আমার কাছে আসার আগেই যদি ফুরিয়ে যেত!

আমাদের স্বাধীনতার আগের কথা। অল্প বয়স। দিনকালও ভিন্ন ছিল। আমার এক সম্পন্ন দাদার বাড়িতে ভোজের আমন্ত্রণ। গ্রামবাসী আমন্ত্রিত। গরু, খাসি জবাই করা হয়েছে। চারদিকে মসলায় রান্না মাংসের সুঘ্রাণ। আমাদের পরিবার–পরিজনের জন্য আলাদা বসার আয়োজন। অল্প বয়স থেকেই প্রলেতারিয়াত হওয়ার বাসনা! বসলাম গ্রামবাসীর সঙ্গে একই শামিয়ানার নিচে।

লোকজন তৃপ্তির ভোজের জন্য মাটির সানকি পেতে দিচ্ছে। সঙ্গে আমিও। একপর্যায়ে আমার সেই সামন্ত দাদা ঘোষণা দিলেন, খাসির মাংস দ্রুত শেষ হচ্ছে। যতক্ষণ আছে, দেওয়া হবে। যারা বাকি থাকবে, তারা শুধু গরুর মাংসের ভাগ পাবে। আমার সেই দাদার কথা–ই তখন আইন। সেই সময় গরুর মাংসের খুব একটা সমাদর ছিল না। দেখা গেল, আমার পাতে আসার ঠিক আগেই বিতরণকাজে নিয়োজিত ফিরোজ মুনশি ঘোষণা দিলেন, খাসির মাংস শেষ। আমাকে গরু ভক্ষণ করেই ভোজপর্ব শেষ করতে হলো।

কিছুদিন পর দেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। স্কুল দ্রুতই খুলে দেওয়া হয়েছে। জাতির জনক সবার জন্য কম্বলের ব্যবস্থা করে নিজের কম্বল খুঁজছেন তখন। স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে জামার কাপড় এসেছে। সাদা মার্কিন কাপড় আর গোলাপি রঙের পপলিন কাপড়। আমাদের পিটি স্যার সবাইকে স্কুলের মাঠে লাইন ধরালেন। হেড স্যার কী মনে করে মাঝখানের এক লাইন থেকে বললেন, ঠিক এখান থেকে পপলিনের জামার কাপড় দেওয়া হবে। যেখানে গিয়ে শেষ হবে, সেখান থেকে লাইনে দাঁড়ানো ছাত্রছাত্রীরা সাদা মার্কিনের কাপড় পাবে। ঠিক আমার কাছে আসার আগেই পপলিন শেষ হয়ে গেল। বুকে একরাশ ব্যথা নিয়ে, কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না করেই সাদা মার্কিন কাপড় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

এ কথাটি অবশ্য অনেক পরে জেনেছি, ‘If it comes back, it is yours, if it doesn't, it never was’। যৌবনে কত সুন্দরীর দিকে ফিরে ফিরে তাকিয়ে মনে মনে লাইনটি বলেছি। করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে টানা ১৫ দিনের অবরোধের মধ্যে এসবই মনে পড়ছে!

বেশ পরের কথা, স্বৈরাচারবিরোধী সময়ে স্কপ, পাঁচ দল, পনেরো দলের আন্দোলন। পালিয়ে বেড়ানো সময়। পুলিশ আর সেনাসদস্যদের তাড়া। এর মধ্যেও আন্দোলন চলমান। মোবাইল ফোন তখনো দেখিনি। কেমন করে ঠিকই প্রতি সন্ধ্যায় এখানে–ওখানে নেতারা সভা করতেন স্থান বদল করে। এমনি এক রাতে কয়েক স্থানে হানা দিয়ে খুঁজে পাচ্ছি না, নেতারা কোথায় বসেছেন। সভা হতো রাত ৯টা থেকে। গোপন নানা আস্তানা খুঁজতে গিয়ে বেশ দেরি হয়ে গেল। রাত ১১টার দিকে সিলেট শহরের গোয়াইপাড়ার নির্দিষ্ট বাসার কাছে গিয়েই দেখি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। সভায় উপস্থিত সবাই গ্রেপ্তার হলেন। আস্তানা খুঁজে দেরি হওয়ায় নির্ঘাত গ্রেপ্তার থেকে কমিউনিস্ট নেতা ফখরুল ইসলামসহ বেঁচে গেলাম। তিনিও আমার মোটরসাইকেলে ছিলেন।

