আমাদের ক্ষমা করবেন

পরিচিত–অপরিচিত জন কিংবা নিকট আত্মীয়স্বজনের প্রয়াণে প্রচলিত সামাজিক কর্তব্য পালন করতে না পেরে অনেক প্রবাসী মানসিক পীড়ায় ভুগছেন। দেশে নয়তো প্রবাসে যেকোনো আত্মীয় বা চেনাজানা কারও মৃত্যু সংবাদ শোনা মাত্র সবার মধ্যে একটি দায়িত্ববোধ কাজ করত।

মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর শুরু খোঁজ খবর নেওয়া। কেউ কেউ ছুটে যেতেন বাসা বাড়ি কিংবা হাসপাতালে। কেউবা আবার দ্বারস্থ হতেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট কারওর কাছে। সাহায্য চাইতেন লাশ হাসপাতাল থেকে ফিউনারেল হোমে পাঠানোসহ বাকি আয়োজন সহায়তা করতে। দীর্ঘ দিন প্রবাসে বাস করছেন অনেক অভিজ্ঞ স্বজন নয়তো পরিচিতজনরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন না চাইতেই। নগরীতে আছে বেশ কয়টি ধর্মভিত্তিক ফিউনারেল হোম। যাদের প্রশাসক অনেকের সঙ্গে স্থানীয় মসজিদগুলোর ইমাম এবং কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তদের ভালো চেনাজানা।

প্রবাসে যেকোনো স্বাভাবিক মৃত্যু পুরো সমাজকে কোনো না কোনোভাবে ছুঁয়ে যায়। নিউইয়র্কের বাঙালি সমাজের অধিকাংশ ব্যক্তি পরিচয়সূত্রে বা আত্মীয়তা সর্বোপরি অনেক কারণে সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ। নগরের এই প্রবাস জীবনের নির্দিষ্ট এক গণ্ডির মধ্যে চলাচল করেও যেকোনো উৎসব যেমন কারও নজর এড়াতে পারে না। তেমনি বাংলাদেশি প্রবাসী ছোট বড় যেকোনো বয়সী পুরুষ মহিলার মৃত্যু পরবর্তী আচার পালনে সবাই একযোগে অংশ নেওয়া আবশ্যক বলেই ভাবেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় মৃত্যুর জন্য দুঃখপ্রকাশ করে সমবেদনা জানানোর পাশাপাশি মৃত্যু পরবর্তী আচার পালনের সংবাদ এমনকি কোথায় দাফন কোথায় হবে তা প্রকাশ হয় ব্যাপকভাবে। পাড়া মহল্লা বা নিজ শহরে মৃতদের জন্য আয়োজিত ধর্মীয় আচার পালনে অংশ নেওয়া শুধু সামাজিক অঙ্গীকার নয় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা অবশ্যই পালনের নিয়মের অন্তর্ভুক্ত। অথচ নির্মম করোনার ছোবলে মৃত মানব সন্তানদের জন্য সামাজিক দায়িত্ব পালন আজকাল সীমিত হয়ে গেছে করোনার বিস্তার রোধে। স্বজনের মৃত্যু সংবাদ শোনা মাত্র শোকাহত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো ছিল প্রবাসীদের সামাজিক দায়িত্বের একটি প্রধান কাজ। আর আজ আমাদের প্রিয়জন উনি চলে গেলে আমরা কিছুই করতে না পারার অনুশোচনায় কষ্ট পাচ্ছি। বেদনাহত হচ্ছি। পিতাকে শেষ বারের মতো দেখতে পারছে না সন্তান। তেমনি ভাই দেখতে পারছে না আপন ভাইকে। কড়া অনুশাসন আর নিয়মনীতির কুঠারাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে আমাদের শত শত বছরের পুরোনো সামাজিক ঐতিহ্যের বন্ধন। আমরা অসহায় হয়ে নিজেকে রক্ষার সকল নিয়ম মেনে চলছি। অথচ হৃদয়ে রক্তক্ষরণের গুমরে ওঠা শব্দ বেশ জোরেশোরে শুনতে পারছি। না পারছি শক্ত এ পাষাণ নিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করতে; না পারছি নিজের মনকে প্রবোধ দিতে। নির্বাক আর স্তব্ধতার এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি। বলতে বাধ্য হচ্ছি, যা চলছে চলতে দাও। একদিন আমরা আমাদের এই অপারগতার জন্য প্রিয়জনদের নিকট ক্ষমা চেয়ে নেব।