আমেরিকার জায়গা দখল করছে চীন!

একটি সময় প্রবাদ ছিল, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য অস্ত যায় না’।
কিন্তু ১৯৫৬ সালে সুয়েজখাল সংকটের মধ্য দিয়ে মূলত সেই পরাশক্তি ব্রিটেনের চূড়ান্ত পতন হয় এবং বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে নতুন পরাশক্তি আমেরিকার আবির্ভাব হয়। সেই থেকে প্রায় সাতটি দশক ধরে সারা বিশ্বে মার্কিনরা অনেকটা এককভাবেই তাদের নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে।

তবে মার্কিনরা যে সব সময় সম্পদ ও পেশিশক্তি দিয়ে বিশ্বে তাদের আধিপত্য স্থাপন করেছে, তা কিন্তু নয়। বরং দেশটি তাদের নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা, অভ্যন্তরীণ সুশাসন, বিশ্ব মানবতায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন ও বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারিতে সবার আগে মানবিক সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে অন্যদের মধ্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মান বৃদ্ধি করছে।

কিন্তু করোনা মহামারিতে এসে মার্কিনরা তাদের চিরাচরিত সেই অবস্থান ধরে রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মহামারিতে তারা বিশ্বকে সাহায্য করা দূরে থাক, উল্টো নিজেদের ঘর সামলাতেই রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে।

অন্যদিকে, চীনের ক্ষেত্রে চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহান প্রদেশ, কিন্তু তাদের সঠিক পরিকল্পনা ও কঠোরভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করায় তারা ভাইরাসটিকে সারা চীনে ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে সক্ষম হয়। তারা ভাইরাসটিকে শুধু উহান প্রদেশে সীমাবদ্ধ রেখে সংক্রমণ ও প্রাণহানিকে তুলনামূলকভাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে উহানসহ পুরো চীনের জনজীবন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে।

করোনাকে সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করে উহান যখন স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরে যায়, ঠিক তখন উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্বের উৎপাদন ও জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে বিমানের আন্তর্জাতিক ফ্লাইট, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পুরো বিশ্ব, ধস নেমেছে পর্যটন শিল্পে। স্কুল-কলেজ, রেস্তোরাঁ, পানশালা, শপিং সেন্টারগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছে। কলকারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। কোটি কোটি মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। শেয়ার মার্কেটে ভয়াবহ ধস নেমেছে। রাষ্ট্রগুলো ট্রিলিয়ন ডলারের ফেডারেল অর্থ প্রণোদনা দিয়েও অর্থনৈতিক ধস ঠেকাতে পারছে না।

অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, চীন তাদের ঘর সফলভাবে সামলিয়ে বিশ্বের দুর্যোগকবলিত দেশগুলোতে অর্থ, মেডিকেল সরঞ্জাম, প্রযুক্তি, চিকিৎসকসহ নানা ধরনের মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে হাজির হচ্ছে। এই সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে তারা মূলত বিশ্বের কাছে তাদের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ব তুলে ধরছে। এতদিন ধরে যে কাজটি মার্কিনরা করত, করোনায় তাদের টালমাটাল অবস্থায় সেই শূন্য স্থানটি এখন চীন দখল করে নিচ্ছে।

অনেকটা অঘোষিতভাবেই বহুদিন থেকে চীনের সঙ্গে আমেরিকার অর্থনৈতিক যুদ্ধ চলে আসছে। অর্থনীতিতে চীন ইতিমধ্যেই সব দেশকে পেছনে ফেলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। সামরিক শক্তির দিক থেকে চীন এতদিন আঞ্চলিক শক্তি ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট শি জিং পিংয়ের নেতৃত্বে চীন এখন বৈশ্বিক নেতৃত্বে যেতে চাচ্ছে।

গত বছরের শেষের দিকে চীনে প্রথম যখন করোনাভাইরাসের সন্ধান মিলে, তখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা মোকাবিলায় চীনের প্রশংসা করেন। কিন্তু ভাইরাসটি যখন যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমিত হতে থাকে, তখন তিনি স্বর পরিবর্তন করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভাইরাসটিকে ‘চায়না ভাইরাস’ বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন। ট্রাম্পের ‘চায়না ভাইরাস’–এর প্রতি উত্তরে চীনের রাষ্ট্রীয় মুখপাত্র পাল্টা অভিযোগ করে বলে, আমেরিকান সেনাবাহিনীর মাধ্যমে উহানে ভাইরাসটি ছড়ানো হয়েছে। এভাবে পাল্টাপাল্টি অভিযোগে দুই দেশের সম্পর্ক অবনতি হতে থাকে।

পাশ্চাত্যের বহু কূটনৈতিক ও রাজনীতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, করোনাকালীন সংকটকে পুঁজি করে চীন চাইছে বিশ্বে তাদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব স্থাপন করতে। তাহলে কি আরেকটি সুয়েজ সংকট আসন্ন? করোনা কি চীনের পরাশক্তি হওয়ার পথকে ত্বরান্বিত করছে? সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, করোনা কি তাহলে ল্যাবে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট?

এসব প্রশ্নের রহস্য উন্মোচিত হোক বা না হোক—তবে, ইতিমধ্যে বিশ্ব এটি উপলব্ধি করতে পেরেছে, করোনা উত্তর পৃথিবী এক নতুন পৃথিবী হবে। যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক, বৈশ্বিক রাজনীতিসহ বহু ক্ষেত্রেই ঘটে যাবে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।