টেক্সটাইল শ্রমিকদের বিদ্রোহে পড়লাম একবার। শহরের এক আস্তানায় অনেক রাত করে তখন আমরা নাটকের মহড়া দিই। নির্দিষ্ট পথে প্রতিষ্ঠানের গাড়ি নিয়ে ফিরি। প্রতিপক্ষ চাঁদা উঠিয়ে ঘাতক ভাড়া করেছে। রেস্টহাউসে যাওয়ার পথে ব্যারিকেড দিয়েছে। তারা নির্ঘাত জানত, কোন পথে ফিরব, ফিরছিলামও।

নাট্যশিল্পী মোস্তফা কামাল বললেন, আজ ভরা পূর্ণিমা। চলো, সারা রাত বসে আমরা ভাব করব। ভাবের আড্ডায় যোগ দিলেন আরও কয়েকজন। চালককে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বললাম। সূর্য উঠলেই এভাবের আড্ডা শেষ হবে। আমাকে কেউ একজন পৌঁছে দেবেন, জানালেন।

বেচারা ড্রাইভার রফিক আক্রান্ত হলেন গাড়িসহ ওত পেতে থাকা প্রতিপক্ষের হাতে। বেঁচে গেলাম মোস্তফা কামালের ‘ভাবের’ আহ্বানে গিয়ে।

আমেরিকায় প্রথম চাকরি। তিন বছর চাকরি করে ভয়াল ১১ সেপ্টেম্বরের পরের এক সকালে তারা জানিয়ে দিল, কাজ নেই। তখন অতশত বুঝিও না। বিদায় করার সময় একটা খাম ধরিয়ে দিল। জানাল, বেশ কয়েক মাসের বেতন জমা করে দেবে আমার ডাইরেক্ট ডিপোজিটে। নতুন কেনা মার্সিডিজ গাড়ি চালিয়ে বেকার ভাতার জন্য লাইন দিতে গেলাম পরদিন। দুই সপ্তাহের মধ্যে আরেকটি নতুন কাজ পেলাম। পুরোনো কাজের জায়গা থেকে ২১ হাজার ডলার ব্যাংকে জমা হয়েছে দেখে চাকরিচ্যুতিকে উদ্‌যাপনও করলাম পরিবারসহ ইউরোপ ভ্রমণে গিয়ে।

তখন মঙ্গলবার সপ্তাহের ছুটি কাটাতাম। দরকারি–অদরকারি কাগজপত্র দ্রুত ফেলে দেওয়া আমার ঘরের আবশ্যিক কাজ হিসেবে বিবেচিত। আমি খালি মিনতি করি, ফেলে দেওয়ার আগে আমাকে একটিবার দেখিয়ে নিয়ো!

অনেক কিছুর মতোই এ কথাও কখনো গুরুত্ব পায়নি। এবারে পেল। স্ত্রী একটি পিংক রঙের খাম দেখিয়ে বললেন, এটা দেখে নাও। ড্রয়ারে অনেক দিন থেকে পড়ে আছে।

আমি পিংক রঙের খাম দেখেই বললাম, ফেলে দাও। এটা আগের কাজ থেকে চাকরিচ্যুতির কাগজপত্র!

আমি তখন গভীর মনোযোগে ডায়াল আপ কানেকশনের ইন্টারনেটে দেশের পত্রিকা পড়ছিলাম। এমন মনোযোগ যখনই কোনো কাজে থাকে, তখন তা থেকে ফেরানোর জন্য নানা জটিল কাজের ফরমাশ আসে। যেমন ধনেপাতা নেই, কাঁচা মরিচের স্টক শেষ হয়েছে সেই কবে!—এসব ‘জনগুরুত্বপূর্ণ’ বিষয় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন!

এমনি এক ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কাজের আভাস আসছে দেখে আমি পত্রিকার সবচেয়ে দুঃসংবাদের নিউজটি পড়ে শোনালাম, ‘দেশে ফেরি দুর্ঘটনায় ১২ জনের সলিলসমাধি’।
মনে করলাম, বড় দুঃসংবাদের নিউজটি ছোট কোনো পাঁয়াতারাকে ভাসিয়ে নেবে!
না, তা–ও সব সময় হওয়ার নয়!

দেশে এমন ঘটনা প্রতিবছর ঘটে! কবে যে এসব বন্ধ হবে! দেশের চিন্তা বাদ দাও, খামটির ভেতরের কাগজপত্র দেখে দাও! ড্রয়ারটা পরিষ্কার করেই রেডি হতে হবে। প্যাটেল ব্রাদার্সে আজ যাওয়া খুব জরুরি। ঘরে কোনো ডাল নেই!

