আমেরিকায় বেকার ৬৬ লাখ

>
  • বেকার ভাতা চেয়ে রেকর্ড প্রায় ৬৭ লাখ আবেদন
  • দ্বিতীয় প্রান্তিকেই বেকার ৭৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে 
  • ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার পর এমন পরিস্থিতি আর দেখা যায়নি


নতুন করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারিতে আক্ষরিক অর্থেই পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে আমেরিকা। দলে দলে মানুষ বেকার হচ্ছে। ২ ট্রিলিয়ন ডলারের সরকারি সহযোগিতার যে তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে এই কর্মহীন মানুষদের কতটা সুরক্ষা দেওয়া যাবে, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিচ্ছে এখন। ২ এপ্রিল পর্যন্ত বেকার ভাতা চেয়ে প্রায় ৬৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষ আবেদন করেছে। অথচ ২ সপ্তাহ আগেও এই সংখ্যা ছিল মাত্র ২ লাখ ৮১ হাজার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আমেরিকায় আগে কখনো এত বেশিসংখ্যক বেকার ভাতার আবেদন জমা পড়েনি। এর আগের রেকর্ডটি ছিল ১৯৮২ সালের অক্টোবরে। সে সময় বেকার ভাতা চেয়ে করা আবেদনের সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৯৫ হাজার। আগের এই রেকর্ডকে বর্তমান সংখ্যার পাশে রীতিমতো শিশু মনে হচ্ছে।

গত ২৬ মার্চ মার্কিন শ্রম মন্ত্রণালয় জানায়, এক সপ্তাহের মধ্যে ৩০ লাখ আবেদন জমা পড়েছে। পরের সপ্তাহেই এ আবেদনের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৬৬ লাখ ৫০ হাজারে। দু সপ্তাহ আগেও এ সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৮১ হাজার।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এ তথ্য মার্কিন অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের প্রভাব বোঝার জন্য যথেষ্ট। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ভিড় এড়ানো ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতি নেওয়ায় বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে কাজ হারাচ্ছে মানুষ।

মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্টিভ মানচিন বলেছেন, গেল মাসেই বেকারত্বের হার ছিল আমেরিকার ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কাছাকাছি। সর্বনিম্ন বেকারত্বের হারের রেকর্ড করাটা তখন সময়ের ব্যাপার মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন যে, এ হার এমনকি ২০ শতাংশেও চলে যেতে পারে।

মার্কিন অর্থনীতিতে যে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, তাতে লাখে লাখে মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। বেকার ভাতার জন্য জমা পড়া আবেদনের সংখ্যা থেকেই তা সহজে বোঝা যায়। মন্দা এখন আর আশঙ্কা নয়। এ বিষয়ে ব্যাংক অব দ্য ওয়েস্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ স্কট অ্যান্ডারসন ইউএসএ টুডেকে বলেন, ‘আমেরিকা এরই মধ্যে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। সব সূচকেই এখন বিষয়টি স্পষ্ট।’

মহামারির কারণে মার্কিন অর্থনীতি কোনো ঘোষণা ছাড়াই শাটডাউনের মুখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি এর আগে দেখা যায়নি। ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে রেস্তোরাঁ, দোকান, সিনেমা হল, ক্রীড়া কেন্দ্রগুলোসহ জনসমাগম হয়—এমন সব জায়গা বন্ধ হয়ে গেছে। সর্বশেষ এমন পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়। সে সময় ৫ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছিল সপ্তাহের ব্যবধানে। এর আগে ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পরপর দু সপ্তাহের মধ্যে চাকরি হারিয়েছিলেন ৫ লাখ ১৭ হাজার মানুষ। বর্তমানে বেকার হওয়া মানুষের সংখ্যাই সংকটের মাত্রা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট।

মুশকিল হচ্ছে অর্থনীতিতে সংকট মাত্র শুরু হলো। অক্সফোর্ড ইকনোমিকসের ক্যাথি বোস্তজানসিসের মতে, ‘মানুষের কাজ হারানো মাত্র শুরু হলো। এ সংকট আরও অনেক বিস্তৃত হবে।’ তাঁর সংস্থার অনুমান, আগামী দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই আরও ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষ বেকার হবে।

কতটা বিস্তৃত হতে পারে, তার একটি ধারণা দিয়েছিলেন মুডি’স অ্যানালাইটিকসের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্ক জ্যান্ডি। তাঁর আশঙ্কা ছিল, দ্বিতীয় প্রান্তিকেই আমেরিকায় বেকারের সংখ্যা ৭৫ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। এখন এ সংখ্যা তাঁর আশঙ্কাকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

তবে করোনাভাইরাসের কারণে বেকার হয়ে পড়া মানুষের সংখ্যাটি বেকার ভাতার জন্য করা আবেদনের চেয়ে নিশ্চিতভাবেই বেশি। কারণ, স্ব-নিযুক্ত (সেলফ-এমপ্লয়েড), অস্থায়ী কাজ বা অনিবন্ধিত অভিবাসী, শিক্ষার্থী, যারা গত বছর ছয় মাসের কম কাজে নিযুক্ত ছিলেন—অধিকাংশ অঙ্গরাজ্যেই তাদের পক্ষে বেকার ভাতার আবেদনের সুযোগ নেই। এই দুর্যোগে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা কিন্তু এই অংশেই বেশি। ফলে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করা তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে।

মার্কিন গবেষণা সংস্থা সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো অ্যান্ড্রু স্টেটনার ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘এক ভয়াবহ বেকারত্ব সংকট অপেক্ষা করছে। এমন পরিস্থিতি ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার পর আর দেখা যায়নি।

ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে নিউইয়র্ক নগরে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার বিচারে আমেরিকায় সবচেয়ে বাজে অবস্থা এখন নিউইয়র্কে, যেখানে সারা বিশ্বে শনাক্ত হওয়া কোভিড-১৯ রোগীদের ৫ শতাংশ রয়েছে। এই নগরে বেকার ভাতা চেয়ে করা আবেদনের সংখ্যা এক ধাক্কায় ১০০০ শতাংশ বেড়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, কেন্দ্র থেকে অঙ্গরাজ্যগুলোকে অনুরোধ করা হয়েছে, যেন তারা নিজেরা এ পরিসংখ্যান প্রকাশ না করে। শ্রম মন্ত্রণালয়ই এ সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করবে বলে জানানো হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিপদটি বুঝতে পারছেন। এ কারণেই গত ২৫ মার্চ তিনি টুইট করেন, ‘সত্যিকারের মানুষেরা কাজে ফিরতে চায়, যত দ্রুত সম্ভব।’

ট্রাম্পের এ বক্তব্য নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে। কারণ, তাঁর এই কথায় যদি মানুষ সত্যি সত্যি কাজে নামে, তবে ভাইরাসের সংক্রমণ আর ঠেকানো যাবে না। আর মৃতের সংখ্যা বাড়বে হু হু করে, যা আমেরিকাকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করতে পারে।