গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই

বিশ্বের যতগুলো গণহত্যা হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের ২৫ মার্চের হত্যাকাণ্ড ছিল সবচেয়ে মর্মান্তিক। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট, অন্যভাবে চিন্তা করলে বলা যায় লাইট দিয়ে খুঁজে খুঁজে বাঙালি নিধন। অপারেশন সার্চলাইটের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুরের মতো বড় বড় শহর রাতারাতি দখল করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এনে বাঙালিকে দমন করা। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু একটি রাতের হত্যাকাণ্ডই ছিল না, এটা ছিল মূলত বিশ্বসভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক, জঘন্যতম গণহত্যার সূচনামাত্র। গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর গণহত্যার একটি বলে উল্লেখ করা হয়।

এশিয়া টাইমসের ভাষ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনীর বড় বড় কর্মকর্তার নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করে, ‘তিরিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা কর, তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে।’ সেই পরিকল্পনা মতোই ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি আর্মি অপারেশন সার্চলাইট আরম্ভ করে। এই অভিযানে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ নিধন করা হয় ও সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সে লক্ষ্যে ২৫ মার্চের আগেই ঢাকা থেকে সব বিদেশি সাংবাদিককে বের করে দেওয়া হয়। সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে ওয়াশিংটন পোস্ট–এর মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন। সে রাতেই শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন।

তারপর নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ঘটনা সবার জানা। এমন একটি দিনে, এখানে আরও একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাকে এড়িয়ে যেতে হচ্ছে, যা বিতর্কিত। যেহেতু যুদ্ধ দেখিনি, সেহেতু বিকৃত ইতিহাস নিয়ে জোরালোভাবে কিছু বলা ঠিক হবে না। আর সে বিষয়টি হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার মূল ঘোষক কে? পুস্তক বলে ২৫ মার্চ রাতে আটক হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাক্ষর করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অনুপস্থিতিতে মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

তবে অন্যপক্ষের দাবি, স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়াউর রহমান। স্বাধীনতার ঘোষক যিনিই হোন, আজ জাতির সময় এসেছে এই গণহত্যার সব ঘটনার বিবরণীর সঙ্গে আগামী প্রজন্মকে পরিচয় করে দেওয়ার। বিকৃত ইতিহাস নিয়ে জাতি কতটা সফল হবেন জানা নেই, তবে ২৫ মার্চ কালরাত্রির সেই ভয়াবহ নৃশংসতা ও নয় মাস লাগাতার হত্যাযজ্ঞের বিবরণ জনসমক্ষে নিয়ে আসা সত্যিই প্রয়োজন। এই হত্যাযজ্ঞকে স্মরণ করে একটি দিবস পালন করা কেবল জরুরিই না, জাতীয়ভাবে দিনটি নির্ধারণ করে সব আন্তর্জাতিক মহলের স্বীকৃতি আদায় করাও জরুরি। আমরা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের উল্লাস করি, ঠিক আছে। উৎসবপ্রিয় মানুষ উৎসব করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জিত, তাদের ভুলে গেলে হবে না!

আর তাই কার্যপ্রণালী-বিধির ১৪৭ বিধির আওতায় ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব আনেন জাসদের সংসদ সদস্য শিরীন আখতার। ইতিমধ্যে, জাতীয় সংসদের স্বীকৃতির পর একাত্তরের ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ২০১৭ সাল থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চকে জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করা হলেও স্বাধীনতার ৪৮ বছরও এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা যায়নি। এর কারণ হিসেবে রাসেলসে আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিন জানান, যে দেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তারা ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন ওই গণহত্যার ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলে স্বীকার করে নেয়, তখনই কেবল ওই ঘটনা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বিবেচনায় আসে। একটি গণহত্যাকে তারা (আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়) যখন স্বীকার করে নেয়, সেটা সংসদের মাধ্যমেই হোক বা নির্বাহী সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই হোক, তখন বলা যায় সেটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বের দরবারে বিশ্বমানবতার অগ্রযাত্রার স্বার্থে ২৫ মার্চ গণহত্যার মতো পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন নির্ধারিত থাকা প্রয়োজন। একাত্তরের গণহত্যা, সরকারি স্বীকৃতি ত্রিশ লাখ শহীদের মহান আত্মদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। একে বিকৃত করার কোনো সুযোগ নেই।

ফুল আতশবাজিতে উল্লাস নয়, এই দিবসকে ঘিরে গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা জাগ্রত করা এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাই হতে হবে এর মূল লক্ষ্য। এই দিবসটি হবে এমন একটি দিবস, যার প্রতিবাদ, ঘৃণা ও আন্দোলনে ভবিষ্যতে শুধু বাংলাদেশই নয়, পৃথিবীর আর কোথাও কখনই এ রকম গণহত্যার ঘটনা ঘটবে না। আর তাহলেই ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্তটি পূর্ণতা পাবে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্ব ইতিহাসেও দিনটি স্বীকৃতি নিয়ে মাইলফলক হয়ে থাকবে।