করোনা থেকে মুক্তির প্রার্থনা

নীরব এক যুদ্ধের মধ্যে আজ গোটা বিশ্ব। যে যুদ্ধ কোন দেশের বিরুদ্ধে নয়, যে যুদ্ধ কোন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে নয়। যে যুদ্ধ নিজেকে রক্ষার, যে যুদ্ধ এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে! এই যুদ্ধের নাম করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)।
নিষ্ঠুর এই ভাইরাস কাবু করে ফেলছে পুরো আমেরিকাকে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটাই এখন দুশ্চিন্তার বিষয়।
মরণব্যাধি এই রোগে নিউইয়র্ক নগর সবচেয়ে বেশি আজ আক্রান্ত। আতঙ্ক, উৎকণ্ঠায় জনজীবন। ভালো নেই প্রবাসীরাও।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিকেলের খবরে নিউইয়র্কে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৩ হাজার ছাড়িয়েছে, মারা গেছেন ৩৮৫ জন। মৃত্যুর এই মিছিলে বাংলাদেশিরাও আছেন। ঠিক কতজন আক্রান্ত হয়েছেন, সেই তথ্য কিছুটা গরমিল থাকলেও এ পর্যন্ত নিউইয়র্কে মোট ছয়জন বাংলাদেশি করোনায় মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে ওজোনপার্কের রেহানা খাতুন, মোতাহার হোসেন, উডসাইডের মোহাম্মদ আলী, জ্যামাইকার আমিনা ইন্দ্রালিব তৃশা, ব্রুকলিনের আবদুল বাতেন ও সিলেটের মৌলভীবাজারের অজ্ঞাত একজন। 

কুইন্সের জ্যাকসন হাইটসের এলমহার্স্ট হাসপাতালের অবস্থা খুবই করুন। সর্বশেষ বুধবারের তথ্য অনুযায়ী শুধু একদিনে মারা গেছেন ১৩ জন রোগী।
হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, আমরা আক্রান্ত রোগী দেখে নিজেরাই আতঙ্কিত। ইমার্জেন্সি রুম, এমনকি ফ্লোরেও জায়গা নেই। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সংকট দেখা দিয়েছে।
এদিকে সিটি মেয়র ব্লাজিও ২৫ মার্চ বিকেলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, শহরের অর্ধেক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফেডারেল থেকে ইতিমধ্যে সাহায্য এসেছে, তবে এখনো ১ হাজার ভেন্টিলেটর প্রয়োজন।
নীরব এই ঘাতক কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক প্রাণ। মারা যাচ্ছে সব বয়সের মানুষ। নিউইয়র্ক, নিউজার্সিসহ আশপাশের রাজ্যে চলছে লকডাউন। ঘরে আটকে পড়া মানুষ প্রয়োজন ছাড়া বেরোচ্ছেন না। নগর, রাজপথ, জনপদে শূন্যতা। এ যেন চেনা শহরের এক অচেনা দৃশ্য। আতঙ্ক শুধু বাইরে আর হাসপাতালে নয়, ঘরে ফোন বেজে উঠলেই সবাই মনে করছেন, এই বুঝি কোনো দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে।
কোলাহলের নগর নিউইয়র্কে জননিরাপত্তায় নিযুক্ত এনওয়াইপিডির ২৩০ জনের বেশি কর্মকর্তা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা অন্তত তিনজন বাংলাদেশি এনওয়াইপিডি সদস্যের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছে। সবাই হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। কারও অবস্থা এখনো সংকটাপন্ন নয় বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশি মিডিয়া পাড়ায়ও করোনার হানা। নিউইয়র্কে বাংলা সংবাদমাধ্যমকর্মীরাও ভালো নেই। টাইম টেলিভিশনের অন্যতম পরিচালক সৈয়দ ইলিয়াস খসরু নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ভয়েস অব আমেরিকার নিউইয়র্ক প্রতিনিধি সাংবাদিক আকবর হায়দার কিরনের সফল অস্ত্রোপচার হয়েছে। ২৪ মার্চ রাতে ম্যানহাটনের মাউন্ট সাইনাই হাসপাতালে তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার হয়। বাংলা পত্রিকার এ বি এম সালাহ উদ্দিন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এ ছাড়া আরও তিনজন বাংলা সংবাদমাধ্যমকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৩.৩ মিলিয়ন আমেরিকায় বেকারভাতা চেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যা আগে কখনো হয়নি।
কাজকর্মহীন মানুষ তাকিয়ে আছেন সরকারি সাহায্যের আশায়। ‘লকডাউন’ ঘোষণার পর অনেকেই চাকরি হারিয়ে ঘরে গৃহবন্দীর মতো জীবন কাটাচ্ছেন। চাকরি হারানো বেশির ভাগ এবং ছোট ব্যবসায়ীরা যাঁরা বাসা ভাড়ায় থাকেন, তাঁদের মধ্যে আর্থিক চাপ অনুভূত হচ্ছে। অনেকের বাড়িতেই এর মধ্যে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে পাশে রেখে নিউইয়র্কের কিছু মানুষ বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। গ্রোসারি পৌঁছে দিচ্ছেন। অনেকই সরকারি সাহায্যের বাইরে আছেন। যাদের অভিবাসনের কাগজপত্র নেই, তাঁদের সংকট আরও বেশি। তাঁদের কোনো সরকারি সাহায্যের আশাও নেই। এর মধ্যে ভাইরাস-আতঙ্কে কাটছে প্রতিটি প্রহর।
ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে নিউইয়র্কের নিরুপায় লোকজন কেউ প্রার্থনা করছেন। প্রকৃতি কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, তা দেখার বিষণ্ন অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। মঙ্গলবার দুপুরে বেশ কয়েকজনকে নিউইয়র্কের ব্রুঙ্কস এলাকার স্টার্লিং অ্যাভিনিউয়ের সড়কপথে আজান দিতে ও দোয়া করতে দেখা গেছে। করোনার আঘাতে লন্ডভন্ড যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশিরা শুধু একটি প্রার্থনা করছেন, কবে এই নীরব মরণব্যাধি ভাইরাস থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন।