করোনাভাইরাস: নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে

করোনাভাইরাস মহামারির কেন্দ্রস্থল এখন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস মহামারির কেন্দ্রস্থল এখন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে করোনা রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ছবি: রয়টার্স

কোভিড–১৯ ভাইরাসের আক্রমণে সমগ্র বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। মৃত্যুর ভয় ও অজানা তথ্যের জন্য মানুষ দিশেহারা। এই দুঃসময়ে চীন, ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং সর্বশেষে আমেরিকার, বিশেষ করে নিউইয়র্কের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় তথ্য আলোচনা করা জরুরি।

নিউইয়র্কের শতকরা ৪০ ভাগ করোনা রোগী যে হাসপাতালে যায়, তার ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের একজন চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা শুনে এবং ফিলাডেলফিয়ার সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী যে হাসপাতালে আছে, সেখানে কর্মরত থাকার কারণে গত তিন সপ্তাহে এই রোগ সম্বন্ধে কিছু স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছে।

কোভিড–১৯ করোনা সাধারণ ফ্লু ধরনের ভাইরাস। তবে আগে কোনো দিন মানুষের শরীরে এটিকে দেখা যায়নি। শরীরের প্রতিরোধ সিস্টেম অতিরিক্ত শক্তি নিয়ে এটাকে আক্রমণ করতে গিয়ে ফুসফুসের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করতে পারে।

মানুষ ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে কোভিড–১৯ রোগে আক্রান্ত হয়। তবে আক্রান্ত হলে এবং ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে কিছুদিনের মধ্যে সামান্য শরীরের অস্বস্তিকর অনুভূতি, কিছু হালকা মাথাব্যথা ও কাশি থাকতে পারে। তারপরে এমনিতে ভালো হয়ে যায়। সম্পূর্ণ ভালো হতে ৫, ৭ অথবা ১৫ দিন লাগতে পারে। যাঁরা ভালো হন না, তাঁদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এবং তাঁদের অনেকে বাসায় থাকলেও শ্বাসকষ্ট কমে যায়। না কমলে তাঁদের হাসপাতালে যেতে হয় অক্সিজেন নেওয়ার জন্য এবং তাঁদের যদি আরও খারাপ অবস্থা হয়, তখন ভেন্টিলেটরের সাহায্য লাগে। তবে ১০ থেকে ১২ দিনে অনেকেই ভেন্টিলেটর থেকে ভালো হয়ে যাবেন আর ১ থেকে ২ শতাংশ মারা যাবেন। তাই আজকাল নিউইয়র্কে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর, কাশি, দুর্বলতা, গায়ে ব্যথা হলেও শ্বাসকষ্ট না হলে হাসপাতালে ভর্তি না করে ইমার্জেন্সি রুম থেকেই বাড়িতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

কীভাবে করোনা মানুষের মধ্যে ছড়ায়, তা এখন মোটামুটি পরিষ্কার। যাদের করোনা হয়েছে অথবা যাদের ভেতরে জীবাণু ঢুকেছে কিন্তু জ্বর বা কাশি নেই, তাদের সঙ্গে (অথবা তাদের ছোঁয়ার) ১৫ থেকে ২০ মিনিটের সময়ের সংস্পর্শে থাকলে তা সংক্রামক হতে পারে। মনে রাখতে হবে, ভাইরাস বাতাসে ছড়ায় না। এটা কাশির সিক্রেশন ড্রপলেট থেকে একমাত্র হাত অথবা মুখ, নাক ও চোখের মধ্য দিয়ে ৯৯ ভাগ সময়ে মানুষের শরীরে ঢোকে। খুবই সামান্য অংশ যখন ভেনটিলেটারে থাকা রোগীকে সাকশন দেওয়া হয়. তখন কাছের বাতাসে ছড়ায়। তা থেকে কাছের চিকিৎসক ও নার্সদের নাকে ঢুকতে পারে, এ জন্য শুধু এই পরিস্থিতিতে পূর্ণ পিপিইসহ মেডিকেল মাস্ক অথবা এন৯৫ মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।

এ জন্য করোনা প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে: ১. আপনার হাত সব সময় কোথায় আছে জানুন এবং পরিষ্কার রাখুন। সেই জন্য বাইরে কিছুতে হাত দিলে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখুন। ২. অসাবধানতাবশত হাত যেন নাকে, চোখে বা মুখে না ছুঁতে পারেন, সেই জন্য বাইরে গেলে মাস্ক পরে থাকতে হবে। মাস্কটা পরা হয় কিন্তু অন্য কারও থেকে ভাইরাস সংক্রমণ না করার জন্য নয়, মাস্কটি পরতে হয় নিজের হাতের ছোঁয়া থেকে নিজেকে সংক্রমণ না করার জন্য। তবে খুব কাছে থেকে কেউ জোরে কাশি দিলে, তা–ও মাস্ক সেই ড্রপলেট ঠেকাতে পারবে। সে কারণে এই মাস্ক সাধারণ মাস্ক হলেই চলবে, মাস্ক না পেলে রুমালও ব্যবহার করা যাবে। কয়েকটা মাস্ক থাকলে তা গরম পানিতে সাবান দিয়ে ধুয়ে আবার ব্যবহার করা যাবে। ৩. সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ভীষণ জরুরি। সব রকমের ভিড় এখন পরিহার করতে হবে। আপাতত নিজেদের পরিবার বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে একটি ছোট্ট পরিধি তৈরি করে থাকতে হবে। বাইরে হাঁটাচলা করা ভালো, তবে তা অবশ্যই ভিড় এড়িয়ে। দৈনন্দিন মানবিক ব্যবহার, প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেওয়া, কেউ বিপদে পড়লে তাকে ধরে সাহায্য করা সবই চলবে, তবে হাত ধোয়ার আগে নিজের হাত মুখে লাগানো যাবে না।

