কী বলে আজ প্রবোধ দিতেন মা?

করোনাভাইরাসের আতঙ্কে নিউইয়র্কের পথ–ঘাট ফাঁকা, প্রায় জনশূন্য হয়ে আছে। ৩ এপ্রিল, ম্যানহাটন। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাসের আতঙ্কে নিউইয়র্কের পথ–ঘাট ফাঁকা, প্রায় জনশূন্য হয়ে আছে। ৩ এপ্রিল, ম্যানহাটন। ছবি: রয়টার্স

মা হাসপাতালে। হাসপাতাল মানে পাঁচ তারকা হোটেলের মতো। নতুন আমেরিকা এসেছি। যা দেখি বিস্ময় লাগে। আমাদের সময়ে ঢাকায় পূর্বাণী নামের একটি বড় হোটেল ছিল। সিলেট থেকে ঢাকায় গিয়েছি। এক বড়লোক আত্মীয় নিয়ে গেলেন পূর্বাণী হোটেলে। সদ্য স্বাধীন দেশে এ হোটেল দেখে বলেছিলাম, এখানে কারা আসে? আত্মীয় বলেছিলেন, এখানে সব বড়লোকেরা আসে।

আমেরিকায় এসে দেখি, হাসপাতালগুলো বিলাসবহুল হোটেলের চেয়েও আলিশান। কী নেই? সুইমিংপুল থেকে শুরু করে ব্যায়াম করা ও খেলাধুলার ব্যাপক আয়োজন। রোগী দেখতে আসা লোকজনের সঙ্গে আসা শিশুদের খেলাধুলার আয়োজনও আছে। যারা রোগী দেখতে আসেন, তাঁদের জন্য আছে চা-কফির ব্যবস্থা। আছে পড়ার জন্য লাইব্রেরি।
আমেরিকার হাসপাতাল দেখে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এমন হাসপাতালে কারা আসে? সমাজতন্ত্রের কোনো পাঠ না নেওয়া আমার মা তাঁর ব্যর্থ বিপ্লবী ছেলেকে উদ্দেশ্য করেই জানালেন, এখানে ধনী-গরিব সবাই আসে। সবাই সমান চিকিৎসা পায়।
মা দেশে থাকতে নয় সন্তানের জন্ম দিয়েছেন আঁতুড় ঘরেই। ক্লিনিক ছিল না। হাসপাতালেও যেতে হয়নি। আমেরিকায় আসার পর আমার মা বদলে গেলেন। সর্দি জ্বর হলেই নিজে ৯১১-এ কল করেন। আমরা কেউ জানার আগেই চলে যান হাসপাতালে। আমরা ভাই-বোনেরা খুশি। মা অন্তত নিজের দেখভাল করতে পারছেন এই ভেবে।
মা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরের পর্বটি অনেকটাই উৎসবের মতো। নিউইয়র্ক, নিউজার্সির নানা এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার ভাই-বোনদের হাসপাতালে ছুটে আসা। কে আমাদের মাকে দেখতে আসলেন, কে আসলেন না—তার হিসাব নিতে শুরু করেন মা। বোনদের কেউ কেউ পানের বাটা নিয়ে অপেক্ষমাণ এলাকায় বসে পড়ে। তারা কাঁদতে কাঁদতে প্রথমে আসে। পাশের রুমে কিছুক্ষণ বসে। একপর্যায়ে কোন ভাই তাঁদের খোঁজ কম নিচ্ছে, এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলা শুরু করে দেয়। মা সব শুনতে থাকেন। মা তাঁর ছেলেদের খবর জানতে চান।
আমার সব সময় পৌঁছতে দেরি হয়। এর মধ্যে আমার ওপর কয়েক দফা চোট যায়। বকুনিটা আমার ওপর দিয়ে যাচ্ছে দেখে, বোনেরা এই বিপদের সময়েও মনে মনে হয় খুশি হয়। নিউইয়র্কের বাইরে এক প্রান্তিক শহরে থাকতেন আমার মা। এখানে হাসপাতালের লোকজন এমন জন কাফেলা দেখে অভ্যস্ত নয়। এখানে বুড়ো-বুড়ি হাসপাতালে পড়ে থাকে। কেউ দেখতে আসে না। দূরের কোনো রাজ্য থেকে কদাচিৎ সন্তান একটা ফুলের তোড়া পাঠিয়ে দেয়।

