জরুরি বিভাগে যুদ্ধ-সময়ের আবহ

ব্রুকলিনের এই হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ছাড়া আর কোনো রোগী নেই এই মুহূর্তে। ছবি: লিংকডইন
ব্রুকলিনের এই হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ছাড়া আর কোনো রোগী নেই এই মুহূর্তে। ছবি: লিংকডইন

নিউইয়র্ক নগরীর ব্রুকলিন। স্থানীয় একটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট নিয়ে ছয়জন গেলেন। কিন্তু কিছু করবার আগেই চারজন মারা গেলেন। এর বাইরে আরও পাঁচবার পাওয়া গেল ‘কোড ৯৯’ ঘণ্টাধ্বনি, যা বাজানো হয় অন্তিম মুহূর্তে রোগীকে শেষ দাওয়াই দিতে চিকিৎসক ও নার্সদের ডাকার উদ্দেশ্যে। এক ঘণ্টারও কম সময়ে ঘটে গেল এসব। কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। অথচ এই জরুরি কক্ষটিকেই যে কারও কাছে মনে হবে সাক্ষাৎ দোজখ।

নিউইয়র্কের ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব ব্রুকলিনের জরুরি বিভাগের ঘটনা এগুলো। সিএনএনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এই ভয়াবহ সময়ে হাসপাতালের কর্মীরা কী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তার অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে সিএনএন প্রতিনিধিরা রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে যান। মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যেই চারজনের মৃত্যু দেখেন তাঁরা। আরও কয়েকজন তখন মুমূর্ষু দশায়।

হাসপাতালের রেসপিরেটরি থেরাপিস্ট জুলি ইসন সিএনএনকে বলেন, ‘তারা এতই অসুস্থ যে, চোখের পলকেই তারা মারা যেতে পারে। তারা হয়তো কথা বলছিল। কিন্তু কয়েক মিনিট পরই তাদের কণ্ঠনালি দিয়ে আপনাকে টিউব ঢোকাতে ঢোকাতে এই প্রার্থনা করতে হবে যে, এই ভেন্টিলেটর যেন তাদের সাহায্য করতে পারে।’

এটি শুধু ব্রুকলিনের একটি হাসপাতালে গল্প নয়। এই একই পরিস্থিতি এখন বিরাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের সব হাসপাতালে। হাসপাতালগুলোয় রোগীদের বাইরে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না বলে চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের বাইরে প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে খুব কম লোকই জানে।

সানি ডাউনস্টেট হেলথ সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির আওতাধীন ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব ব্রুকলিনে বর্তমানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ছাড়া আর কোনো রোগী নেই। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর নির্দেশে যে তিনটি হাসপাতাল শুধু করোনাভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে, এটি তার একটি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে এখনকার চেয়ে বেশি রোগী এলেও এতটা আতঙ্ক তৈরি করেনি। কারণ, এখন হাসপাতালটিতে আসা সব রোগীই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। উপরন্তু জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের অবস্থা গুরুতর এবং এদের মধ্যে মৃত্যুহার অনেক বেশি। হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া কোভিড-১৯ রোগীদের ২৫ শতাংশই মারা গেছে।

এত উচ্চ হার দেখে অন্য সময় হলে হাসপাতালের সেবা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যেত। কিন্তু এখন এ প্রশ্ন উঠছে না। এ বিষয়ে ড. লরেঞ্জো প্যালাডিনো সিএনএনকে বলেন, ‘হাসপাতাল নয়, রোগের প্রকৃতির কারণেই এমন ঘটছে। অন্য কোনো রোগ নেই। অন্য কোনো ভাইরাস নেই। একের পর এক রোগী আসছেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে। বিশ্রামের কোনো সুযোগ নেই।’

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেখা গেল একজন স্বাস্থ্যকর্মী মাত্রই মারা যাওয়া একজনকে এনে রেখেছেন। পলিথিনে মোড়া সেই মরদেহের কোনো অস্তিত্ব ৩০ মিনিট পর আর দেখা গেল না। তখন সেখানে কয়েকজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী স্থানটি জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করছেন। এর কিছুক্ষণ পর সেখানে এসে দেখা গেল, আরেকজন রোগী মুখে মাস্ক পরে বসে আছেন। ভীষণ কাশছেন। একপর্যায়ে তাঁকে অক্সিজেন দেওয়া হলো।

হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া প্রায় ৪০০ কোভিড-১৯ রোগীর মধ্যে ৯০ শতাংশেরই বয়স ৪৫ বছরের বেশি। ৬০ শতাংশের বেশি রোগীর বয়স ৬৫ বছরের বেশি। সবচেয়ে কম বয়সী রোগীটির বয়স ৩ বছর। ২০ বছরের আশপাশে বয়স—এমন তরুণের সংখ্যাও কম নয়। এখন পর্যন্ত হাসপাতালটিতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯৪ জন রোগী মারা গেছেন।

সানি ডাউনস্টেটের এই হাসপাতালের দৃশ্য বাইরের পৃথিবী থেকে একেবারেই আলাদা। বাইরের পৃথিবীতে যখন চলছে, ঘরে থাকার নিয়মের কড়াকড়ি, তখন এখানে কিছু হই-হল্লার দেখা মিললেও, তার সবই হৃদয় ছিঁড়ে দেওয়া। এখানে প্রাণ কাতর ধ্বনিই একমাত্র কোলাহল। আর বাকি সব কোলাহল ঘরের চার দেয়ালে আটক। এই কোলাহল ও নিস্তব্ধতা যেন যুদ্ধ সময়ের আবহ তৈরি করে রেখেছে। ড. রবার্ট গোর বলেন, ‘এই যে জরুরি বিভাগ। এখানে এখন যে ধরনের কাজ চলছে, তা কোনো বিধ্বস্ত নগরী বা ভয়াবহ দুর্যোগের সময়ে চলার কথা।’