দেখা গেছে, ১৪ বছর পর্যন্ত বয়সীদের এটি অনেক কম হয়। এখন পর্যন্ত শুধু একজন নবজাতকের হয়েছে। কেন হয়েছে তা জানা যায়নি। তা ছাড়া সব বয়সেরই হচ্ছে। তবে বেশি বয়স্ক ও অন্যান্য রোগ থাকলে তাদের কিছুটা জটিল আকার ধারণ করছে। প্রথমে নার্স ও চিকিৎসকের জন্য এটি একটি ভীষণ ভয়ের ব্যাপার ছিল। এই পেনডেমিকের সময় নিউইয়র্কে অনেক চিকিৎসক না বুঝে কোনো সুরক্ষা না নিয়ে সর্দি–কাশি–জ্বরসহ অনেক রোগী দেখেছেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে অনেকেই কোভিড–১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকেই তাই বাড়িতে কোয়ারেন্টিনে আছেন। তবে ভালো খবর হচ্ছে, এই প্রতিরোধ গ্রহণ করার ফলে তার পরে গত তিন সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরা অনেক কম আক্রান্ত হয়েছেন।

নিউইয়র্কের এই অভিজ্ঞতায় চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে সংক্রমণের ভয়ভীতি অনেক কমে যাচ্ছে। চিকিৎসক যখন জানবে হাত থেকে মুখের স্পর্শটাই ছড়ানোর আসল কারণ, তখন চিকিৎসা দিতে তাদের আর কোনো ভয়ের কারণ থাকবে না। অনেকে পিপিই নিয়েও না পরায় বেশ চিন্তিত, এমনকি পিপিই কী দিয়ে বানাতে হবে, সেটা নিয়েও ধারণা নেই। কারণ, এ পরিস্থিতি একেবারেই নতুন এবং এটাই স্বাভাবিক। পিপিই থেকে বেশি জরুরি হচ্ছে মাস্ক পরা আর হাত পরিষ্কার রাখা। পিপিই শুধু হাসপাতালে আইসিইউতে অথবা জানা রোগীর আইসোলেশনে কক্ষে পরে যাওয়া উচিত। যেখানে সন্দেহ আছে এবং টেস্ট হয়নি, সেখানেও পরতে পারেন, তবে হাতের ছোঁয়া মুখে না লাগা জরুরি। এ জন্য উপসর্গ মিললে কোভিড–১৯ টেস্টটা শিগগিরই করে ফেলা ভালো।

সাধারণত পিপিইগুলো পাতলা ও কাগজের মতো ফেব্রিক দিয়ে তৈরি থাকে এবং আমরা আমেরিকায় তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অহরহ ব্যবহার করে আসছি। শুধু অপারেশনের গাউনগুলো মোটা হয়। কারণ যেন রক্ত শুষে চিকিৎসকের শরীরে প্রবেশ করতে না পারে। একবার ব্যবহার করে এগুলো ফেলে দেওয়া হয়। তবে গত কয়েক বছর হলো অনেক হাসপাতালে পয়সা বাঁচানোর জন্য বারবার ব্যবহার করা যায় বলে কাপড়ের পিপিই ব্যবহার করছে। কাপড়ের পিপিইগুলো অনেক ভালো। কারণ, এগুলো ধুয়ে বারবার ব্যবহার করা যায় এবং সেটা যেকোনো কাপড়ের হলেই চলবে।

তাই কী কাপড়ের পিপিই হবে, সেটা নিয়ে বিতর্ক করে সময় নষ্ট না করে শিগগিরই প্রচুর সংখ্যায় পিপিই তৈরি করে সবখানে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। সবচেয়ে প্রয়োজন কোভিড–১৯ টেস্টের সুবিধা শিগগিরই দেশের সবখানে ছড়িয়ে দেওয়া। তাতে মানুষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। পর্যাপ্ত কিট সরকারের কাছে না থাকলে বিভিন্ন সংস্থা ও প্রবাসী মানুষের সহযোগিতা ও অর্থে বিভিন্ন জেলায় শিগগিরই তা ব্যবস্থা করা যাবে। সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সরকার জনগণ ও চিকিৎসকদের মধ্যে নির্ভুল তথ্য সরবরাহ করা। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই দুঃসময়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর প্রতিকার করা দরকার।

দেশে তথ্যের অভাবে অহেতুক ভয়ে প্রবাসীদের প্রতি অত্যন্ত অমানবিক ব্যবহার করা হয়েছে। এটি মেনে নেওয়া যায় না। আমার ধারণা ছিল, আমাদের বড় শক্তি হচ্ছে দেশপ্রেম এবং মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসা। একটি তুচ্ছ করোনা আমাদের পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। আশা করি, আবার চিকিৎসকেরা রোগী দেখবেন, আবার গরিব ও বেকার মানুষের অন্নসংস্থানের জন্য সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসবে, পুলিশ আর সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মানবতার সঙ্গে মানুষের পাশে থাকবে। আশা করি, মুজিব বর্ষের সম্মানে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর শহীদদের আত্মত্যাগ নিয়ে গর্বিত হবে। এই ক্রান্তিলগ্নে প্রধানমন্ত্রীর পরিচালনায় এই বিপদ থেকে উত্তরণের জন্য তারা সহযোদ্ধার ভূমিকায় অংশ নেবেন।

ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ: অধ্যাপক, মেডিসিন ও নেফ্রোলজি, টেম্পল ইউনিভার্সিটি, ফিলাডেলফিয়া এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক, ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটি