ইতালিতে 'যুদ্ধ' জয়ে কিউবার সাদা গাউনের সেনানীরা

মহামারি ঠেকাতে ইতালিতে চিকিৎসক ও নার্সদের দল পাঠিয়েছে কিউবা
মহামারি ঠেকাতে ইতালিতে চিকিৎসক ও নার্সদের দল পাঠিয়েছে কিউবা

মানবতা রক্ষার যুদ্ধে চীন-রাশিয়া ইতিমধ্যে যুদ্ধ শুরু করেছে। ইতালির আক্রান্ত মানুষ রক্ষায় চীন তাদের চিকিৎসক দল পাঠিয়েছে। একইভাবে রাশিয়া ১৫টি সামরিক জেট বোঝাই করে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও চিকিৎসক দল ইতালি ও ইরানে পাঠিয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা ছোট্ট দেশ কিউবাও বসে নেই। ক্ষুদ্র শক্তি নিয়েই করোনা-বিধ্বস্ত ইতালিতে সেনা পাঠাল সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।
করোনাভাইরাস মহামারিতে সবচেয়ে বিপন্ন দেশ ইতালির লোম্বার্ডিতে চিকিৎসা সহায়তা দিতে গেলেন কিউবার চিকিৎসক ও নার্সদের একটি দল। এর আগেই ১২ মার্চ চীনের চিকিৎসক, নার্সরা গেছেন ইতালিতে। তবে কিউবার চিকিৎসক দল ইতালিতে মহামারির চিকিৎসার জন্য যাওয়ার ঘটনায় সাড়া পড়েছে গোটা দুনিয়ায়।
১৯৫৯ সালে কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবের পর থেকেই সমাজতান্ত্রিক দেশটিকে শেষ করার মরিয়া চেষ্টা করে গেছে আমেরিকা; এখনো করছে। অর্থনৈতিক অবরোধসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাখা হয়েছে। পশ্চিমের উন্নত ধনী দেশগুলোও সমাজতান্ত্রিক কিউবার বিরুদ্ধে সেই পদক্ষেপকেই কার্যত সমর্থন করেছে। বিপরীতে এই ভয়ংকর সংকটের মোকাবিলায় কিউবা দ্বিতীয়বার ভাবেনি। ৫২ জনের শক্তিশালী চিকিৎসক দল পাঠানো হয়েছে। হাভানা থেকে রওনা হওয়ার আগে এই দলের সদস্যদের দেখা গেছে ফিদেল কাস্ত্রোর ছবি হাতে; সঙ্গে ছিল কিউবা ও ইতালির জাতীয় পতাকা। কিউবা অবশ্য আগেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অন্যতম ধনী ও শক্তিশালী দেশ ব্রিটেনের দিকেও। করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ায় যাত্রীবাহী জাহাজ এম এস ব্রেইমারকে যখন কোনো দেশ তাদের তটে ভিড়তে দিচ্ছিল না, তখন কিউবাই তাদের বন্দর খুলে দেয়। জাহাজটিতে এক হাজার যাত্রী ছিলেন।
দেশে দেশে মহামারি বা ভয়ংকর স্বাস্থ্য সংকট, ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয়ে কিউবার চিকিৎসকদের ভূমিকা সুবিদিত। সাম্প্রতিক সময়ে হাইতির কলেরা বা পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা মোকাবিলায় তাদের অনবদ্য ভূমিকার কথা সকলেই জানে। এ ছাড়া ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া, জ্যামাইকা, সুরিনাম ও গ্রেনাডাতেও চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছে তারা। কিন্তু ইতালির মতো উন্নত দেশে এমন সহায়তা নিয়ে প্রথম গেলেন কিউবার চিকিৎসকেরা।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য ইতালি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ইতালিতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পরও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দেশ এগিয়ে আসেনি তাদের সাহায্য করতে। পাশে দাঁড়ায়নি ‘বন্ধু’ আমেরিকাও। এ নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল ইতালি। ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি দেশও সাহায্য করেনি’ বলে জানিয়েছিল ইতালি। এই পরিস্থিতিতে ইতালি সাহায্য চায় চীন, কিউবা ও ভেনেজুয়েলার কাছে। লোম্বার্ডির স্বাস্থ্যমন্ত্রী গিউলিও গ্যালেরা সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিলেন, ‘আমরা কিউবা, ভেনেজুয়েলা ও চীনের সঙ্গে কথা বলছি।’
ইতালি রওনা হওয়া চিকিৎসক দলের সদস্য ৬৮ বছর বয়সী লিওনার্দো ফার্নান্দেজ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘আমরা সবাই ভয়ে ভয়ে আছি। কিন্তু এটা বৈপ্লবিক কর্তব্য, যা করতেই হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভয় সবাই পায় সুপারহিরোরা ছাড়া। আমরা সুপারহিরো নই, বিপ্লবী চিকিৎসক।’ ফার্নান্দেজ এই নিয়ে আটবার আন্তর্জাতিক মিশনে যাচ্ছেন। ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আগে তিনি লাইবেরিয়াতে গিয়েছিলেন। দলের আরেক সদস্য গ্রাসিলিয়ানো ডায়াজ জানান, ‘এটা একটা সম্মানজনক কাজ, যা সংহতির নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।’
কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় গড়ে উঠেছিল কিউবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। বিশ্বে কমিউনিস্ট ব্লক ভেঙে পড়লে তার কিছু ক্ষতি হয়। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়ার অবরোধেও অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যেও কিউবা চিকিৎসক তৈরি করে গেছে; বিপ্লবী চিকিৎসক, যারা শুধু নিজের কথা ভাবেন না। শুধু নিজের দেশের কথাও ভাবেন না তাঁরা। গোটা দুনিয়াটাকেই নিজের ঘর মনে করার কমিউনিস্ট মতাদর্শের তাগিদে ছুটে চলেন নানা প্রান্তে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিউবাও। ২৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন সেই দেশে। নিজের দেশেও করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে কিউবা। তা সামাল দিয়েই চলছে অন্য দেশে রোগমুক্তির লড়াই। মানবতাকে রক্ষা করতে হবে যে। এটাই বৈপ্লবিক কর্তব্য—বিশ্বাস করে কখনো হার না মানা চে গুয়েভারা উত্তরসূরিরা।