ভালো নেই বাংলাদেশিরা

ব্রঙ্কসের স্টারলিং এভিনিউয়ে এক ব্যক্তিকে আজান দিতে দেখা যায়
ব্রঙ্কসের স্টারলিং এভিনিউয়ে এক ব্যক্তিকে আজান দিতে দেখা যায়

ভালো নেই নিউইয়র্কের মানুষ। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে যে নগরের লোক পুষ্পের হাসি হেসেছে, তাদের জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আশার বাণী উপহাস শোনাতে পারে। নিউইয়র্ক নগরের মানুষের মনের আকুতি প্রকাশ পাচ্ছে মেয়র বিল ডি বাজিওর কথায়। স্পন্দনহীন নগরীর বিমর্ষ মেয়রের আকুতি, প্রতিটি দিন এখন গণনার। কথা নয়, কাজের সময় এখন।
নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে ২৬ মার্চ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে ৩০ হাজারের বেশি আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩৮৫ জনের। সকালেই ১২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি এতই নাজুক যে, কারাবন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য কুখ্যাত রাইকার্স আইল্যান্ড কারাগারে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। দ্রুত কারাবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে।
লকডাউনের নিউইয়র্কে অবরুদ্ধ লোকজন ঘরে বসে খারাপ সংবাদই পাচ্ছেন বেশি। নিউইয়র্কে এ পর্যন্ত অন্তত ৬ জন বাংলাদেশি মার্কিনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার কাছে তাদের নিশ্চিত পরিচয় থাকলেও পরিবার থেকে তা প্রকাশ না করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
জননিরাপত্তায় নিযুক্ত নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের (এনওয়াইপিডি) ১০০ জনের বেশি কর্মকর্তা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা অন্তত তিনজন বাংলাদেশি এনওয়াইপিডি সদস্যের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে। সবাই বাসায় হোম কোরান্টিনে আছেন। তবে সবার অবস্থা ভালো। 

ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত একজন কর্মকর্তা জানান, ২৩ মার্চ ম্যানহাটনের হাসপাতালে তাঁর শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া গেলে রোগী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে বাসায় ‘সেলফ কোরাইন্টিনে’ যেতে বলা হয়। হাসপাতাল থেকে নিয়মিত তাঁর অবস্থা মনিটর করা হবে এবং শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলেই কেবল হাসপাতালে ভর্তি করা হবে। তাকে বাস, ট্রেনের মতো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আক্রান্ত ট্রাফিক সদস্যটি উবার, ট্যাক্সি নিয়ে কুইন্সে তাঁর বাসায় ফিরতে চেয়েও ব্যর্থ হোন। কেউ তাঁকে রাইড দেয়নি। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও বাসায় নিতে কেউ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। সবাই আতঙ্কিত। পরিস্থিতি এতই নাজুক, হাসপাতালের অপেক্ষমাণ কক্ষে পাঁচ ঘণ্টা বসে ছিলেন রাইড পাওয়ার আসায়।

