শরণার্থী : অতীত থেকে বর্তমান

মিয়ানমারের লাখ লাখ রোহিঙ্গা এখন ভিটেমাটিহীন উদ্বাস্তু। জীবন বাঁচাতে খুঁজে চলছে আশ্রয়, শরণার্থী হয়ে এদের অধিকাংশই এখন আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। শরণার্থীদের পূর্বাপর ইতিহাস আর রোহিঙ্গা কবির কবিতা দিয়ে সাজানো এই সংখ্যাটি সমস্ত নৃশংসতার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ

ছবিতে শরণার্থীদের িদনযাপন। ছবি: সৌরভ দাশ
ছবিতে শরণার্থীদের িদনযাপন। ছবি: সৌরভ দাশ

মানুষ যেখানে জন্মায়, ঠিক সেই জায়গাটাই তার অস্তিত্বের কেন্দ্রে থাকে। সেখান থেকে সে কিছুতেই বিচ্যুত হতে চায় না। অথচ প্রতিনিয়ত জনপদগুলো সরে যায়, স্থানচ্যুত হয়, কেন্দ্রচ্যুত হয়। তবু মানুষ তাঁর জন্মভূমিকেই নিজস্ব অস্তিত্বের কেন্দ্র বলে জানে। এই বন্ধন আমৃত্যু-আজীবন স্থায়ী হয়। কাজেই মানুষের সভ্যতার উন্মেষকাল পর্যন্ত আমাদের এই গ্রহের প্রাকৃতিক পরিবর্তন যেমন ঘটেছে, মানুষের সভ্যতার কেন্দ্রগুলোও তেমনি বদলে গিয়েছে। আমি যেভাবে কথাগুলো লিখলাম, তাতে মনে হতে পারে সময়কে ভাগ ভাগ করে যেন মানুষের সভ্যতা এবং তার কেন্দ্রগুলোর পরিবর্তন ঘটে। এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তন হচ্ছে। সেই পরিবর্তন ইন্দ্রিয়গোচর হওয়ার বহু আগে থেকে একটানা ঘটেছে।

যদি পৃথিবীর মানবসভ্যতার উন্মেষকাল থেকে বর্তমান অব্দি সংঘটিত তাবৎ ঘটনাকে একটা কার্পেটের মতো আমরা মেঝেতে বিছিয়ে দিয়ে দেখতে পারতাম, তাহলে নির্ঘাত নজরে পড়ত কেমন করে তার ওপরে ছকগুলো বদলে বদলে যাচ্ছে। তা এই বদল কি লাফ দিয়ে দিয়ে ঘটে, না টানা ঘটে? হেরোক্লিটাস যে বলেছিলেন একই নদীতে দুবারœস্নান করা যায় না—প্রথমে কথাটা বুঝতে কষ্ট হয়। সময় টানা চলে বলে আমাদের মনে হয়। কিন্তু টানা সময়কে আমরা কখনোই ধরতে পারি না। আমরা তাকে মুহূর্তে মুহূর্তে ভাগ করি। কিন্তু ভাগ যে করি, সেটা কখনোই বুঝতে পারি না। জনবসতির যে নিয়ত বদল ঘটছে, সে-ও অনেকটা এই রকম। নীরবে-নিভৃতে তার জনসমুদয়ের চলাচল, বলপূর্বক উচ্ছেদ কি পেটের বা মনের জ্বালায় স্বেচ্ছানির্বাসন। নিজের জন্মগ্রামটিকেও মাত্র দু-এক দশকের মধ্যেই আর ঠিক আগের মতো দেখা যায় না। কখন এই বদলগুলো ঘটেছে, তা কিছুতেই প্রত্যক্ষ হওয়ার নয়।

আবার অন্যদিক থেকে কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিট স্থায়ী একটি বড়সড় ভূমিকম্প হয়ে গেলে পৃথিবীর উপরিভাগ লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। মানুষ যেহেতু এই উপরিভাগেই বসবাস করে, সে জন্য তার নিরন্তর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থিত হওয়া বিচিত্র নয়। মানুষ ভাগও হয়েছে এই প্রক্রিয়ার ফলেই।

টেকনাফ সীমান্ত িদয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে প্রবেশ। ছবি: সুমন ইউসুফ
টেকনাফ সীমান্ত িদয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে প্রবেশ। ছবি: সুমন ইউসুফ

একটা হিসেবে তো সবাই শরণার্থী—এমন কথা অত্যুক্তি বলে বিবেচিত হবে না। হয় আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে বা অভিবাসী হিসেবে বা হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য Ñএকেকটি জনগোষ্ঠীকে তাদের স্বভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন-বিচ্যুত হতে হয়। পৃথিবী ঘুরছে, আমরা টের পাই না। ঠিক তেমনি জনবসতির নির্মম পরিবর্তনও আমরা টের পাই না। কিন্তু শিকড় কাঁপানো ভূমিকম্প হলে যেমন টের না পেয়ে উপায় নেই, তেমনি সম্প্রতি রোহিঙ্গা জাতির জনবসতির প্রায় সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদ ও স্থানান্তরিত হওয়ার ঘটনাও ভূমিকম্পের মতো টের পাওয়া যাচ্ছে। বাইবেলের পুরোনো নিয়মে একেকটি জনগোষ্ঠী যে স্থানান্তরিত হয়, আলাদা করে উপনিবেশ গড়ে তোলে, ফলে জন্মভূমির নাম-পরিচয় আলাদা হয়ে যায়। এর উদাহরণ আছে Ñপয়গম্বর মোজেসের ইহুদি জনগোষ্ঠী নিয়ে মিসর ত্যাগের ঘটনার মধ্যে। যেন প্রত্যাদিষ্ট হয়েই তিনি নীল নদ পেরিয়ে নিজ গোষ্ঠীর স্থায়ী বাসস্থান খুঁজে পেলেন। ইহুদিদের এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া হাজার বছর ধরে চলতে থাকল। তারা রীতিমতো স্বদেশহীন হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন একটি বিরাট গণহত্যা সংঘটিত হয়ে গেছে ইহুদিদের বিরুদ্ধে, জাতিসংঘের টনক নড়ল। ইহুদি জনগোষ্ঠীকে জায়গা দেওয়া হলো ঐতিহাসিক ভূমি জেরুজালেম ও এর আশপাশে এবং ইহুদিদের এই রাষ্ট্রটি পরিচিত হলো ইসরায়েল নামে। তারা নিজেদের স্থায়ী মাটি যেন তখনই পেয়ে গেল। কিন্তু এই বসতি স্থাপনের বেলায় ইতিহাসকে গুরুত্ব কতটা দেওয়া হয়েছিল, বোঝা যায় না। একই এলাকায় বসবাসকারী আরব জনগণের ভূমিও ইসরায়েল কেড়ে নিতে শুরু করায় এক অস্বস্তিকর দ্বন্দ্বের শুরু। ভেদাভেদের রাজনীতিও পৌঁছায় চরম সীমায়। আরবীয় মানসকে সহিষ্ণু আরব জাতীয়তাবাদের বদলে সহিংস ধর্মোন্মাদনার দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের ব্যাপক ভূমিকা আছে বৈকি! তারপর থেকে ওই জায়গাটি এখনো সমানে জুজুধান অবস্থায় রয়েছে। এক জাতির শরণার্থীর নির্বিঘ্নেœবসবাসের সুযোগের ফলে আরেক দল মানুষকে ঘরছাড়া হতে হবে, তা কে জানত? পুঁজিবাদী দেশগুলো ইসরায়েলকে একটা প্রচণ্ড শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলে তাদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। মানুষের পরার্থপরতা সুবিদিত, কিন্তু সশব্দে বা নিঃশব্দে, যন্ত্রণা না দিয়ে জোঁকের মতো মানুষের রক্ত পান করাটাও এখন সভ্যতারই অঙ্গ হয়ে গেছে। আজকে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিধর দেশগুলো প্রথম বিশ্ব নিয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বের সমুদয় জনগোষ্ঠীকে শোষণের বন্দোবস্ত করেছে। ফলে পৃথিবীর মনুষ্যসমাজের একতা ও সংহতি তছনছ হয়ে গিয়েছে। হয় ধর্মসূত্রে, না হয় জাতিসূত্রে পৃথিবী যেমন বহু রাষ্ট্রিক হয়ে গেছে, তেমনি কোনো না কোনো ছুতোয়—সে ধর্ম হোক, সংস্কৃতি হোক, অর্থনীতি হোক—মানবসমাজ নিজে থেকেই ‘রাষ্ট্র’ নামের যে সংগঠনটি গড়ে তুলেছিল, সেটাকে নিজেই ভাঙচুর করতে শুরু করেছে। হয় ধর্মভেদ, না হয় নৃতাত্ত্বিক-ভেদ কিংবা সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ভেদ—কিছুতেই আর রাষ্ট্রকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। এরই ফল হিসেবে একেকটি জনপদ বা একেকটি রাষ্ট্র টুকরো টুকরো হওয়ার বিপদের সম্মুখীন হয়েছে।

