মানবিকতার রকমফের!

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

কাজে যাচ্ছি না তিন সপ্তাহ। রে কেনেডি আমার বস। একদম টিপিক্যাল আমেরিকান। নানা কায়দায় কাজ করিয়ে নেবে একদম নিপুণ কারিগরের মতো। পুঁজিবাদের প্রতিভূ আমেরিকানদের এ কাজে কোনো জুড়ি নেই। নিজে কাজ করবে পাগলের মতো। অন্যদেরও কাজ করিয়ে ছাড়বে। হাসিমুখে থাকবে। পুঁজিবাদের সমস্ত নিষ্ঠুরতা বুকে ধারণ করেও মানবিকতা নিয়ে উচ্চকণ্ঠ সব সময়।

অন্যরা বিভ্রান্ত হয়। আমি হই না।

ইউনিটের সবচেয়ে কাজের লোক হিসেবে টানা এক যুগ আমাকে দেশ সেরা কর্মীর ‘পদক’ দিয়েছে। পিঠ চাপড়ে কাজ করানোর এসব আয়োজন ব্রিটিশরা করেছে। ২০০ বছরের গোলামি আমাদের! নানা উপাধি দিয়ে, পদবি দিয়ে কাজ করানো। বাজার অর্থনীতির এসবের পাতা ফাঁদ এখন ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনে।

কোনো নতুন লোককে কাজ দিলে শুরুতেই ডাক পড়ে। আমাকে দেখিয়ে নতুন লোককে যখন বলে, এই ইব্বির মতো এমপ্লয়ি হতে হবে তোমাকে!

বিগলিত হই না। কৌশলটা আমার জানা বলেই বিভ্রান্ত হই না। অন্যরা সহজেই হয়। ফাঁদে পড়ে।

প্রতিদিন আমি কাজে যাওয়ার আগেই স্টারবাক্সের কফি এগিয়ে নিয়ে আসে। নিজের জন্য একটা বড় সাইজের কিনতে গিয়ে আমার জন্য ‘গ্র্যান্ডে’ সাইজের একটা। দুধ–চিনি ছাড়া এ বস্তু আমাদের কাছে নেশার মতো। সারা দিন কাজের জোগান চলে আসে।

প্রতিষ্ঠানের কেউ কাউকে দেখতে পারে না। আমি নিজেও কতটা পারি, তা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না।

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

তো আমি যা বলতে পারি। অন্য কেউ পারে না। প্রায়ই প্রকাশ্যে বলি, রে, তুমি যে আমার প্রশংসা কর। প্রতিদিন কফি দিয়ে ট্রিট করো। কেন?

: বিকজ আই লাভ ইউ, ইব্বি!

: একদম বাজে কথা! তুমি আমাকে বোকা মনে করো। আমাকে দিয়ে খাটাও বেশি করে। এ প্রতিষ্ঠানের অন্য কেউ সময়ে সময়ে বিনা বাক্যে তোমার নির্দেশ পালন করে না। করার দরকারও নেই। তুমি কাউকে বাধ্য করতে পারো না। আমি যে কেন করি, তা নিজেও জানি না! জীবন আমাকে যন্ত্র বানিয়ে দিয়েছে বলেই হয়তো। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে তুমি নিজেও পছন্দ করো না। বায়বীয় কিছু পদক দেওয়া ছাড়া আমার বেতন, বোনাস বা কোম্পানি থেকে আমি অন্য যেসব আর্থিক সুবিধা পেতে পারতাম, তা নিয়ে তুমি কখনো কিছু বোলো না!

: ইব্বি, প্রশ্নহীন কাজ করে যাওয়ার জন্য তোমার মতো মাল্টিটাস্কিং কাজের লোক আমি কর্মজীবনে দেখিনি।

আমি স্রাগ করেই কাজে নেমে পড়েছি। এসব বায়বীয় কথায় আমাদের কিছু যায়–আসে না। যন্ত্রের মতো আমি কাজ করি। রে নিজেও তেমনি করে। আমাদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া!

ভুল করলেও রে নিজের কাঁধে তুলে নেয়। বলে, আমি নিজে হলেও এমন ভুল করতাম!

এমন পরিস্থিতিতে আমি বিব্রত হই বেশি করেই।

রে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট। সত্তর দশকে আমেরিকায় বাম রাজনীতির যে ঢেউ ছিল, সেখানে তাঁর বিচরণ ছিল। আমার সহকর্মী জর্জের মতে, পুঁজিবাদের উষ্ণ বাথটাবে একবার যে বামপন্থী স্নান করেছে, সে বদলে গেছে পুরোটাই। এদের সংজ্ঞায়িত করার যোগ্যতা তোমার নেই ইব্বি বলে জর্জের টিপ্পনী আমাকে শুনতে হয় প্রায়ই।

রে দিনে ষোলো ঘণ্টা কাজ করে। তার কোনো পরিবার আছে কি নেই, কেউ জানে না। এ নিয়ে নিজেকে কখনো কথা বলতে দেখি না। একজন মানুষ বছরের পর বছর এমনি করেই কাজ করে যাচ্ছে। বছরে একবার ছুটিতে গেলেও বাসায় থাকে। ফোনে আমাদের জ্বালাতন করতে ছাড়ে না। কার্যত ভ্যাকেশন বলে তার কিছু নেই। কাউকে বিশ্বাস করেন না। তার সর্বজনস্বীকৃত প্রিয় কর্মচারী, আমাকেও না। যদিও সবাই জানে আমাকে বিশ্বাস করে কর্মের দেশ আমেরিকার কর্মপাগল রে কেনেডি।

করোনাভাইরাসের বন্দী সময়ে রেকে তিন সপ্তাহ হয় ফোনও করিনি। এ সপ্তাহান্তে ফোন করে জানতে চাইলাম, আমি কি আসব?

জানতাম, কাজে যাওয়ার আকুতি জানাবেন।

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

এই প্রথমবারের মতো তাঁকে ভিন্ন উত্তর দিতে দেখলাম।

: ইব্বি, আমি নিজেই কাজে যাচ্ছি না। আমি যেখানে যাচ্ছি না, সেখানে তোমাকে যেতে বলতে পারি না। ঘরে থাকো। ঘর থেকে কাজ দেখো!

বললাম, জর্জের কথা তাহলে ঠিক নয়!

: অকর্মণ্য জর্জ আবার কী বলেছে?

: বলেছে, পুঁজিবাদের তল্পিবাহকদের মানবতা বলে কিছু নেই। এরা নিজেদের বিপদে ফেলে তোমাকে দিয়ে কাজ উদ্ধার করাবে। সঙ্গে সুন্দর দেখে একটা মানবিকতার ভুয়া বাণী ধরিয়ে দেবে!

রে হাসে!

জর্জ যে অকর্মণ্য, কথাটি আবার উচ্চারণ করে রে আমার মঙ্গল কামনা করে, ফোন ছেড়ে দেয়।

জর্জকে ফোন করি। জানা গেল, রে নাকি আগেই ফোন করে জর্জের খবর নিয়েছে! করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে শুধু আমেরিকার সাধারণ কর্মজীবী নয়! ছোট–বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও মাত্র দুই সপ্তাহে মুষড়ে পড়েছে। কেউ জানে না, কী হবে!

ট্রিলিয়ন ডলারের ফেডারেল সহযোগিতার বড় অংশ যাবে এসব কোম্পানিতে। কিন্তু কখন কীভাবে এসব হবে, তা নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারছে না।

আমেরিকার হয়ে একাধিক যুদ্ধে লড়েছেন জর্জ ওয়াকার। সুযোগ পেলেই আমেরিকার অমানবিক সব কাজের সমালোচনা করেন। জর্জ বললেন, দেখেছ সংকট মানুষকে কীভাবে মানবিক করে তোলে! রের মতো বসও আজ কতটা সহনশীল। আমেরিকার মতো স্বেচ্ছা–লড়াইয়ের দেশেও সরকার আজ কতটা মানবিক। লুটপাট আর শোষণ করে জমানো অর্থ আছে বলেই এসব করা যাচ্ছে। জর্জ বলছেন, জমানো এ অর্থ আবার বণ্টন করা হবে। আবার শ্রমজীবী, কর্মজীবী মানুষের ওপর থেকে এ অর্থ উঠিয়েও নেওয়া হবে। আমেরিকার মতো দেশ অন্য কিছু না পারলেও এ কাজটি আমরা করতে পারব।

আমি নিজের, পরিবারের, চাকরি দুশ্চিন্তার কথা বলি।

জর্জ আমাকে বাংলাদেশের খবর জিজ্ঞেস করেন। আমি জানাই।

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

জর্জ বলেন, হয়তো তোমরা বুঝতেই পারছ না, বিপদ কী পরিমাণের। অথবা এমনও হতে পারে তোমাদের দেশের লোকজনের শরীরে যেকোনো কারণেই হোক এসব ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে আগে থেকেই। যদি এমন হয়, আগামী সভ্যতা তো তোমাদের ইব্বি! আমরা কত লোক মারা যাব, এ নিয়ে হিসাব কষতে আমার আর ভালো লাগছে না!

জর্জের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে। আমি অমূলক কিছু কথা বলে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি।

বলি, জর্জ এবারে একটা কৌতুক শুনিয়ে পানাহারে বসে পড়ো। উইশ করো, যেন বেঁচে থাকি সবাই!

জর্জ তাঁর ঘরে কী কী পানীয়ের মজুত আছে, তাঁর একটা বিবরণ দিলেন। নিজেই কীভাবে ঘরে বসে ‘লং আইল্যান্ড আইস টি’ বানাতে পারা যায়, তার ফর্মুলা বলতে বলতে কাজে নেমে পড়লেন মনে হলো। পানি ঢালার শব্দ শোনা গেল।

: ও হ্যাঁ, আজকের দিনে একটা সহমর্মিতার গল্প বলে নেওয়া যাক!

জর্জ শুরু করে দিলেন, আমেরিকায় এ মৌসুমে প্রচুর লোক ছুটিতে যায়। নানা কোম্পানি এখানে–ওখানে স্থায়ী তাঁবু বসিয়ে ছুটির প্যাকেজ বিক্রি করে। পাঁচ তারকা হোটেল, গলফ ক্লাব, সি বিচ—যত সব আকর্ষণীয় আহ্বান।

নিউজার্সিতে আমাদের প্রান্তিক শহরটিতে যেন বুড়ো–বুড়িদের বাস। বেরোলেই দেখা যায়, বুড়ো–বুড়ির হাঁটাচলা। ছুটির সময়ের মূল খদ্দের তো এরাই। জীবনের সব সঞ্চয় এরা বুড়ো বয়সে ব্যয় করে। আমার বস রের মতো যারা জীবনে এক দিনও কর্মহীন থাকেনি, তাদের অঢেল অর্থ জীবনের শেষ বেলায়! ভ্যাকেশনে গিয়ে, নানা ফন্দিফিকির করে এসব লোকজন জীবনের শেষবেলা উপভোগ করতে চায়।

কারও কারও তেমন সঞ্চয় থাকে না। শখ থাকে। ভ্যাকেশন প্যাকেজ বিক্রির এক তাঁবুতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বয়সে আশি পেরোনো এক দম্পতি। কয়েক দফা কথাবার্তা বলে বিক্রেতা ব্যবসায়ীর মনে হলো, এ বুড়ো দম্পতির এমন ভ্যাকেশনের ব্যয় সামাল দেওয়ার সামর্থ্য নেই। পুঁজিবাদী অনুকম্পা জেগে ওঠে ব্যবসায়ীটির মনে। নিজের মা–বাবা কারখানার শ্রমিক ছিলেন। জীবনসায়াহ্নের আগে মায়ামি বিচে বেড়াতে যেতে চেয়েছিলেন। অর্থাভাবে পারেননি।

ব্যবসায়ীটি প্রবীণ দম্পতিটিকে বললেন, যেখানে যেতে চাও, পছন্দ করো। আমি তোমাদের ফ্রি প্যাকেজ দিচ্ছি।

