কোভিড-১৯ ঠেকাতে অবরুদ্ধ লোকালয়

সতর্কতা ও সুরক্ষা নীতিগুলো মেনে চলাই এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষের একমাত্র হাতিয়ার। ছবি: রয়টার্স
সতর্কতা ও সুরক্ষা নীতিগুলো মেনে চলাই এই মুহূর্তে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষের একমাত্র হাতিয়ার। ছবি: রয়টার্স

একরাশ বিষণ্নতা নিয়ে আজ সকাল হলো! অনিশ্চয়তা, শঙ্কা ও অস্থিরতার গুমোট নিয়ে আরেকটি দিনের শুরু। কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক জীবনে কোনো আশার আলো নেই। দেশে দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর মিছিল শুধু বাড়ছে। করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতিবেগ সুপারসনিক রকেটকেও হার মানাচ্ছে। সভ্যতার শুরুতে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার যে জীবন শুরু হয়েছিল, আজ পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতাই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্যতম হাতিয়ার।

গত কয়েক শ বছর ধরে বারবার এই জনপদে হানা দিয়েছে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ। আর বিজ্ঞানীরা তাকে পরাজিত করেছেন প্রতিষেধক টীকা বা Vaccine আবিষ্কার করে। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে একটি কার্যকরী ভ্যাকসিনের জন্য পুরো বিশ্ব আজ উন্মুখ। দেশে দেশে বিজ্ঞানীরা কঠিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো আশার আলো নেই। করোনাভাইরাসটির গতিবিধি, চরিত্র, গঠন-এর ছড়িয়ে পড়ার পথ বা রুটগুলো এখন আমাদের সবার কাছে পরিচিত। আর এই পথটিকে পুরোপুরি বন্ধ করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। এই অদৃশ্য দানবকে প্রতিরোধের প্রথম ও প্রধান হাতিয়ারটি হলো দূরত্ব। গৃহবাসী একলা জীবন যাপন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হলো সেই আরাধ্য প্রতিষেধক বা টিকা, যা আমাদের পুরোপুরি সুরক্ষা দেবে। ‘Stay home’ আর ‘Social distance’-ই এখন পর্যন্ত মানুষের হাতে থাকা সেই হাতিয়ার, যা প্রয়োগের জন্য সবার কাছে সব দেশে সবাই আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস বলে কোনো vaccination program কখনো সফল হয়নি যতক্ষণ পর্যন্ত আপামর জনগণ পুরোপুরি একে মানসিকভাবে গ্রহণ করেছে। সচেতনতা ও উদ্বুদ্ধকরণ কৌশল না নিলে vaccination program-এর সফল হওয়া দুরূহ বটে।

মোটিভেশন ও করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে এ ভাবনার শুরুটা হলো যখন ন্যান্সি (ছদ্মনাম) নামের ৭৫ বছরের এক উচ্ছল তরুণীর সঙ্গে দেখা হলো। হাঁটুতে সামান্য ব্যথা নিয়ে এসেছেন আল্ট্রাসাউন্ড করাতে। যদিও চিকিৎসক নাকি এখনই এ পরীক্ষা করাতে বলেননি। বরফ পড়া বিষণ্ন দিনগুলো একলা জীবন। বসন্ত যখন দরজায়, তখন ঘরে থাকা তাঁর জন্য খুবই কঠিন। ‘ঘরে থাকার’ সব সংবাদ জানলেও বেরিয়ে এসেছেন সকল ঝুঁকি উপেক্ষা করে। মূলত পরীক্ষা করার ছুতোয় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগটাই প্রধান। এই ধরনের অনেকের দেখাই মিলছে, যাদের ঘরে থাকা কতটা জরুরি এই মহামারির সময়ে তা জানা সত্ত্বেও তারা মানসিকভাবে এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি।

গৃহবন্দী থাকার ক্ষেত্রে মোটিভেশনের যে অভাব হচ্ছে তার প্রমাণ মিলল যখন টরন্টোর মেয়র জন টোরি যখন বললেন, অনেকেই ঘরে থাকা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাঁর কণ্ঠে ছিল স্পষ্ট হতাশা ও অসহায়ত্ব। প্রশাসনের অবস্থান হলো—কী আর করা, সোজাভাবে মানানো না গেলে তো বাঁকা পথ তো ধরতেই হবে। সে পথটি হলো আইন প্রয়োগ।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বেচ্ছা গৃহবাসী জীবনই এখন পর্যন্ত কার্যকরী প্রতিষেধক। এই মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনার পথ হলো কোয়ারেন্টিন বা স্বেচ্ছাবন্দী জীবন তত দিন, যতদিন না এই রোগ তার উপসর্গগুলো নিয়ে দেখা না দেয় এবং আইসোলেশন (অসুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে)। তবে কোয়ারেন্টিনের আগের কথা কিন্তু অবশ্যই contact tracing, যার অর্থ হলো তাকে খুঁজে বের করা যিনি কোনো না কোনোভাবে এই রোগের সঙ্গে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ডিটেকটিভের ভূমিকায় নামতে হবে রোগ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত, তাঁদের। ফেলুদা বা ব্যোমকেশ বা জেমস বন্ডের ক্ষিপ্রতায় তার কাছে পৌঁছানো ও তাকে কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে নেওয়াই এই অদৃশ্য ঘাতককে ঘায়েলের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। এটাই প্রতিষেধক। এটা আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে এবং হৃদয়ঙ্গম করতে হবে।

ঘরে ঘরে স্বেচ্ছা বন্দী জীবন ও সামাজিক দূরত্ব তৈরির মাধ্যমে আমরা কিন্তু সেই কাঙ্ক্ষিত Herd Immunity বা group resistance, যাকে সহজ ভাষায় বর্ণনা করা যায় দলগতভাবে একটি সামাজিক প্রাচীর (social barrier) তৈরি করা। আর এটি করা যাবে সামাজিক ভ্যাকসিনের (ঘরে থাকা, কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন) মাধ্যমে, যার ফলে এই সংক্রামক রোগটি ছড়তে পারবে না প্রাচীরঘেরা সেই জনপদের বাইরে। তাই অবরুদ্ধ (লকডাউন) লোকালয়কে এই রোগের বিস্তার রোধের উপায় বলা হচ্ছে। আর অবরুদ্ধ জীবনই আমাদের সেই herd immunity বা দলগত প্রতিরোধ দেবে।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৮৫৪ সালে ফেরো দ্বীপে একবার হাম রোগের মহামারি ঘটে এবং তারা herd immunity তৈরির মাধ্যমে হামকে পরাজিত করে। সেটা ছিল immunological barrier আর আমদের সামাজিক প্রতিষেধক দিয়ে দলগত সামাজিক সুরক্ষা (Social immunization and herd immunity) করাই এখন একমাত্র পথ।

দীর্ঘ বরফ দিনের শেষে সূর্যের আলো মাখা বসন্ত দিনের খোলা হাওয়ার জন্য মন অস্থির। পাখিদের ডানায় নীল আকাশে মেঘ পরীদের অবাধ ঘোরাফেরা। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আজ জীবনের কোলাহল থেকে দূরে, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন। একটি নতুন ভোরের জন্য নিজেদের গৃহবাসী করে রেখেছে। সেই সকাল হয়তো কাছেই। সে পর্যন্ত আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।

লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক, কমিউনিটি মেডিসিন, টরন্টো, কানাডা