আমাদের সবার মনে আছে কীভাবে এই ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল এবং সেটা করতে গিয়ে এখানকার রাজনৈতিক নেতারা কতটা রুক্ষতা-বিবেচনাহীনতা-স্বার্থবুদ্ধি ইত্যাদির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলেন; আর বড় বিচিত্র ও অযৌক্তিকভাবে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র তৈরি হলো। ঘটল রক্তপাত-লুণ্ঠন-ধর্ষণÑভয়াবহ আকারে ও প্রকারে—পশ্চিমে পাঞ্জাব আর পূর্বে বাংলায়। ক্রমে এই ভূমি হয়ে উঠল এক গণ-প্রস্থান তথা এক্সোডাসের বেদনাময় রঙ্গমঞ্চ। এক্সোডাস কাকে বলে, ১৯৪৭ সালের পর সেই প্রথম দেখা সামনাসামনি। স্থানচ্যুত হওয়ার অসহায়ত্ব যে কতটা তীব্র হতে পারে, আর সেই তীব্রতাকে কী করে আবার ছাপিয়ে যায় একটুখানি বাঁচার জন্য হাজার আকুতির অনুরণন, তা অনুধাবন করতে পারলাম ওই সময়ে। আর তরুণ বয়সেই বুঝে গেলাম, মনুষ্যজাতি নানা গোষ্ঠী, নানা সংস্কৃতি, নানা ধর্ম অবলম্বন করেও পূর্ণ শান্তিতে একটি রাষ্ট্রে বাস করতে পারে কিংবা এই উপাদানগুলোর সুযোগ নিয়েই পরস্পরকে নানা ভেদের ছুতোয় শরণার্থীতে পরিণত করতেও পারে। এ যেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব—পদার্থবিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ ঘটানোর পাশাপাশি যা থেকে পারমাণবিক বোমাও বের হয়ে এসেছিল।

আমি নিজে, বাংলা যখন ভাগ হয়, তখন, এই শরণার্থীর প্রবল ঢল ধেয়ে আসতে দেখেছি। একসময় তার সঙ্গে যুক্তও হয়ে গেলাম। ধারণা করি, মানুষের শেষ পরিণতি মৃত্যু, কিন্তু তার পরই যদি অস্তিত্বের চূড়ান্ত সংকট বলে কিছু থাকে, তাহলে তা এ-ই: শরণার্থী হয়ে যাওয়া। মৃত্যু আর শরণার্থী-দশাÑ একেবারে পরস্পরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। শরণার্থীর জীবন হয়তো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার সান্ত্বনায় খানিক স্থিতি পায়, কিন্তু সেই জীবনের অগ্রগতি আর হয় কই। দাঁড়ায়, কিন্তু এগোয় না।

পৃথিবীতে আজ, এই মুহূর্তে যে ভয়াবহতম সংকট, তা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি থাকা অস্তিত্বের সংকট। অহিংসা পরম ধর্ম, বুদ্ধের এমন পরম বাণীতে এখন মিয়ানমার কি আর বিশ্বাস রাখে? আমার তো মনে হয় হিংসাই মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর কাজে লাগছে বেশি। নিজ দেশের ভূমিপুত্রদের প্রথমে অস্বীকার, তারপর বলপূর্বক বিতাড়নের পাশবিক খেলা। গণহত্যা ও গণনির্যাতনের সব নিষ্ঠুর উপাদানই তাদের কাছে নস্যি। মানবিকতা নামের শব্দটি এখন বেশির ভাগ দেশেরই অভিধান থেকে বিলুপ্ত, তবু এমন নিষ্ঠুরতার সাম্প্রতিক নজির কি খুব বেশি দেখেছি?

পাশাপাশি আরেকটি কথা এইখানে মনে হয়, বাংলাদেশের অনেক নাগরিকও তো এখন নীরবে মৃত্যুভয়ে শরণার্থীতে পরিণত হচ্ছে, হয় রাষ্ট্র-সরকার-ক্ষমতাসীনদের সমালোচনা করার ‘অপরাধে’ (!), নয় তো নিজের বাক্‌স্বাধীনতার স্বাভাবিক অধিকার প্রয়োগের জন্য বা¯ স্রেফ সংখ্যাগুরুর থেকে ধর্ম আলাদা বলে—এই সব নামহীন-গোত্রহীন অসহায় শরণার্থীর কথা যদি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ভুলে যায়, তাহলে তার পরিণতি খুব শুভ হবে না।

রাজশাহী, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