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

এমন উদারতা দেখে ভ্রমণে যাওয়ার জন্য মরিয়া দম্পতিটি আপ্লুত। খুশিতে কেঁদে ফেললেন। তাঁরা মৃত্যুর আগে একবার মায়ামি বিচে কিছু সময় কাটাতে চান! কথাটি শুনে ব্যবসায়ীটি আরও আপ্লুত। নিজের মা–বাবাও এমনি চেয়েছিলেন! প্রবীণ দম্পতির নারী সদস্য মেরি। তাঁকে পুরো প্যাকেজ দিয়ে, বুকিং দিয়ে বিদায় দিলেন। যাওয়ার আগে মেরি আর তাঁর অশীতিপর স্বামী জড়াজড়ি করে উষ্ণ আলিঙ্গন দিলেন ব্যবসায়ীকে। নিজের মহানুভবতার আনন্দে চোখে জল এসে গেল বেনিয়া প্যাকেজ বিক্রেতার!

১৫ দিন থেকে ঘরে বসা ব্যবসায়ীটি। এবারে আর ব্যবসা–ট্যাবসা হবে না। কীভাবে ব্যবসায়ীদের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণা থেকে অর্থ পাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবছেন। ভালো কাজ নিজের মধ্যে নানাভাবে ফেরত আসে বলে মনে করেন। মনে পড়ছে, অল্প হলেও ভালো কাজ করেছেন জীবনে। এর মধ্যেই মনে পড়ল, সম্প্রতি বয়স আশি পেরোনো মেরি দম্পতিকে ফ্রি মায়ামি পাঠিয়েছেন। ইচ্ছে হলো, মেরির খোঁজ নেওয়া যাক।

: হ্যালো মেরি, ভ্যাকেশন কেমন চলছে?

: সব ভালো। চমৎকার আবহাওয়া! একটাই সমস্যা!

: মেরি, বলো কী সমস্যা?

: হোটেল রুমে রাতে আমাকে এক হুঁশ–বুদ্ধি ছাড়া বুড়োর সঙ্গে বিছানা শেয়ার করতে হচ্ছে। লোকটা কে? তুমি পাঠিয়েছ?

: হ্যাঁ, মেরি, উনি তো তোমার স্বামী জন। আমি দুজনকেই টিকিট দিয়েছি। তবে এখন সোশ্যাল ডিসট্যান্স মেনটেইন করো। আমি হোটেলে বলে দিচ্ছি! আলাদা বিছানার ব্যবস্থার জন্য আমি আপগ্রেড করে দিচ্ছি!
: ও, ও হো, আমি সরি, জন হলে ঠিক আছে! বয়স হয়েছে তো! সব মনে রাখতে পারি না!

—এই দুঃসময়ে আমি হাসার চেষ্টা করি।

জর্জের কণ্ঠস্বর এর মধ্যেই বদলে গেছে। বলেন, তোমাকে হিটলারের মানবিকতার কথা বলেই ফোনটা ছেড়ে দিচ্ছি। ককটেলটা কিক করতে শুরু করেছে!

অ্যাডলফ হিটলার অধূমপায়ী ছিলেন। নিরামিষভোজী ছিলেন। ছিলেন ধূমপানের বিরুদ্ধে। নিজের বন্ধুদের ধূমপান পরিহারের আহ্বান জানাতেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিলে ধূমপান ছেড়ে দেওয়া বন্ধুদের স্বর্ণের ঘড়ি উপহার দিতেন হিটলার। তাঁর এ মহানুভবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হিটলারের অনেক বন্ধুই অধূমপায়ী হয়েছেন!

চলমান সভ্যতার সবচেয়ে বড় স্বৈরাচার অ্যাডলফ হিটলার পশুপ্রেমীও ছিলেন। পশ্চিমে তখনই পশু অধিকারকর্মীরা পশুর মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। হিটলার প্রকাশ্যে পশু নিধনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। বক্তৃতা দিয়েছেন। পশু নিধনের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করেছেন। অতঃপর ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করে ইতিহাসের ভয়ংকর নরঘাতক হিসেবে কুখ্যাত হয়েছেন!

ইব্রাহীম চৌধুরী: নিউজার্সি। ২৮ মার্চ ২০২০
[email protected]