একটি মুভি ও নিস্তব্ধ করোনাকাল

করোনাভাইরাস আক্রান্তদের সংখ্যা বিশ্বব্যাপী বাড়ছে। তা থেকে আরোগ্যলাভও করছেন একটি বড় সংখ্যক মানুষ। আচ্ছা, পর্যন্ত কত লাখ মানুষ সুস্থ হয়ে নিজগৃহে ফিরে গেছেন—এর সঠিক পরিসংখ্যান কি কারও কাছে আছে? না, নেই। নেওয়ার দরকারও মনে করছেন না অনেকেই।
বদলে গিয়েছে গোটা বিশ্ব! চারদিকে নিস্তব্ধ নীরবতা। মানুষ কার্যত গৃহবন্দী।
সেল্ফ কোয়ারেন্টিনে আছেন মানুষ। পাশ্চাত্যে তা মানতেই হচ্ছে। উপমহাদেশে যদিও অবস্থা এখনো ভিন্ন! কারণ সরকারি প্রচেষ্টায় যেমন গাফিলতি আছে, তেমনি আছে মানুষের সচেতনতায়ও।
বিশ্ব যখন কোরোনাভাইরাস নিয়ে শঙ্কিত, তখন আপনাদের একটি মুভির গল্প বলি। এই মুভিটি ২০১১ সালে আমেরিকা নির্মাণ করে। এর নাম Contagion (কন্টাজিওন)।
স্টিভেন সোডারবার্গ পরিচালিত এই ছবিতে দেখানো হয়, একজন নারী হংকং থেকে আমেরিকার মিনেসোটায় ফিরে আসার চতুর্থ দিনে মারা যান। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) এই মারা যাওয়ার লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে। কোত্থেকে এই রোগের উৎপত্তি, খুঁজতে শুরু করে। রোগীর সংস্পর্শে আসা সবার জন্য কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু এই রোগ ছড়িয়ে যায়, ঠেকানো অসম্ভব হয়ে যায়। অন্যদিকে চলতে থাকে ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টা। অবশেষে একটা ভ্যাকসিন আবিষ্কারও হয়, ধীরে ধীরে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করে, মানুষ আবার সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।
ছবিতে দেখানো হয়, ভাইরাসের কারণে পৃথিবীর প্রায় ২০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য আতঙ্ক নিয়ে নির্মিত ওই চলচ্চিত্রের সঙ্গেও বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি মিলে যায়।
কন্টাজিওন সিনেমায় অভিনয়ের মূল ভূমিকায় রয়েছেন মেরিওন কটিলার্ড, ব্রায়ান ক্র্যানস্টন, ম্যাট ড্যামন, লরেন্স ফিশবার্ন, জুড ল, গিনিথ প্যাল্ট্রো, কেট উইন্সলেট ও জেনিফার এহলে। গল্পের মূল প্লটটি ফোমাইটস নামক এক ধরনের ভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত রোগকে নির্দেশ করে বানানো হয়েছে, যা চিকিৎসক গবেষক এবং জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দিয়ে এই রোগ শনাক্তকরণ এবং এটি নির্মূল করার চেষ্টা, মহামারিতে সামাজিক বিশৃঙ্খলা কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
কন্টাজিওন মুভিটি ২০১১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ইতালির ভেনিসে ৬৮তম ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয়েছিল এবং ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী মুক্তি পেয়েছিল।
‘কন্টাজিওন’ চলচ্চিত্রের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্নার ব্রাদার্স বলেছে, চীনে যখন প্রথম করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তখন বিশ্বের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের তালিকায় কন্টাজিওন’-এর অবস্থান ছিল ২৭০তম। তিন মাস পরে কন্টাজিওনের জায়গা হয়েছে নবম অবস্থানে। তার সামনে রয়েছে শুধুমাত্র হ্যারি পটার সিরিজের আটটি চলচ্চিত্র। এর একমাত্র কারণ করোনাভাইরাস। প্রায় এক দশক আগে তৈরি চলচ্চিত্রটির কাহিনির সঙ্গে বর্তমান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের অনেক মিল রয়েছে।
৬০ মিলিয়ন ডলারের বাজেটে বাণিজ্যিকভাবে ছবিটি ১৩৫ মিলিয়ন ডলার আয় করে, যা ব্যবসা সফল না হলেও মোটামুটি সফলতা পেয়েছিল। চলতি সময়ে এই মুভিটি আবার ব্যবসায় সফলতা দেখাতে পারে বলে মনে করছেন হলিউডের মুভি বিশ্লেষকেরা।
এখানে যে বিষয়টি বলা দরকার, তা হলো একজন সফল শিল্পদ্রষ্টা সময়ের আগামী দেখতে পান। ছবিটি সেভাবেই বানানো হয়েছিল। কিন্তু এই করোনাভাইরাস যে কাকতালীয়ভাবে এতটা মিলে যাবে, তা কি ভেবেছিল কেউ!