হাসপাতালে পৌঁছেই আমি দ্রুত মায়ের শয্যা পাশে যাই। মাথায় হাত রাখার আগেই মা জিজ্ঞেস করেন, কিছু খাওনি? নিয়মিত খাওয়া দাওয়া না করায় একদম শুকিয়ে যাচ্ছ। ঘরে কি ঠিকমতো রান্নাবান্না হচ্ছে না। পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার স্ত্রীর মুখ চুপসে যায়। যদিও এক সপ্তাহে আমার ১০ পাউন্ড ওজন বেড়েছে।
—বলি, সর্দি জ্বর তোমাকে কাবু করে ফেলল মা। তোমাকে বলা হয় ঠান্ডার এ দেশে বাইরে না যেতে। তুমি কথা না শুনে বাইরে যাও। খেত-খামার করতে লেগে যাও।

মা কিছু বলেন না। জানালেন, তাঁর রক্ত নেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মাঝে মধ্যে কাশি দিচ্ছেন। শরীরে ব্যথা আছে। মাথা ভারী লাগছে। তাঁর এক চাচাতো ভাই খবর পেয়েও কেন এখনো দেখতে আসেনি, এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলেন। তিন দিন হয়ে গেছে। ভাইয়ের ওপর এক চোট নিলেন, ডলারের জন্য পাগল হয়ে গেছে। দেশের বড় সরকারি চাকরি ছেড়ে এসে এখানে ট্যাক্সি চালায় দিন রাত। এবার মামার ওপর দিয়ে যাচ্ছে দেখে আমি বেশ স্বস্তি পেলাম।

প্রায় এক ঘণ্টা বসার পরও রিপোর্ট আসছে না। রাত বাড়ছে। টিভিতে দেখি, আমাদের প্রেসিডেন্ট আরেকটি দেশে হামলার ঘোষণা দিয়েছেন। বলছেন, হয় তুমি আমাদের পক্ষে-না হয় আমাদের বিপক্ষে। বিপক্ষে আর কে যায়, সবাই পক্ষে। কেউ মিনমিন করে কিছু বললেও, পাত্তা দেওয়ার কোনো কারণ নেই। আমাদের অনেক শক্তি। যা ইচ্ছে, করার ক্ষমতা আছে। সংবাদটি দ্রুত লিখতে হবে—এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই মাকে শুনিয়ে সবাইকে ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা বলি।
আমার এক বোনের নাম উচ্চারণ করে ঘোষণা দিই, সবাই ঘরে চলে যাও। খালি ওই বোন থাকবে। তাঁর জন্য পানের বাটা রেখে দিয়ে সবাই আপাতত ঘরে চলে যাও। এ ঘোষণা শুনেই মা খেদোক্তি করলেন, খুব ভালো প্রস্তাব করেছ। সবচেয়ে বোকাজনকে আমার কাছে রেখে যাচ্ছ!
এবারে সব বোনেরা বলে উঠল, না না-আমরা যাচ্ছি না। তোমার কাজ থাকলে তুমি চলে যাও। আমরা আছি—বলেই পাঁচ বোন মাকে ঘিরে বসে থাকল। এমন সময় ডাক্তার উপস্থিত কাগজপত্র হাতে নিয়ে। এখানে ডাক্তারদের মুখ দেখে কিছু অনুমান করা যায় না। হাসতে হাসতে এঁরা অনেক কিছুই বলে ফেলবেন। ডাক্তার হাসতে হাসতেই জানালেন, রক্তে তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। সব রিপোর্ট ভালো। সম্ভবত ভাইরাসের আক্রমণ। কোনো ইনফেকশন পাওয়া যায়নি। তারপরও ইচ্ছে করলে রোগী দিন দু-এক থাকতে পারেন হাসপাতালে। নিয়মিত দেখভালের জন্য।
এমন কথা শুনে, মা বিছানা থেকে উঠে বসে গেলেন। আমি তাঁকে শুয়ে রাখার চেষ্টা করে কাছে যাওয়ার প্রয়াস নিলাম। মা বলে ওঠেন, ‘না আমি ঘরে চলে যাব। ভাইরাসের কারণেই সর্দি জ্বর। এমন অসুখে আমি মরলে তোমাদের ইজ্জত থাকবে না। লোকজনকে কী বলবে? বলবে, তোমাদের মা সর্দি জ্বরে মারা গেছে! আমার না হলেও তোমাদের মান সম্মান বলে কথা।’
মা নিজের সম্মান নিয়ে সর্বদা টনটনে। কটু ঠাকুরের মেয়ে! নিজের বাবা ঘোড়া দাবড়িয়ে বিচার সালিস করতেন, এসবের গল্প আমরা শুনতাম প্রায়ই। যতক্ষণ না আমার মৃদুভাষী বাবা আস্তে করে বলতেন, আমি যখন বিয়ে করেছি তখন ফকির মিসকিনও ওই বাড়িতে যাওয়াকে সময়ের অপচয় মনে করত। এ কথা শুনেই মা একদম চুপসে যেতেন।

