়( এসএসআই) আছেন, তারাও পাবেন। এ জন্য কারও কিছু করার দরকার হবে না। ২০১৯ সালের বা আগের বছরের অর্থাৎ ২০১৮ সালের ট্যাক্স রিটার্নের সূত্র ধরেই 'আইআরএসএ' অর্থ পাঠাবে। এককভাবে ৭৫ হাজার বা দাম্পত্যের ক্ষেত্রে বছরে এক লাখ ডলারের আয় অতিক্রম করলে প্রতি ১০০ ডলারে পাঁচ ডলার করে কমতে থাকবে এবং ৯৯ হাজার ডলার বা এক লাখ ৪৬ হাজার ডলারে গিয়ে তা থেমে যাবে যাদের এক সন্তান আছে। যে দম্পতির কোনো সন্তান নেই, তাদের অনুদান থামবে এক লাখ ৯৮ হাজারে থামলে।

অনেকের প্রশ্ন, সরকার থেকে পাওয়া এ আয় করযোগ্য আয় হিসেবে দেখা হবে কিনা। বিলটি পরীক্ষা করে সিপিএরা জানিয়েছেন, এ অর্থ করযোগ্য আয় হিসেবে ধরা হবে না। ২০২০ সালের ফেরতযোগ্য ট্যাক্স ক্রেডিট হিসেবে দেখা হবে। কোনো কর দেনা থাকলেও নাগরিক সহযোগিতার এ অর্থ পাওয়া যাবে। ২০২০ সালের ক্রেডিটের সঙ্গে এ অর্থ অ্যাডজাস্ট হবে, রিফান্ডের সঙ্গে নয়।

নিম্ন আয়ের বা প্রবীণদের মধ্যে যারা সাম্প্রতিক বছরে ট্যাক্স রিটার্ন দেননি, যাদের বৈধ সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর আছে—তাঁরা ট্যাক্স এ বছরের রিটার্ন করে অর্থ পাওয়ার তালিকায় আসতে পারেন।

সহযোগিতার এ বিলটি কংগ্রেসের পূর্ণ ভোটের পর এ সপ্তাহের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট স্বাক্ষর করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। আগামী সোমবার থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই অধিকাংশ নাগরিক এ অর্থ পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে। আইআরএস ১৫ দিনের মধ্যে পাঠানোর চেষ্টা করবে। যারা ট্যাক্স ফাইলিংয়ের সময় ডাইরেক্ট ডিপোজিট করেছেন, তারা ব্যাংক একাউন্টে সরাসরি অর্থ পাবেন। যারা ডাকযোগে আগের রিফান্ড গ্রহণ করেছেন, তাদের সর্বশেষ জানা ঠিকানায় চেক আসবে। যারা এ বছরে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, তারা এবারের ট্যাক্স রিটার্ন করার পর চাইল্ড ক্রেডিট পাবেন।

নিউইয়র্ক , নিউজার্সিসহ সব রাজ্যে কর্মহীনতার আবেদন দ্রুত মঞ্জুর করা হচ্ছে। নতুন নির্দেশনায় নিউইয়র্কসহ রাজ্যগুলোতে নিয়মিত কর্মজীবীসহ স্বাধীন কর্মজীবী যেমন ক্যাব চালক, উবার চালকদেরও আবেদন মঞ্জুর করা হচ্ছে। সবাই রাজ্যের ওয়েবসাইটে গিয়ে আবেদন করতে পারেন। প্রতিটি নগরে সরকারি সাহায্য ছাড়া নানা চ্যারিটি দিনরাত কাজ করছে।

ব্রংকসের অভিবাসীবহুল স্টার্লিং অ্যাভিনিউ এলাকা। ছবি: মনীষা তৃষা
ব্রংকসের অভিবাসীবহুল স্টার্লিং অ্যাভিনিউ এলাকা। ছবি: মনীষা তৃষা

অভিবাসীদের মধ্যে যাদের বৈধতার কাগজপত্র নেই, তাঁরা চ্যারিটির সাহায্য নিতে পারেন। নিউইয়র্কে ৩১১ নম্বরে কল করলে চ্যারিটির সঙ্গে সংযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি নগরীতে স্থানীয় চার্চ বা নগর, শহর কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা সাহায্যের জন্য জরুরি বিভাগের লোক কাজ করছেন।

নিউইয়র্কের রাজ্য সিনেটর মাইক গিনারিস রাজ্য গভর্নরের কাছে তিন মাসের জন্য বাড়ির মর্টগেজ এবং ভাড়াটেদের ভাড়া মওকুফ করে নির্বাহী আদেশ জারি করার আহ্বান জানিয়েছেন। এ নিয়ে জরুরি আইন প্রস্তাব উত্থাপন করছেন নিউইয়র্কের রাজ্য আইন প্রণেতারা।

নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের (এনওয়াইপিডি) ৩২২ সদস্য নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ডেনিস ডিকসন নামের এক পুলিশ অফিসার মারা গেছেন। নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের তিনিই প্রথম পুলিশ অফিসার, যিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। ডিকসন দীর্ঘ ১৪ বছর সুনামের সঙ্গে এনওয়াইপিডি ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছেন। বুধবার রাত অবধি ৩২৩৭ কর্মকর্তা অসুস্থ হয়েছেন যা স্বাভাবিকের চেয়ে তিনগুণ বেশি।

করোনায় অনেক বাংলাদেশি-আমেরিকান পুলিশ অফিসার আক্রান্ত হয়েছেন। ইতিমধ্যে মাহবুবুর রহমান জুয়েল নামের এক পুলিশ অফিসার সুস্থ হয়ে উঠছেন। হাসপাতালে সিট সংকটের কারণে নিজ বাসায় জুয়েল কোয়ারেন্টিনে আছেন। জুয়েল জানিয়েছেন, সবকিছু মেনে চললে ৯ দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরব এমনটাই চিকিৎসক বলেছেন।

নিউইয়র্কের অন্যতম বৃহৎ বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার। বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার মনীষা তৃষা পার্কচেস্টারের স্টারলিং অ্যাভেনিউ ঘুরে দেখেছেন। দেখেছেন অন্যরকম এক চিত্র। প্রিমিয়াম সুইটস, খলিল বিরিয়ানি অ্যান্ড চাইনিজের মতো জনপ্রিয় দোকানগুলো বন্ধ। সদা ব্যস্ত আল আকসা, ইত্যাদি সুপার মার্কেটে এখন ক্রেতাদের আনাগোনা প্রায় নেই বললেই চলে। প্রতিবছর সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ একাডেমি অফ ফাইন আর্টস (বাফা) বিপুল সমারোহে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করে থাকে। এবার বাফার দপ্তরে তালা ঝুলছে।

ব্রংকসে স্বদেশি গ্রোসারি স্টোরে সতর্ক আর সীমিত যাতায়াত। ছবি: মনীষা তৃষা
ব্রংকসে স্বদেশি গ্রোসারি স্টোরে সতর্ক আর সীমিত যাতায়াত। ছবি: মনীষা তৃষা

করোনা আতঙ্কে প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে কেউই বের হচ্ছেন না। তবে সুপারশপ 'আল আকসার' বাইরে দেখা গেল ক্রেতাদের লম্বা লাইন। প্রবেশপথ বন্ধ, প্রবেশের দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছে মাস্ক পরিহিত এক বিক্রয়কর্মী। কেউ ঢুকতে গেলেই গ্লাভস হাতে সাবধানে খুলে দিচ্ছেন দরজা, যেন হাতলে অন্য কারও হাত না পড়ে। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দোকানটির অভ্যন্তরেও নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা। একসঙ্গে ১০ জনের বেশি ক্রেতা দোকানের ভেতরে অবস্থান করতে পারবেন না। ক্যাশ কাউন্টারের সামনে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

সুপারশপটির সিনিয়র বিক্রয়কর্মী অমিত সাহা জানালেন, লকডাউনের পুরো সময় জুড়েই এ রকম কড়াকড়ি চালু থাকবে। লাইনের কারণে একটু বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলেও এ নিয়ে ক্ষোভ নেই ক্রেতাদের। এলাকার বাসিন্দা নাসির জানালেন, ‘সময় বেশি লাগুক, কিন্তু এ রকম জরুরি অবস্থায় একসঙ্গে ২-৩ জনের বেশি না ঢোকানোই ভালো।’

নিউইয়র্কের এলমহার্স্ট হাসপাতালের দিকে আতঙ্কের দৃষ্টি সবার। একের পর মৃতদেহ বেরিয়ে আসছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত মধ্যরাতের পর সাইরেন আর আতঙ্কের বাতি জ্বালিয়ে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে। নগরীর মেয়র অতিরিক্ত চিকিৎসক পাঠিয়েছেন। ফেডারেল সরকারের আরেকটি নৌ হাসপাতাল জরুরি ভিত্তিতে নিউইয়র্কে আসছে বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। দেশটিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৫ হাজারেরও বেশি এবং মারা গেছেন ১ হাজার ৩০০ জন। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে নিউইয়র্কে। রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৮ হাজারেরও বেশি এবং মারা গেছেন ৪৬৬ জন।