২২ মার্চ এস্টোরিয়া এলাকায় একজন বাংলাদেশি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃতদেহ গোসল করানোর জন্য পরিবার কাউকে পাচ্ছিল না। নিউইয়র্কে বাফেলো থেকে আমাদের প্রতিনিধি আসিফ মোক্তাদির জানান, নগরীর দুজন পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে ভাইরাসে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। বাফেলোতে বসবাসরত স্বদেশিরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটানোর কথা তিনি জানান।
মিশিগান থেকে ফারজানা চৌধুরী জানান, রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এর মধ্যে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজ্যের গভর্নর ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত নাগরিকদের ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
নিউইয়র্ক নগরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আড়াইর হাজারের বেশি আক্রান্তের অবস্থা নাজুক বলে জানানো হয়েছে। এদের ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। পুরো আমেরিকার ৬০ শতাংশ করোনাভাইরাস আক্রান্ত এখন নিউইয়র্কে। গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো জানিয়েছেন, রাজ্যের ৮০ হাজারের বেশি লোকজনকে এর মধ্যেই পরীক্ষা করা হয়েছে।
নিউইয়র্ক নগরের মেয়র ব্লাজিও জানিয়েছেন, তাঁর হাতে আর মাত্র এক সপ্তাহের চিকিৎসা সরঞ্জাম মজুত আছে। মেয়র মরিয়া হয়ে উঠেছেন সাহায্যের জন্য। ফেডারেল সহযোগিতা ত্বরান্বিত করার আকুতি জানিয়েছেন।
মার্চ থেকে এপ্রিলে পরিস্থিতি আরও নাজুক হবে বলে রাজ্য ও নগর নেতারা নাগরিকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। এর মধ্যে জরুরি শনাক্তকরণ দ্রুততার সঙ্গেই বাজারে আসছে বলে জানানো হয়েছে, যা ৪৫ মিনিটের মধ্যে ফলাফল দিতে পারবে।
লকডাইন নিউইয়র্কে বাংলাদেশিরা কেমন আছেন—জানতে যোগাযোগ করা হয় বেশ কিছু প্রবাসীর সঙ্গে। ব্রঙ্কসে বসবাস করা সৈয়দ উতবা জানালেন, তিনি নগরীর একটি জরুরি বিভাগে কাজ করেন। স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকলেও নিজে কাজের জন্য বাইরে যাচ্ছেন। ঘরে ফিরে নিজেকে পৃথক রাখছেন।
ব্রুকলিন থেকে মনীষা দত্ত জানালেন, তিনি সেনসাসে কাজ করছেন। ঘর থেকে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে টিভি দেখে দুঃসংবাদ দেখছেন। বাংলাদেশে পরিবার, স্বজনকে নিয়ে উদ্বিগ্ন এই স্বদেশি জানালেন, ইচ্ছে হচ্ছে দেশে চলে যাই। কবে হবে এ অবস্থার অবসান? জানেন কেউই।
জামাইকায় বসবাস করেন একটি মেডিসিন কোম্পানিতে কর্মরত রওশন হক। জানালেন, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়েও কাজে যেতে হচ্ছে। ঘরে থাকা স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে উদ্বেগের কথা জানালেন। এস্টোরিয়া থেকে মনিজা রহমান জানালেন, নগরের স্কুল সিস্টেমে তাঁকে ঘরে বসেই কাজ করতে হচ্ছে। সন্তানদের নিয়ে নিউইয়র্কের ঘরে বন্দীজীবন বেশ কঠিন যাচ্ছে।
কুইন্সে বসবাসরত এডুকেটর এইচ বি রিতা জানালেন, তিনিও ঘরে বসে নগরের বিশেষায়িত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। নগর থেকে শিক্ষার্থীদের আইপ্যাড দেওয়া হয়েছে, অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
জ্যামাইকা থেকে লেখিকা সেলিনা আখতার জানালেন, তিনি এয়ারলাইনসে কাজ করেন। এয়ারপোর্ট বন্ধ, ঘরে থাকার নির্দেশ। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ঘরে আছেন, শান্ত থাকার জন্য মেডিটেশন করছেন। গীতিকার ইশতিয়াক রূপু জানালেন, গৃহবন্দিত্বের যন্ত্রণা সহজ নয়। নিজে স্থির থাকার চেষ্টা করছেন। এ সংকটে নতুন কোনো গান রচনা করতে পারছেন না।
এস্টোরিয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধা সুব্রত বিশ্বাস জানালেন, দেশে পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্টের পর সরকার উৎখাতের হুলিয়া নিয়ে আত্মগোপনের চেয়েও কঠিন মনে হচ্ছে এই স্বেচ্ছা অবরোধের জীবন। করোনা থেকে ভায়লা সালিনা জানালেন, সবার জন্য কঠিন এ সময়ে নিজের অসুস্থ বাবার দেখভাল করাসহ নিজের ও স্বজনদের নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা বেড়েছে। নিজের পাশাপাশি সবার জন্য দোয়া করছেন।

জামাইকায় বসবাসরত আবদুস শহীদ জানালেন, ১৫ দিন ধরে তিনি ঘরের বাইরে যাননি। তাঁর শরীরে অন্য জটিলতা থাকার কারণে ডাক্তারের পরামর্শে তাঁকে জীবনের কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে।
২৪ মার্চ সোমবার দিবাগত মধ্যরাতের কিছু আগে নিউইয়র্ক নগরে দেখা যাচ্ছে শুধু পুলিশের গাড়ি। সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে। ভয়ার্ত নাগরিকেরা অ্যাম্বুলেন্সের বাতি দেখে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন, গাড়িটি কোনো তল্লাটে থামছে। কোনো বিল্ডিং থেকে আতঙ্কের ভাইরাস করোনা আক্রান্ত কয়জনকে উঠিয়ে নিচ্ছে! সড়ক, জনপদে খাঁ খাঁ শূন্যতা। মাঝে মধ্যে গাড়ির যান্ত্রিক আওয়াজ, সাইরেনের শব্দ—যেন এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শান্তির নগর নিউইয়র্কের লোকজন। কেউ জানে না, এ যুদ্ধের পরিণতি কি?
লং আইল্যান্ড এলাকায় একজনকে খাবার সরবরাহ করতে গেছেন শাহ আহমদ। সোমবার রাতে জানালেন, কোলাহলের নগরকে এভর ভুতুড়ে নগর মনে হচ্ছে। উজ্জ্বল আলো বড় ফিকে লাগছে।
এর শেষ হবে কবে? কবে কাজে ফিরে যাব?—এমন প্রশ্ন করলেন অভিবাসী সিরিল হাসান। জানালেন জ্যাকসন হাইটসে তার সামনেই রাত সাড়ে নয়টার সময় ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। বন্ধুক ধরে তিন যুবক গাড়ি থামিয়ে এক নারীর সবকিছু নিয়ে গেছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। দুর্যোগ মহামারি, লকডাউন, কর্মহীনতা , দোকানপাট, হোটেল রেস্টুরেন্ট, ব্যবসা-বাণিজ্যের ধসে পড়ার এ সময়ে সারা বিশ্বের মতো নিউইয়র্কের নাগরিকদেরও বিমর্ষ প্রার্থনা চলছে।
সবাই বলছে, দিন ফিরবেই। বলছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। শুধু স্বস্তি পাচ্ছেন না প্রশ্নকারীরা।