হাসপাতালের বিছানায় বসে মায়ের সম্মান রক্ষার কথা শুনি। ভাই বোনেরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি করি। আমরা মাকে নিয়ে ঘরে ফিরি।
হ্যাঁ, আমাদের মা এমন সর্দি জ্বর আর ভাইরাসে মারা যাননি। ক্যানসার ধরা পড়ার পর মেডিকেল বোর্ড বসেছে। আমরা ভাই বোনেরা কাঁদছি। ডাক্তার জানালেন, চিকিৎসা না করালে ছয় মাস। চিকিৎসা চালিয়ে গেলে সর্বোচ্চ দুই বছর। এর মধ্যে পুরো ভালো হওয়ার সম্ভাবনাও আছে ২৫ শতাংশ। এসব শুনে আমাদের মধ্যে কান্নার রোল উঠেছে। মা নিজেই ঘোষণা দিলেন, চিকিৎসা চলবে। দুই বছর হলেও ভালো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়া যাবে।
এরপর থেকে হুলুস্থুল শুরু হলো। মাকে দেখার জন্য প্রতিদিন, সপ্তাহে লোকজন আসতে শুরু করলেন। কেউ আসলেন বাংলাদেশ থেকে, কেউ আসলেন লন্ডন থেকে। ক্যানসারে কাবু হওয়া আমার মা শেষদিকে একদিন জানালেন ম্যানহাটনে যেন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর গ্রামের কিছু লোকজন সেখানে ফল বিক্রি করে, সড়ক পথে খাবার বিক্রি করে। তাদের দেখে তিনি মারা যেতে চান। নিশ্চিত মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনির মধ্যে আমাদের মায়ের এমন মনের জোর দেখে আমরা তাঁর দুর্বল সন্তানেরা বিস্মিত হই। অতঃপর আমাদের মা মারা গেলেন নিজের ও আমাদের ইজ্জত রক্ষা করে।
ছয় বছর হয়ে গেছে। এখনো কেউ কেউ জিজ্ঞেসে করেন, আপনার মা কেমনে মারা গেলেন? উত্তর দিতে গেলেই কথাটি মনে পড়ে। বেদনার তীব্রতা বুকে ধারণ করে উত্তরটা দিই। মৃত্যুকে নিয়ে মায়ের সরস কথাটিও তখন মনে পড়ে।

আজ দুই সপ্তাহের বেশি আমাদের সব পরিবার নিউজার্সি, নিউইয়র্কে গৃহবন্দী। এমন কখনো হয়নি। আমরা কেউ কারও ঘরে যাচ্ছি না। এখনো সবাই সুস্থ। নিজেদের ঘরেও আমরা পৃথক পৃথক রুম থেকে একে অন্যের সঙ্গে ফোনে কথা বলছি। টিভিতে, হাতে থাকা ডিভাইসে মৃত্যুর খবর আসছে। আমাদের আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজনের মধ্যেও করোনাভাইরাস পেয়ে গেছে কারও কারও পরিবারে। পরিচিত কেউ মারাও যাচ্ছে প্রতিদিন।
এমন কঠিন বাস্তবতা আমাদের জীবনে কখনো আসেনি। কারও জীবনে আসেনি। কারও অসুখ বিসুখ হলে, দেখতে যাওয়ার উপায় নাই। সবাই ফোন করে বিলাপ করে। কেউ মারা গেলে জানাজায় যাওয়া যাচ্ছে না। ভাই বোনেরা বলছে, মা থাকলে আজ কী বলতেন? এ করোনাভাইরাসও কি তাঁর ইজ্জতের জন্য হুমকি মনে করতেন? কী বলে আজ আমাদের প্রবোধ দিতেন?

ইব্রাহীম চৌধুরী, নিউজার্সি
ibrahim.chowdhury@prothomalo. com