গোপালের কপাল!

অনিচ্ছা সত্ত্বেও খামটি হাতে নিলাম। ভেতরের কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে অন্য কোনো বুদ্ধি বের করতে পারি কি না, তার চেষ্টা করলাম। এ কাজে বেশ দক্ষতা থাকলেও তত দূর এগোনোর আগে খামের মধ্যে একটি কাগজে চোখ আটকে গেল। সেখানে আমার আগের কোম্পানির (যেখান থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে) একটি কাগজে লেখা একটি নোট। আমাকে বিদায়কালীন কোম্পানির এক হাজারটি শেয়ার দেওয়া হয়েছে! কোম্পানি চলছে না বলে ঘাড়ে ধরে বিদায় করেছে, তার আবার শেয়ার! তা ছাড়া ‘শেয়ার–ফেয়ার’ নিয়ে আমি কখনো কোনো খেলা করিনি। কাগজে তেমন কিছু লেখাও নেই কোথাও। একটা ‘এইট হান্ড্রেড’ নম্বর দেওয়া আছে।

বুদ্ধি বের করার জন্য আমি তখনো সময় নিচ্ছি। নেহাত খেয়ালের বসে এইট হান্ড্রেড নম্বরে ফোন করলাম। কিছু ব্যক্তিগত তথ্য দিতেই জানানো হলো, আমার কাছে থাকা এক হাজার শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্য ৩৫ হাজার ডলার। ইচ্ছে করলে রাখতে পারি, ইচ্ছে করলে বিক্রি করে দিতে পারি।

স্পিকার ফোনে মিউট বাটন চেপে পরামর্শের জন্য আশপাশে তাকাতেই ঘরের ওপর থেকে ইঙ্গিত, যা পাও নগদ করে নাও। তা দ্রুত কেমনে ব্যয় করা যায়, তার ব্যবস্থা আমি করব।

বলতে ভুল করলাম না, দ্রুত অর্থ ব্যয়ের কাজে তোমার জুড়ি নেই!

শেয়ার বিক্রি করে ফুরফুরে মেজাজে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি। পাশের ব্লকেই দেখা গেল, এক বাড়ির মালিক বাড়ি বিক্রির সাইন ঝুলিয়েছে।
–চলো এ বাড়ি দেখি।
–বাড়ি দেখবে কেন? আমাদের তো বাড়ি আছে।
–দেখছ না, একদম সিলেটের পুরোনো বাড়ির মতো। কী সুন্দর বারান্দা দেওয়া বাড়ি! এই এলাকায় আর একটাও এমন নেই। চলো কিনে ফেলি। পুরোনোটা ভাড়া দিয়ে দেব।

হুজুগে চলা মানুষ আমি। তাই করলাম। তিন দিন পরে শেয়ার বিক্রির চেক এল মেইলে। তা দিয়ে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে দিলাম। নতুন বাড়িতে যেদিন পাড়ি দিচ্ছি, সেদিনই খবর পেলাম, পুরোনো কোম্পানি দেউলিয়া হয়েছে। শেয়ারের মূল্য শূন্যে নেমে গেছে। তিন সপ্তাহ আগে শেয়ার বিক্রি না করলে কিছুই পেতাম না।

এরপর ১৪টি বসন্ত চলে গেছে!

নিউজার্সির প্রান্তিক এক শহরে, বাড়ির ঝুল বারান্দায় বসে আছি। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে টানা ১৪ দিন গৃহবন্দী। একের পর এক আক্রান্তের খবর আসছে! ঘরে ছেলেমেয়ে, স্ত্রী—কারও মুখে হাসি নেই! অজানা আতঙ্ক তাড়া করছে আমেরিকার লোকজনকে। টিভির খবরে বলছে, আমেরিকার বহু লোক মারা যাবে! অধিকাংশ লোক আক্রান্ত হবে। সমস্যা বাড়ছে। সমাধান কারও জানা নেই!

ভাবছি, আমার তল্লাটে আসার আগেই যদি শেষ হয়ে যায়!

হতেও তো পারে! এমনি কত কিছুই তো আমার কাছে, আমাদের কাছে আসার আগেই চলে গেছে অন্যের কাছে! অন্যদের কাছে!
কত কিছু আমার কাছে আসার আগেই ফুরিয়ে গেছে!

*ইব্রাহীম চৌধুরী, নিউজার্সি। [email protected]