মার্কিন মুলুকে করোনাভাইরাস ইস্যু খুব দ্রুত তার গতিপথ বদলাচ্ছে। এই লেখা যেদিন পাঠকের হাতে পৌঁছাবে, তখন অবস্থা কেমন হবে তা বলা কঠিন।
বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল লিওং। তিনি বলেছেন, ‘নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তেই থাকবে।’
চীন সফর না করেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটিকে ‘টিপ অফ দ্য আইসবার্গ’ বলে মন্তব্য করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস এডহানম ঘেব্রেইয়েসাস।
এদিকে বিশ্বের প্রথম আক্রান্ত চীনের উহান প্রদেশে এখন আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে।
বিভিন্ন দেশের দেওয়া করোনাভাইরাস সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই ভাইরাস সবচেয়ে বেশি শক্তি দেখিয়েছে চীনে। দেশটিতে ৮০ হাজার ৮১৪ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এতে মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ২০০ জনের বেশি। আক্রান্তদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন ৭০ হাজারের বেশি।
চীনের উহানে কোরোনাভাইরাস নিয়ে একটি সংবাদ মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে গোটা বিশ্বে। উহানে করোনা মহামারি ছড়িয়েছে মার্কিন সেনা। এমন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বেইজিং প্রচার করার পর ওয়াশিংটনে চীনা রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়েছিল মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। খবরটি প্রকাশ করেছে, এবিপি আনন্দ। যা ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার একটি ওয়েবসাইট।
ওয়েবসাইটটি লিখেছে—টুইটারে একটি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ প্রকাশ করেন চীনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান। সেখানে তিনি চীনে করোনার ভয়াবহতার জন্য মার্কিন সেনাকে দায়ী করেন। এরপরই চীনা রাষ্ট্রদূত কুই তিয়ানকাইকে ডেকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন শীর্ষ মার্কিন কূটনীতিবিদ (এশিয়া অঞ্চল) ডেভিড স্টিলওয়েল। মার্কিন বিদেশ দপ্তরের এক আধিকারিক জানান, বিশ্বব্যাপী মহামারি ছড়ানো এবং তা গোপন করার দায় থেকে সমালোচকদের নজর ঘোরাতেই বেইজিং এই তত্ত্ব বের করেছে। তিনি যোগ করেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে দেওয়া ভীষণই বিপজ্জনক ও হাস্যকর। আমরা চীনকে জানিয়ে দিতে চাই, এসব আমরা বরদাশত করব না। এতে চীনা নাগরিক এবং সর্বোপরি বিশ্বের উপকার হবে।’
এর জের ধরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মিডিয়ায় বারবার ‘চাইনিজ ভাইরাস’ বলে উষ্মা প্রকাশ করেন। যা বিশ্লেষকেরা খুবই দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন ‘টক শো’তে।
চীনে এখন অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। গোটা উহান শহরটাকেই জীবাণুমুক্ত করছে প্রশাসন। শহরজুড়ে কাজ শুরু করেছেন সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মীরা। ছড়ানো হচ্ছে জীবাণুনাশক। শহর থেকে ভাইরাস দূরে ছুড়ে ফেলতে মরিয়া প্রশাসন। শহরজুড়ে ড্রোনের মাধ্যমে রাখা হচ্ছে নজরদারি।
কয়েক দিনের ব্যবধানে চীনের এমন সাফল্যে অবাক হয়েছে গোটা বিশ্ব। চীনের সাফল্যের পেছনে সরকারের পদক্ষেপের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল নার্স ও চিকিৎসকদের।
করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ যেখানে নিরাপদে থাকা, কোয়ারেন্টিনে থাকা কিংবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলে নিজের দায়িত্ব পালন করছেন। সেখানে চীনের চিকিৎসক-নার্সরা রাতের পর রাত জেগে বিরামহীন সেবা দিয়ে গেছেন। অক্লান্ত পরিশ্রম আর ধৈর্যের ফলস্বরূপ তারা কোভিড-১৯ পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছেন।
সাময়িক হলেও করোনাভাইরাস প্রকৃতিকে দিয়েছে কোলাহলমুক্ত একটি পরিবেশ। এই পৃথিবী সব প্রাণীর। এখানে মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য জীব-জন্তুরও সমানভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। মানুষ কি তা ভুলে যাচ্ছিল? প্রকৃতি কি মানুষকে আবার একাকিত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে, সেই জানান দিল। স্মরণ করিয়ে দিল?
এখন মানুষের ঐক্য দরকার। ব্যক্তিগত শত্রুতা পরিহার করে, সময় মানুষের পাশে দাঁড়াবার। কারণ ঘর পুড়লে উঠোনও অঙ্গার হয়ে যায়। কথাটি ভুলে গেলে চলবে না। সব দেশেই সরকারি বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয় গভীর সংকটকালে। আমাদের আসল পরিচয়, মানুষ। এই সত্যটি উদ্ভাসিত করে মানবতার কল্যাণে ব্রত থাকাই হোক আমাদের এই সময়ের প্রত্যয়।